মার্কিন বাহিনীর হাতে যেভাবে ধরা পড়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর সাদ্দাম হোসেন

২১ মিনিট আগে

ইরাকে ২০০৩ সালের মার্কিন-নেতৃত্বাধীন অভিযানে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হবার পরও আট মাস পালিয়ে ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে তিকরিত শহরের কাছে ধরা পড়েন তিনি। তাকে সনাক্ত করার জন্য মার্কিন বাহিনী সাহায্য চেয়েছিল মুয়াফাক আল-রুবাইয়ের। ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্বে সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন বিবিসির লুইস হিদালগোর কাছে।

মাসের পর মাস অনুসন্ধানের পর সাদ্দাম হোসেনকে পাওয়া গিয়েছিল ভূগর্ভস্থ এক বাংকারে, তার নিজ শহর তিকরিতের কাছে এক খামার বাড়িতে ।

“ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, আমরা তাকে পেয়েছি” – এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা ঘোষণা করেছিলেন ইরাকে মার্কিন প্রশাসক পল ব্রেমার। তার ঘোষণার সাথে সাথে- উপস্থিত সবাই ফেটে পড়েছিল উল্লাসে।

“সাদ্দাম হোসেন ধরা পড়েছেন ২০০৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে আটটায় – তিকরিতের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে আদওয়ারের এক ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠ থেকে। আমি ইরাকের জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই। আজ ইরাকের জন্য এক স্মরণীয় দিন। কয়েক দশক ধরে আপনাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই নিষ্ঠুর লোকটির হাতে নিপীড়িত হয়েছেন।“

এমনি একজন ইরাকি ছিলেন ড. মুয়াফাক আল-রুবাই।

১৯৭০এর দশকে যখন ইরাকের ক্ষমতায় সাদ্দাম হোসেনের উত্থান হয় – ড. আল-রুবাই তখন কারাগারে । সেখানে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল।

ইরাকে মার্কিন-নিযুক্ত প্রশাসক পল ব্রেমার

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ইরাকে মার্কিন-নিযুক্ত প্রশাসক পল ব্রেমার ঘোষণা করেছিলেন সাদ্দাম হোসেনের ধরা পড়ার খবর

সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হন ১৯৭৯ সালে, - আর সে বছরই দেশ ত্যাগ করেন ড. রুবাই।

প্রায় ২৫ বছর পর তিনি দেশে ফেরেন – তাকে আমেরিকানদের বসানো প্রশাসনে নিয়োগ করা হয়। সাদ্দাম যেদিন ধরা পড়েন – সেদিন ড. রুবাই একটি বৈঠক করছিলেন। তার মধ্যেই একজন সহযোগী এসে তার কানে কানে খবরটি দেন।

সেই মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করে ড. আল-রুবাই বলছিলেন - “আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, খবরটাও গোপন রাখতে পারিনি। আমার চেহারাতেই বোঝা যাচ্ছিল কি ঘটেছে, বৈঠকে যারা ছিল তারাও তখনি বুঝতে পেরেছিল।"

"সেই বৈঠক স্বতস্ফূর্তভাবেই ভেঙে গেল, লোকজন উল্লাসে চিৎকার করতে লাগলো, শ্লোগান দিতে লাগলো। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।"

মুয়াফাক আল রুবাই, ইরাকের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

মুয়াফাক আল রুবাই, ইরাকের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

“দু হাজার তিন সালের ৯ই এপ্রিল – যেদিন সাদ্দাম হোসেন উৎখাত হলো, সেদিন থেকে সে ধরা পড়া পর্যন্ত – ইরাকের সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে পারেনি যে এই শাসকচক্রটি বিদায় নিয়েছে এবং সাদ্দামের পতন হয়েছে।"

"দেশে তখন নানা রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভেসে বেড়াচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত সে ধরা না পড়ছে, গ্রেফতার না হচ্ছে - ততক্ষণ লোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সাদ্দাম হোসেন আর ফিরে আসবে না" - বলছিলেন ড. আল রুবাই।

সাদ্দাম হোসেন – যিনি এত দীর্ঘ সময় ধরে লৌহকঠিন হাতে ইরাক শাসন করেছেন – তাকে পাওয়া যায় তার নিজ শহর তিকরিতের কাছে এক খামার বাড়ির একটি ছোট ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে লুকানো অবস্থায়।

সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর  বাগদাদে তার এই ভাস্কর্যটি টেনে নামানো হয়।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর বাগদাদে তার এই ভাস্কর্যটি টেনে নামানো হয়।

সেখানকার বর্ণনা দিয়ে বিবিসির একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, "প্রথম দেখলে এখানে কি আছে কিছুই বোঝা যায় না। রুক্ষ মাটির ওপর একটা ছোট কুটির। তার চারপাশে নানা রকমের গৃহস্থালী জিনিসপত্রের টুকরোটাকরা ছড়ানো।"

"এসব আবর্জনার মধ্যে একটা গর্ত – যা ময়লা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। তার ভেতরে একটা চোরা দরজা, এমনভাবে লুকানো যা বাইরে থেকে বোঝাই যায়না। "

বহু বছর ধরে লক্ষ লক্ষ ইরাকির ওপর প্রভুত্ব করার পর এবং যে বাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যূত করেছে তাদের হাত থেকে আট মাস পালিয়ে থাকার পর – এই হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে সাদ্দাম হোসেন কে পাওয়া যায়।

যে লোকটি প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে থাকতে অভ্যস্ত – তিনিই লুকিয়ে ছিলেন মাটির নিচে এক গর্তের মধ্যে।

বাংকার

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

সাদ্দাম যেখানে লুকিয়ে ছিলেন সেই বাংকারের প্রবেশপথটি পরীক্ষা করছে মার্কিন সৈন্যরা।

ধরা পড়ার পর প্রথম প্রকাশিত ছবিতে সাদ্দামকে দেখা যায় বিধ্বস্ত-অপরিচ্ছন্ন, লম্বা চুল-দাড়িতে মুখ ঢাকা অবস্থায়।

বিবিসির সাথে কাজ করতেন বশির নামে একজন ইরাকি যুবক। তিনি সাদ্দাম হোসেনকে পছন্দ করতেন না কিন্তু তবু সেই প্রথম ছবিগুলো দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

"আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। টিভিতে তার ছবি দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক গুহামানব। যিনি লৌহকঠিন হাতে ইরাক শাসন করতেন, তাকে দেখলাম একজন কয়েদি হিসেবে – এবং তাকে পরীক্ষা করছেন মার্কিন বাহিনীর একজন ডাক্তার । এটা ছিল হতবাক করার মতোই দৃশ্য।"

মুয়াফাক আল-রুবাইকে সেদিনই মার্কিন বাহিনী অনুরোধ করলো যেন তিনি আরো কয়েকজন উর্ধতন ইরাকি রাজনীতিবিদকে নিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে দেখতে যান, এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত করেন সেই লোকটিকে – যিনি তার জীবনের অনেকগুলো বছর ধরে ছিলেন এক মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন।

ধরা পড়ার পর সারা বিশ্বের টিভিতে সাদ্দাম হোসেনের এই ছবি দেখানো হয়

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ধরা পড়ার পর সারা বিশ্বজুড়ে টিভিতে সাদ্দাম হোসেনের এই ছবি দেখানো হয়

“আমাদের হেলিকপ্টারে করে বাগদাদ এয়ারপোর্টে নিযে যাওয়া হলো। প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি যে সাদ্দাম হোসেনই তা নিশ্চিত করা। ইরাকে আমেরিকান কমান্ডার ছিলেন জেনারেল সানচেজ। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি লোকটিকে দেখতে যেতে চাই কিনা।"

"তিনি জানতে চাইলেন, আমি কি কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে তাকে দেখতে চাই, নাকি ফোনে কথা কথা বলতে চাই, নাকি তার সামনে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত হয়ে তাকে দেখতে চাই।"

"আমি বললাম - না, আমি তার সাথে সামনাসামনি সাক্ষাত করতে চাই।

তার সাথে কথা বলতে চাই তাকে প্রশ্ন করতে চাই। ১৯৭৯ সাল থেকেই তাকে আমি কখনো ভুলতে পারিনি, কারণ তার জন্যই আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল" - বলেন মুয়াফাক আল রুবাই।

১৯৭০এর দশক থেকে ২০০৩ পর্যন্ত লৌহকঠিন হাতে ইরাক শাসন করেন সাদ্দাম হোসেন

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

১৯৭০এর দশক থেকে ২০০৩ পর্যন্ত লৌহকঠিন হাতে ইরাক শাসন করেন সাদ্দাম হোসেন

ড. রুবাই বর্ণনা করছিলেন বন্দী সাদ্দামের সাথে ছোট্ট এক কারা প্রকোষ্ঠে সেই সাক্ষাতের সময় কী ঘটেছিল।

"আমি দেখলাম তিনি একটা বিছানার এক প্রান্তে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার পরনে সাদা গাউন আর জাম্পার। তার মাথার চুল খুবই এলোমেলো। আমাদের জন্য চারটি চেয়ার দেয়া হলো। আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। তার পর আমি তাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলাম।"

" প্রথমেই প্রশ্ন করলাম, আপনি কেন ইমাম সদরকে হত্যা করলেন? কেন আপনি ইরান আক্রমণ করলেন? কেন কুয়েত দখল করলেন? কেন কুর্দিদের ওপর বিষপ্রয়োগ করেছিলেন? দক্ষিণ ইরাকে, লক্ষ লক্ষ শিয়াকে হত্যা করে গণকবর দিয়েছিলেন কেন? কেন হাজার হাজার লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন? এই রকম অসংখ্য প্রশ্ন দিয়ে আমি তাকে আক্রমণ করলাম।"

" তার উত্তরে হয় সাদ্দাম হোসেন আমার প্রশ্নের উত্তরে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে লাগলেন, কখনো বা আমার প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন, অথবা তার কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে সেই সব জবাব দিতে লাগলেন ঠিক যেসব কথা তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় বলতেন। "

সাদ্দাম হোসেনের ধরা পড়ার খবর

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

সাদ্দাম হোসেনের ধরা পড়ার খবর বিশ্বব্যাপি সংবাদপত্রগুলোয় ফলাও করে ছাপা হয়

ড. আল-রুবাই সাদ্দামের সেই কারাকক্ষে ছিলেন প্রায় এক ঘণ্টা। তিনি সেই ঘরে ঢুকেছিলেন সবার আগে, আর বেরিয়েছিলেনও সবার পরে।

"আমার যতগুলো প্রশ্ন করার ছিল তার সবগুলো না করে আমি ঘর ছাড়তে চাইনি। আমার মনে এমন ভাবনাও এসেছিল যে এই লোকটাকে আমরা যদি এখানেই মেরে ফেলি তাহলে কেমন হয়। তাহলে বাইরে গিয়ে জনগণকে এই ভালো খবরটা জানাতে পারি যে সাদ্দাম আর বেঁচে নেই।"

" কিন্তু পরক্ষণেই আমার সম্বিৎ ফিরলো। আমার মনে হলো, এটাই তো আমার সাথে সাদ্দামের পার্থক্য । আমি চাই তার যথাযথভাবে এবং মানুষের চোখের সামনে একটা বিচার হোক – যে বিচার ইরাকের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।"

" তাই আমি যখন সেই কারাকক্ষ থেকে বের হই, তখন আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম – সাদ্দাম হোসেন, তোমার ওপর আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক। সে অশ্রাব্য নোংরা ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো, দুনিয়াতে যত অশ্লীল শব্দ আছে সব মিশিয়ে সে গালাগালি করতে লাগলো। "

বিচারের সময় আদালতে সাদ্দাম হোসেন

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

বিচারের সময় আদালতে সাদ্দাম হোসেন

সাদ্দাম হোসেনের কারাগার থেকে বেরুনোর পর অনেক বছর পর্যন্ত মুয়াফাক আল-রুবাই দুঃস্বপ্ন দেখতেন।

তিনি বলেন, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে সাদ্দামের সাথে সেই সাক্ষাতের পর তিনি আবার সেই সব দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।

২০০৫ সালের অক্টোবরে বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের বিচার শুরু হয়। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়, আর ২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর তার ফাঁসি হয়।

মুয়াফাক আল-রুবাই সেসময় ছিলেন ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।

সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন – মুয়াফাক আল রুবাইও ছিলেন তাদের একজন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews