হাতে সময় আর এক সপ্তাহ। এর মধ্যেই আমেরিকার সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে ভারতকে। না হলে বর্ধিত শুল্ক দিতে হবে।
গত কয়েক মাস ধরে সমানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। সেই আলোচনা এখনো চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা ভারতের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছি। এটা অন্য ধরনের চুক্তি হবে। এটা এমন একটা চুক্তি হবে, যেখানে আমরা ভেতরে ঢুকতে পারব। এখন ভারত কাউকে (পণ্যকে) ভেতরে ঢুকতে দেয় না। আমি মনে করি, এবার তারা দেবে। ভারত যদি এবার ঢুকতে দেয়, তাহলে আমরা অনেক কম শুল্ক চালু করে চুক্তি করতে পারব।‘
ট্রাম্প আগেও বলেছেন এবং আবার খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, চুক্তি করতে গেলে আমেরিকাকে ভারতের বাজারে ঢুকতে দিতে হবে। ভারত নিজের দেশের সংস্থা, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে প্রচুর শুল্ক বসিয়ে রেখেছে। আমেরিকা চাইছে, ভারত এই শুল্ক অনেকটা কম করে কৃষি, ডেয়ারি ও নির্দিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে মার্কিন পণ্য ও সংস্থার প্রবেশের পথ প্রশস্ত করুক। না হলে চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে ভারতীয় পণ্যের আমেরিকায় ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়া হবে।
ভারতের সমস্যা
আমেরিকায় এখন ভারতীয় প্রতিনিধিদল মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতা হলেন রাজেশ আগরওয়াল। তার ভারতে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আলোচনা শেষ হয়নি বলে তিনি এখনো থেকে গেছেন।
নিউজউইক পত্রিকাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘খুবই জটিল বাণিজ্য আলোচনা চলছে। আশা করি, আলোচনা সফল হবে। কিছু গিভ অ্যান্ড টেক বা দেয়া-নেয়ার বিষয় থাকবে।‘
ওয়াশিংটন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিচার্ড রসো বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কৃষিক্ষেত্রে ঢুকতে চায়। আর আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারত তাদের কৃষকদের রক্ষা করতে চায়।‘
ওয়াশিংটন চায় ভারত আপেল, বাদাম, জেনেটিক্যৈালি মডিফায়েড (জিএম) শস্যের উপর শুল্ক কমাক। এর ফলে আমেরিকা এসব পণ্য ভারতে রফতানি করতে পারবে। ভারত দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের উপর শুল্ক কম করুক।
সূত্র জানাচ্ছে, ভারত চাইছে, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য ও জিএম শস্যকে বাদ রেখে এখন চুক্তি হোক। কিন্তু আমেরিকা চাইছে, ভারত তাদের পণ্য ঢোকার সুযোগ করে দিয়ে শুল্ক কম করুক। বিনিময়ে আমেরিকাও ভারতীয় পণ্য যাতে আরো বেশি করে সেদেশে ঢুকতে পারে, সেজন্য শুল্ক কম করবে। ট্রাম্প যে কম শুল্ক চালু করার জন্য চুক্তির কথা বলেছেন, তার মূল সূত্র এটাই।
ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা এবং কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার বলেছেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে শুল্ক কম করা হলে ভারতের কৃষকরা তো অসুবিধায় পড়বেনই।‘
কৃষি বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হরবীর সিং বলেছেন, ‘আমেরিকার কৃষকদের সাথে ভারতের কৃষকদের কোনো তুলনা হয় না। আমেরিকায় ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষক এবং ভারতের কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি, যাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ ছোট ও মাঝারি কৃষক। ফলে তাদের সুরক্ষা প্রয়োজন। আমেরিকায় সরকার বিভিন্নভাবে কৃষকদের ভর্তুকি দেয়। তাদের ভর্তুকির পরিমাণ ভারতের কৃষকদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই আমেরিকার ও ভারতীয় কৃষকদের কোনো তুলনা হয় না। ভারতীয় কৃষকদের আমরা বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।‘
দ্য সেক্রেটারিয়েটের সম্পাদক এবং দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা করা জয়ন্ত রায়চৌধুরী বলেছেন, ‘কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভারত শুল্ক কমাবে। কিন্তু চাল-গমের মতো খাদ্যশস্যের উপর নয়। তেমনই ডেয়ারির ক্ষেত্রে স্পেশালাইজড চিজের মতো কিছু পণ্যে শুল্ক কমবে। কিন্তু বাকি পণ্যে কমার সম্ভাবনা কম।‘
রাজনৈতিক প্রভাব
হরবীর মনে করেন, ‘কৃষি ও ডেয়ারিতে শুল্ক প্রচুর কম করলে একটা ধারণা তৈরি হবে, সরকার কৃষক-বিরোধী কাজ করেছে। ডেয়ারির সাথেও আট কোটি মানুষ জড়িত। পেস্তা, হ্যাজেলনাট, অ্যামন্ড আমরা প্রচুর পরিমাণে আমদানি করছি। আমেরিকা আপেলের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমাতে বলেছে। তারা সোয়াবিন ও কর্ন ঢালাও রফতানি করতে চায়। তাদের কৃষকদের ভারতের বাজার দরকার। তাদের সব দাবি মেনে নিলে ভারতে রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়বে শাসক দল।‘
জয়ন্তও বলছেন, ‘কৃষি ও ডেয়ারিতে আমেরিকার সব দাবি মানতে হলে রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হবে। সেটা সরকার চাইবে না। আবার আমেরিকার সাথে বাণিজ্য চালু রাখাটা জরুরি। তাই কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে অনড় থেকে পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে ভারত।‘
সেজন্যই এই বাণিজ্য চুক্তি, শুল্ক নিয়ে আলোচনা একটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে