করের বোঝা কোথায়, কীভাবে চাপানো হবে, সেটা না ভেবে যদি নিত্যপণ্যের ওপর সরাসরি ভ্যাট-শুল্ক চাপানো হয়, তা গরিবের পাতে লাথি দেওয়ার মতো হবে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

করের বোঝা কোথায়, কীভাবে চাপানো হবে, সেটা না ভেবে যদি নিত্যপণ্যের ওপর সরাসরি ভ্যাট-শুল্ক চাপানো হয়, তা গরিবের পাতে লাথি দেওয়ার মতো হবে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

বছর চারেক আগের কথা। রাতে ওষুধ কিনতে বেরিয়ে, একই রিকশায় ফিরছিলাম বাসার কাছেই এক ওষুধের দোকান থেকে। চড়া গলায় ডেকে রিকশা থামাল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু। একই এলাকায় থাকি আমরা, তাই মাঝেমধ্যে দেখা হলেই থেমে একটু গল্প করা হয়। তো সেদিন থামিয়েই খানিক আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “কিহে, বিপ্লব-টিপ্লব আর হইব-টইব না?” ছাত্রজীবনে একাগ্র বাম-রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার কারণে আমাকে মাঝেমধ্যেই এমন আক্রমণাত্মক প্রশ্ন ছুড়ে মারে বন্ধুটি। আমার খানিক তাড়া ছিল। তাই বললাম, “তাড়া আছে”, সংক্ষেপে জবাব দিই—“হইব না। কিন্তু ক্যান হইব না জিগাবি তো? এক মিনিট সময় দে বলছি।”

এবার আমি রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ভাই, আপনারে দুইটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে কইরেন না। সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েন।”

তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার বাসায় টেলিভিশন আছে?”

সলজ্জ হাসি দিয়ে রিকশাওয়ালা জবাব দিলেন, “হ, আছে।”

বললাম, “রঙিন?”

বললেন, “জি।”

“আপনের কি মনে মনে ইচ্ছা আছে, ট্যাকা জমায়া এট্টু বড়ো আরেকটা টেলিভিশন কিনবেন সামনে?”

সম্মতিসূচক সলজ্জ হাসি দিলেন রিকশাওয়ালা।

বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “সুতরাং একদিনের কামাই রোজগার বাদ দিয়ে হরতাল আন্দোলনে যাওয়ার চেয়ে, না যাওয়াই শ্রমজীবী মানুষের আজকের ইচ্ছা। পুঁজিবাদের আধিপত্যে আমরা যখন এমন প্লাবনের জোরে ভাসছি, তখন নিজের স্বার্থ ছাড় দিয়ে কেউ রাজপথে সহসা আসবে না।”

হ্যাঁ, পুঁজির প্রসারে গ্রামেগঞ্জেও আপনি কোক ফান্টা, কাপ কেক, কফি, বিদেশি শ্যাম্পু, ডাভ সাবান– সবই পাবেন। আমার গ্রামের বাজার নয়, পথের মাঝে অকস্মাৎ যে মুদি দোকানটা আছে, এরোসল স্প্রে চাইলে সেখানেও সেটা পাবেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা পরোক্ষভাবে অর্থনীতির চাকা সচলতর করেছে। তবে করের চাপ গরিবের পাতে এসে লাথি দেয় এবং বিলাসিতায় ছাড় মেলে তখন রাষ্ট্র-রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

আজ সকালে আপনি যে বিশ টাকার নোটটা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে দিনের সূচনা করলেন, সেই নোটটা রাত নামার আগে কারো পকেটে দিনের দৌড় শেষ করবে, তার আগেই হয়তো কুড়িবার বা অর্ধশতবার হাতবদল হবে। যতবার হাত বদল হবে, ততবারই এই নোটটা কাউকে না কাউকে কুড়ি টাকার সেবা বা পণ্যের উপযোগিতা দেবে। আবার কুড়ি টাকার চাহিদা তৈরি করবে, যার ফলে অর্থনীতিতে তথা জিডিপিতে বারবার অবদান রাখবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং তার সঙ্গে যদি মুদ্রাস্ফীতি যোগ হয়, তাহলে মানুষের ব্যয়ক্ষমতা যেমন হ্রাস পায়, তেমনি ব্যয়ের মানসিকতাও সংকুচিত হয়। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কুড়ি টাকার আলু যখন ষাট, আশি বা একশো টাকায় কিনতে হয়, তখন নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত নয়—গোটা মধ্যবিত্তকেও হিমশিম খেতে হয় আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে।

এমন পরিস্থিতিতে একবেলার পরিপূর্ণ আহারের ইচ্ছেটুকু বলি দিয়ে মানুষকে বনরুটি-কলায় দিন গুজরান করতে হয়। কখনো বা একেবারেই না খেয়ে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু জরিপে এই ভয়াবহ চিত্রই উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ২০২২ সালের ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ২২.৯ শতাংশে। দৈনিক ২.১৫ ডলারের কম আয়ের মানুষের হার দ্বিগুণ হয়ে হয়েছে ৯.৩ শতাংশ, অর্থাৎ আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে এই নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বিঘ্নিত হয়ে বিশাল জনগোষ্ঠী চাকরিহীন হয়েছে, যাদের অনেকেই নারী শ্রমিক।

এই পরিস্থিতিতে কয়েক বছর আগে ৫ টাকায় যে বনরুটি খেয়ে কেউ মোটামুটি খিদে মেটাতে পারত, সেটাই এখন কিনতে লাগে ১০–১২ টাকা। তার ওপর আকারে তা আগের চেয়ে ছোট। এককাপ চা যেখানে ৫–৭ টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা ১০–১২ টাকা। ঢাকার শ্রমজীবীরা বলেছেন, তিন বছর আগে ১০–১২ টাকায় সকালের নাশতা সারা যেত; এখন তার জন্য কমপক্ষে ২০ টাকা লাগে।

এই পরিবর্তনের গতি ও গভীরতা তুলে ধরেছে ‘ইউথ পলিসি নেটওয়ার্ক’ পরিচালিত একটি জরিপ। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১০২২ জন মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে তারা পেয়েছে—৯৯ শতাংশ মানুষ দিনে কোনো না কোনো এক বেলা ভারী খাবার বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন অর্থাভাবে। তার ওপর কম দামে খাওয়ার জন্য যে বিস্কুট-পাউরুটি পাওয়া যেত, সেগুলোর দামও বেড়েছে, আকার হয়েছে ছোট। এর পেছনে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি কাজ করছে।

বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অতিভারাক্রান্ত, রপ্তানি হুমকির মুখে থাকা, প্রবাসী আয়ে ওঠানামা করা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত এক দেশের জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানো যৌক্তিক হতে পারে। কিন্তু কর বাড়ানোর বোঝা কোথায়, কীভাবে চাপানো হবে, সেটা না ভেবে যদি নিত্যপণ্যের ওপর সরাসরি ভ্যাট-শুল্ক চাপানো হয়, তাহলে করদাতার সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত কর আদায় বাড়ে না। বরং এর ফলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এক অসম সহিংসতা ঘটে যায়—যা শুধু কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং অর্থনীতি ও সমাজকে আরও বড় সংকটে ঠেলে দেয়। এতে শ্রমশক্তির স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা, সামাজিক স্থিতি এবং অপরাধ পরিস্থিতিও ঝুঁকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্রযন্ত্র এই চাপে হিমশিম খেতে থাকে।

অথচ, সব পণ্যের ওপর একতরফা ভ্যাট বা শুল্ক বসিয়ে না দিয়ে শ্রেণিভিত্তিক বণ্টন ও চাহিদার ধরন বিবেচনায় কর কাঠামো সাজানো যেত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাদ দিয়ে বিলাসপণ্য, অপ্রয়োজনীয় সেবা, উচ্চবিত্ত বাজারের পণ্যের ওপর আলাদা কর চাপানো সম্ভব। যেমন, একই পণ্য সাধারণ হাটে এক দামে বিক্রি হলেও সুপারশপে উঠলেই সেই পণ্যে অতিরিক্ত কর আরোপ করা যায়। আবার বাজার নিয়ন্ত্রণে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করাও দরকার। এই পদক্ষেপগুলো নিলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনতি কিছুটা হলেও ঠেকানো যেত।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা ছিল দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা। রমজানে কিছুটা চেষ্টা দেখা গেলেও তাতে সদিচ্ছার চেয়ে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি লক্ষণীয় ছিল—যার ফলে লাগাম টানার সেই প্রক্রিয়া অল্পেই থেমে গেল।

লাগাম না টেনে, বরং পরোক্ষ করের মাধ্যমে ভুল জায়গায় চাপ সৃষ্টি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সরকার জনজীবনের কষ্ট আরও বাড়িয়েছে। পক্ষপাতদুষ্টতা ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি উপেক্ষা করে এই সরকারের পক্ষেই সম্ভব ছিল কল্যাণমুখী বাজার সংস্কার। কিন্তু মনোযোগ ঠিক জায়গায় না থাকায় কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না।

এমন পরিস্থিতিতে আঘাতপ্রাপ্ত জনসাধারণ যখন-তখন সরকারের ওপর আস্থা হারাতে পারে—যা ভবিষ্যতে আরও জটিল সংকটের জন্ম দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদ মানুষের ভোগকেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষাকে শোষণের হাতিয়ার বানায়। কিন্তু সেই মানুষগুলোই যদি একদিন মরিয়া হয়ে ওঠে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়াও ভয়ানক হতে পারে।

এমন বাস্তবতায় শুধু সরকার নয়, সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সব গোষ্ঠীরই দায়িত্ব শ্রমজীবী ও স্বল্পআয়ের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। সময় থাকতে থাকতে নিত্যপণ্যের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সামনে কোনো আর্থ-সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোলা থাকবে না।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews