দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার পূর্ণ কাঠামোগত সংস্কার আনতে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারসহ দশটি বিষয়ে মৌলিক পরিবর্তন চেয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), যেখানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদে (এনসিসি) দেওয়া হয়েছে গুরুত্ব।
গণ অভ্যুত্থানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত নতুন দলটি মনে করছে, ক্ষমতাসীনদের ‘ফ্যাসিবাদী’ হয়ে ওঠা ঠেকাতে ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি, যেখানে বিরোধী দলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা দরকার। যে কারণে তারা ছায়া মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর প্রধান বিরোধী দল থেকে চায়।
মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় ‘মৌলিক সংস্কার এর রূপরেখা’ তুলে ধরেছে দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের দলটি।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের কাছে এ সংস্কার প্রস্তাব হস্তান্তর করেন।
বৈঠক শেষে আখতার বলেন, “বর্তমানে আমরা যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নামেই দেওয়া হোক না কেন, তার পূর্বে যেন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার নাম দেওয়া হয়। যাতে করে সেই সরকার দীর্ঘ সময় থাকার যে মানসিকতা, সেটা কমে আসে এবং তাদের যেন শুধু নির্বাচনের ব্যপারেই ফোকাসটা থাকে সেটা আমরা তুলে ধরেছি।”
গত ৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
সংস্কারের লক্ষ্যে প্রথম ধাপে গঠিত ছয়টি কমিশনের মধ্যে পাঁচটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সরকারের সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপি আত্মপ্রকাশ করে। সেকেন্ড রিপাবলিক স্থাপন ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্য ধরে রাজনীতির মাঠে হাজির হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের দলটি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির এই সংলাপ শুরু হয়েছিল ১৯ এপ্রিল। সেদিনের আলোচনার পর সংলাপ মূলতবি হয়।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার, জাভেদ রাসিন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এই সংলাপে অংশ নেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।
মৌলিক সংস্কারে এনসিপির যত প্রস্তাব
এনসিপির রূপরেখায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার পূর্ণ কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে–যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সংবিধানের স্বৈরতান্ত্রিক ভিত্তি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ, এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি জনভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ‘প্রতিষ্ঠা’ করা যাবে।
দলটির দাবি, মৌলিক সংস্কার স্রেফ নির্বাচনি সংস্কার নয়। মৌলিক সংস্কার বলতে এমন ‘কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তনকে’ বোঝায়, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ—যেমন নির্বাহী, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়নকারী বিভাগগুলোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহিতা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ‘নিশ্চিত’ করা যায়।
মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-
>> সাংবিধানিক ব্যবস্থা
>> প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য
>> স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন
>> সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান
>> বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
>> সাংবিধানিক পদে নিয়োগ
>> নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার
>> দুদক সংস্কার
>> স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার
>> জনপ্রশাসন সংস্কার
জনপ্রশাসন ব্যবস্থা সংস্কারে ১০টি, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আটটি, দুদক সংস্কার কমিশন সংস্কারে তিনটি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সাতটি, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন নিশ্চিতে ১১টি, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে পাঁচটি ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে আটটি সুপারিশ করেছে এনসিপি।
জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদের (এনসিসি) প্রস্তাব
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও নির্বাহী বিভাগের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ‘জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ বা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)’ গঠনের প্রস্তাব করেছে এনসিপি। সরকার ও বিরোধী দল ছাড়াও বিচার বিভাগ এবং সংসদের বাইরের প্রতিনিধিরাও এতে যুক্ত থাকার কথা বলেছে দলটি।
এনসিপি বলেছেন, গণতন্ত্রের একটি অন্যতম ভিত্তি হল- রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন-মহা-হিসাব নিরীক্ষক, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলকভাবে কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত সাধারণ নাগরিকের অধিকার রক্ষা, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং রাষ্ট্রীয় সেবা সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসে।
দলটি বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর (নির্বাহী প্রধান) একক ক্ষমতার অধীনে থাকায় বাস্তবতা হয়েছে ভিন্ন। দলীয় সরকারের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে এসব সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, কখনো দুর্নীতি দমনের সংস্থা ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করা হয়েছে, আবার কখনো নির্বাচন কমিশনকে নিযুক্ত করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়েছে।
এর ফলে, ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থা বদলাতে একটি নিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন নিয়োগ ব্যবস্থা প্রয়োজনের কথা তুলে ধরে এনসিপি বলেছে, এ কারণেই তারা জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের প্রস্তাবকে মৌলিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সামনে এনেছে।
দলটি বলেছে, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ হবে একটি বহুপক্ষীয় প্রতিনিধিত্বসম্পন্ন সংস্থা, যেখানে সরকার ও বিরোধী দল ছাড়াও বিচার বিভাগ এবং সংসদের বাইরের প্রতিনিধিরাও যুক্ত থাকবেন।
পরিষদের প্রস্তাবিত সদস্যরা হলেন- রাষ্ট্রপতি–চেয়ারপারসন হিসেবে (মূলত প্রতীকী নেতৃত্ব), প্রধানমন্ত্রী (নির্বাহী প্রধান), উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের স্পিকার (দুইজন), বিরোধী দলের নেতা (মূল বিরোধী জোট থেকে), উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের ডেপুটি স্পিকার (যারা বিরোধী দল মনোনীত), প্রধান বিচারপতি (বিচার বিভাগের শীর্ষ প্রতিনিধি), সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের একজন সদস্য।
সাংবিধানিক পরিষদ হবে একমাত্র সংস্থা যার সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। মহা-হিসাব নিরীক্ষক, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, তথ্য কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন, শ্রম কমিশন, পুলিশ কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য সংস্থার প্রধানও নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক পরিষদ একটি যোগ্যতাভিত্তিক উন্মুক্ত যাচাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রার্থীর পেশাগত দক্ষতা, সততা, সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও পূর্ব অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করার মাধ্যমে মনোনয়ন দেবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের অংশগ্রহণে উন্মুক্ত শুনানি করা যেতে পারে (বিশেষত বড় নিয়োগে)।
সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে সাংবিধানিক পরিষদ। রাষ্ট্রপতি সেই সুপারিশ অনুযায়ী নিয়োগ দেবেন। মতামতের ক্ষেত্রে দুই পক্ষ সমান হয়ে গেলে রাষ্ট্রপতির ভোটে সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করার সুযোগ থাকবে।
এর আগে গত ২৩ মার্চ কমিশনে মতামত দেওয়ার সময় আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছিলেন, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ হতে পারে নয় সদস্যের। পরিষদের সিদ্ধান্ত হতে হবে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে।
প্রতিরক্ষা বাহিনী ও অ্যাটর্নি জেনারেল বাদে সকল সাংবিধানিক পদে নিয়োগের দায়িত্ব থাকবে সাংবিধানিক পরিষদের হাতে।
জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ কার্যকর হলে এর মাধ্যমে সাংবিধানিক নিয়োগে রাজনৈতিক দলীয়করণের অবসান হবে বলে মনে করে এনসিপি। নিয়োগ ক্ষমতা এককভাবে সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকায় দলীয় হস্তক্ষেপও রোধ হবে।
ছায়া মন্ত্রিসভার প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে
এনসিপির মতে, ছায়া মন্ত্রিসভা হবে বিরোধী দলের এমন একটি কাঠামো, যারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সরকারের নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন।
ছায়া মন্ত্রিসভা চালু হলে সংসদীয় রাজনীতি কার্যকর হবে, এমন আশার কথা তুলে এনসিপি বলেছে, এর ফলে প্রশাসনকে জবাবদিহির মধ্যে রাখা সহজ হবে এবং পাশাপাশি বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।
দলটি বলছে, “ছায়া মন্ত্রিসভা শুধু একটি বিরোধী দলীয় কাঠামো নয়, বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ, যা জবাবদিহিতা, বিকল্প চিন্তা এবং সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন ও এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখন সময়োপযোগী একটি মৌলিক সংস্কার।”
ছায়া মন্ত্রিসভার বিষয়ে দলটি বলেছে, প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন করে বিকল্প বা ‘ছায়া মন্ত্রী’ মনোনীত করা হয়, যা যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রয়েছে।
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা নিয়োগের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ঐকমত্য কমিশনে তুলে ধরেছে এনসিপি। দলটির মতে, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে কেবল ও কেবলমাত্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চলছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।”
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কেবল নির্বাচন আয়োজন করা। এর মেয়াদ ৭০-৭৫ দিন হতে পারে। নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ থাকলে আলাদা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দরকার নেই; দায়িত্ব নিতে পারে পরিষদ। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত পরিষদ থাকবে।
আরও যত সুপারিশ
সংবিধানের ১৪৮(৩) অনুসারে, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন সম্ভব।
এনসিপি মনে করে, মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও বিচারবিভাগের কাঠামো সংশোধন-উভয় কক্ষেই কেবল দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও জনগণের মতামত নেওয়া জরুরি। এমন সংশোধনীগুলো শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে করা উচিত নয়, বরং সেগুলোকে গণভোটে রাখা উচিত।
সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৭ অনুচ্ছেদ (৭খ বাতিল করতে হবে); মৌলিক অধিকার; নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের কাঠামো; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; নির্বাহী ক্ষমতার গঠন ও ভারসাম্য (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত); সংসদ ভেঙে দেওয়া বা মেয়াদ সংক্রান্ত বিধান ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কাঠামো-এমন সংশোধনীর ক্ষেত্রে গণভোট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব এনসিপির।
মৌলিক অধিকারবিরোধী দমনমূলক আইন ও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(৩) সংস্কারের প্রস্তাব করেছে এনসিপি। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯ অনুচ্ছেদের—মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠনের ‘স্বাধীনতার পরিপন্থী বিবেচনায়’ মৌলিক অধিকারবিরোধী অন্যান্য আইন ও বিধি বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- টেলিযোগাযোগ নজরদারি আইন (যেখানে বিনা পরোয়ানায় ফোন ট্যাপিং সম্ভব); ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, (যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়); জননিরাপত্তা আইনের বিশেষ ক্ষমতাসংক্রান্ত ধারা।
সংস্কার প্রস্তারে আরও রয়েছে-
>> দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠন, যেখানে নিম্ন কক্ষ হবে বর্তমান প্রচলিত সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। আর উচ্চ কক্ষ হবে মূলত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত জাতীয় পরামর্শ ও তদারকি পরিষদ।
>> আস্থা ভোট ও অর্থ বিল অন্যান্য সব বিষয়ে নিজ বিবেক ও মত অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এখন দলের বিপক্ষে সংসদে ভোট দেন বা দলের মনোনীত প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে আস্থাভোটে সমর্থন দেন, তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।
>> ভোটার হওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে ১৬ বছর নির্ধারণ এবং প্রার্থী হওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে ২৩ বছর নির্ধারণ। বর্তমানে ভোটার হওয়ার বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর ও প্রার্থী হওয়ার বয়স ন্যূনতম ২৫ বছর।
>> তথ্য প্রাপ্তি ও ডিজিটাল মাধ্যমে সংযুক্ত থাকার অধিকার বিশেষত ইন্টারনেটকে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিতে বাধ্যবাধকতা।
>> সংসদে নারীদের জন্য ন্যূনতম ১০০টি আসন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নির্ধারিত করতে হবে, যা সংবিধানে বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষিত থাকতে হবে। বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০, যার সবগুলো পরোক্ষভাবে নির্বাচিত, অর্থাৎ মনোনয়ন নির্ভর।
>> কেউ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। পরপর বা ভিন্ন সময়ে—মোট দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না।
>> প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলপ্রধান এই তিন দায়িত্ব আলাদা তিনজন ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।
>> স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানদের বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত করার বিধান চালু।
>> সংসদ সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে আস্থা ভোটে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন না; তবে তারা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ভোট দিতে পারবেন, যদি সেটা সরকারের পতনের সমান না হয়।
>> স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন নিশ্চিতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে কমিশন গঠনের পরিবর্তে, জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদের মাধ্যমে কমিশন গঠন। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে একটি মৌলিক ধারা থাকতে হবে, যেখানে বলা থাকবে, “নির্বাচনী বিষয়ের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত ও বাধ্যতামূলক এবং অন্য কোনো সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।”
>> নির্বাচন কমিশনের কোনো বর্তমান বা সাবেক সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে তা ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ কর্তৃক তদন্তযোগ্য হবে।
>> নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, অরাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘নির্বাচনি সীমানা কমিশন’ গঠন।
>> নির্বাচনী ব্যয় ও আচরণবিধি সংস্কার, টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রচেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা, ঋণখেলাপীদের নির্বাচন অযোগ্যতা, গেজেট প্রকাশের পরও জালিয়াতির প্রমাণ মিললে ফলাফল বাতিল, প্রবাসী ভোটের বিধান।
>> বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন; সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন; প্রধান বিচারপতির জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ; বিচারপতি নিয়োগে জুডিশিয়াল কমিশন ও মেধাভিত্তিক পরীক্ষা; আপিল বিভাগে বিচারপতি পদোন্নতিতে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্ট স্থায়ী আসন স্থাপন।
>> আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যতামূলক নিয়ম চালু।
>> দুদককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দুদকের কাছে দাখিল, রাজনৈতিক অনুদান গ্রহণের উৎসের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, দুদকের রাজনৈতিক অর্থায়ন নিরীক্ষা সেল, দলীয় অনুদান ও ব্যয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ, নির্বাচনী তহবিলের স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং সরকারি ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষমতায় স্বাধীনতা।
>> স্থানীয় সরকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামো; গণপ্রতিনিধিত্বশীলতা এবং স্বশাসন;
সেবা পৌঁছানোর প্রক্রিয়া, নির্বাচনী স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা; প্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের ক্ষমতা, অর্থনৈতিক এবং বাজেট পরিচালনা ও ডিজিটাইজেশন।
>> জনপ্রশাসনের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থার দায়বদ্ধতা ও ডিজিটাইজেশন, নিরপেক্ষ, সময়নিষ্ঠ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ ও পদোন্নতি ব্যবস্থা, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস নামে একক ও আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো গঠন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বদলি ও পদায়ন ব্যবস্থা, ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্য নিরসনে পেশাভিত্তিক কাঠামো ও মেধার ভিত্তিতে নির্ধারণ, স্বাধীন ও সংবিধানসম্মত অভিযোগ নিষ্পত্তি ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, মাঠ ও সচিবালয় পর্যায়ের প্রশাসনের কার্যকর সমন্বয় ও নাগরিক জবাবদিহিতার সাংগঠনিক রূপ, তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্রশাসন এবং জনমুখী প্রশাসন, নাগরিক অংশগ্রহণ ও দায়বদ্ধতা।
এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথরেখা তৈরিতে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের রাজনৈতিক দল এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা সহায়তা করবে।
আলী রিয়াজ বলেন, “আজকের আলোচনায় জাতীয় ঐক্যমতের পক্ষ থেকে প্রস্তাবের পাশাপাশি, জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে যে সমস্ত মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা এসেছে আমরা গ্রহণ করলাম। এটি পর্যালোচনা মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এর একটি প্রতিফলন থাকবে বলে আমরা মনে করি।”
আরও পড়ুন:
ইসিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দায়বদ্ধ করার প্রস্তাব
রাজনৈতিক অনৈক্যে সংস্কারকে 'অনিশ্চয়তায় ফেলা হচ্ছে': এনসিপি
এনসিপির রূপরেখা গণতান্ত্রিক পথরেখায় 'সহায়তা করবে': আলী রীয়াজ