করোনার মহাসংকটে প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো ব্রাজিলের সিনিয়র সিটিজেনদের মৃত্যুতে মোটেও বিব্রত বা মর্মাহত নন। বরং তিনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। উৎফুল্লও বটে। বয়স্করা পরলোকে চলে গেলে রাষ্ট্রের আর্থিক সাশ্রয় হবে, পেনশন দিতে হবে না, এমনটাই দাবি করেছেন তিনি। কী বিস্ময়কর, ভয়ংকর, নির্মম, নিষ্ঠুর মন্তব্য এক রাষ্ট্রনায়কের। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ধরনের শাসকেরা দেশ ও নাগরিকদের চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেন। রাষ্ট্রের পরিচয় ও চরিত্র বদল ফেলেন।

নির্বাচনে জিতে বোলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, এক ভয়ংকর ভোরের দিকে যাত্রা শুরু হলো ব্রাজিলের, যা রাতের থেকেও অন্ধকার। বোলসোনোরোর কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণও মিলছে। তিনি কখনোই করোনা মোকাবিলায় আগ্রহী ছিলেন না। বরং তিনি বিভিন্ন উদ্ভট ও গণবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে পুরো ব্রাজিলকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছেন। তিনি শুরু থেকেই লকডাউনের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর কাছে জীবনের থেকে ডলারের মূল্য বেশি।

করোনা মোকাবিলায় বোলসোনারোর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অদ্ভুত মিল রয়েছে। দুজনই পপুলার ভোটে জিতে এসেছেন। উভয়েই বড় ব্যবসায়ীদের প্রিয়পাত্র। উভয়েই লকডাউনের বিপক্ষে।

শুরু থেকেই ট্রাম্প ও বোলসোনারো বলার চেষ্টা করলেন, এর জন্য চীন দায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দায়িত্ব পালন করতে পারছে না, হু চীনের পক্ষে কাজ করছে প্রভৃতি। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের দেশ তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়েই গেল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন না। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু রোধের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এটা ট্রাম্পের পুরোনো কৌশল। ওই সময়ও বোলসোনারো ট্রাম্পের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন। এখনো একই সঙ্গে আছেন। তাঁরা টোটকা ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। বোলসোনারোও তাঁর সমর্থকদের এই ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার চিকিৎসায় হাইড্রোক্লোরোকুইন নিষিদ্ধ করেছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এই ওষুধের ব্যবহারে রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু এই ওষুধ ব্যবহার করে যাঁরা পরলোকে চলে গেলেন? বোলসোনারো ও ট্রাম্প কি এর দায়িত্ব নেবেন? তাঁদের বিরুদ্ধে কি পরিকল্পিত গণহত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হবে?

জার্মানি, ভিয়েতনাম, জাপান, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, কিউবা, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র করোনার বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ে লিপ্ত। অধিকাংশ রাষ্ট্রই নাগরিকের প্রতি দায়িত্ব পালনে জেরবার। কিন্তু বোলসোনারো ও ট্রাম্প কখনোই নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে চাননি। তাঁদের আচরণ দেখে কখনোই মনে হবে না করোনা মানবসভ্যতার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়। বরং কখনো তাঁদের কীর্তিকলাপ দেখে মনে হয়েছে ওনারা ঠাট্টা-তামাশায় লিপ্ত। শুরু থেকেই এমন সব অমিয় বচন এই দুই রাজনীতিবিদ ছেড়েছেন, যা দেখে সবার চোখ মাথায় উঠেছে। কিন্তু বাগাড়ম্বর দিয়ে তো দেশের নাগরিকদের রক্ষা করতে পারেননি।

করোনা দুটি দিক আমাদের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে। একটি হচ্ছে মানবিকতার জয়। নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীরা আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরাও। সারা বিশ্বেই অনেক স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মী মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এর পরও তাঁরা পিছু হটেননি। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় নতুন নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে বরং দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এখনো এই লড়াই অব্যাহত আছে। এই লড়াই মানুষের পক্ষে লড়াই, টিকে থাকার লড়াই। ওদিকে বোলসোনারো ও ট্রাম্পের মতো নেতারা দাঁড়িয়ে গেছেন মানুষের বিপক্ষে। তাঁদের গা-ছাড়া ভাব ও দায়িত্বহীনতা ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের চরম অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। রিওয়ের বস্তি থেকে আমাজনের গহিন অরণ্যেও করোনার বিস্তার ঘটেছে। সাও পাওলো এখন পশ্চিমের সব থেকে বড় মহামারির এলাকা। নিউইয়র্কের অবস্থাও একই। ব্রাজিল আর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সব থেকে বৃহৎ সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। কফিন তৈরি করতে করতে সেখানকার শ্রমিকেরা এখন ক্লান্ত।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল মিলে চীনকে দায়ী করছে। আরও অনেকেই চীনকে দায়ী করছে। চীনের দায় থাকতেই পারে। কিন্তু কে দায়ী, কীভাবে দায়ী এসব বিশ্লেষণের পাশাপাশি নিজেদের রক্ষা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল বেমালুম এটা ভুলে গিয়ে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ট্রাম্প সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে করে কি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উপকার হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো বন্ধ রাখেনি। অভিযোগ রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে জোর করে ফেরত পাঠানো অভিবাসীরা ইকুয়েডরে করোনার বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন।

ট্রাম্প ও বোলসোনারো ভিন্ন দুই দেশে একই প্রতিচ্ছবি। কার্যত অনেক রাষ্ট্রই আর এখন জনগণের পরোয়া করে না। করোনা মহামারিতে বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে। লোকরঞ্জনবাদের ধোঁয়া তুলে রাষ্ট্রকে কিছু শ্রেণি লুট করে নিয়েছে। এরা নাগরিককে মেরে-কেটে ধ্বংস করে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ অবলম্বন করে। এই রাজনৈতিক শ্রেণির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠলে প্রতিবাদী জনতার গায়ে লুটের কলঙ্ক এঁকে দেওয়ার চেষ্টা চলে। যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, সহিংসতা, গণবিক্ষোভের সঙ্গে করোনার কোনো সম্পর্ক একেবারে নেই, তা বলা যায় না। এই বিক্ষোভ করোনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিবাদ। এই বিক্ষোভ শুধু জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনকে হত্যার প্রতিবাদ না, এটা নির্দয় ও অযোগ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews