বাণিজ্য ও কর আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এনবিআরের সংস্কার নিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্যোগে সরকার ও এনবিআরের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের ইঙ্গিত মিলছে।
বাণিজ্য ও কর আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এনবিআরের সংস্কার নিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্যোগে সরকার ও এনবিআরের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের ইঙ্গিত মিলছে।
সংস্কার অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা পদক্ষেপ ও কর্মসূচির জেরে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনের পথে এখন স্বস্তির ইঙ্গিত মিলছে। এই অচলাবস্থা দূর করতে সম্প্রতি ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির এগিয়ে আসা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
১২ মে থেকে দফায় দফায় চলমান এই সংকট নিরসনে সরকার ও এনবিআর—এই দুই মূল পক্ষের পাশাপাশি অংশীজন হিসেবে তৃতীয়পক্ষ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সক্রিয় সংযুক্তি এখন অনেকের কাছেই কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গত সপ্তাহে এনবিআর সংস্কার অধ্যাদেশ ঘোষণা ঘিরে ঐকমত্যের অভাবে পুনরায় কলম বিরতি শুরু হয়। সপ্তাহের শেষে লাগাতার কলম বিরতি কর্মসূচিতে দেশে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। উদ্ভুত পরিস্থিতি ঘিরে অর্থ উপদেষ্টা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন এবং আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে দ্রুত আলাপে বসার বদলে পূর্বনির্ধারিত আলাপও স্থগিত করেন।
এই অচলাবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসেন দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী চেম্বারের নেতৃবৃন্দ। গত কয়েক দিনে চেম্বারগুলোর সভা ও বক্তব্যে ব্যবসায়ী নেতারা সরকারের রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ পৃথকীকরণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।
তারা অভিমত দেন, এনবিআরের প্রস্তাবিত সংস্কারে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা—উভয় বিভাগেই প্রশাসন বা অন্য কোনো ক্যাডারের বদলে এনবিআরের নিজস্ব জনবল, অর্থাৎ কাস্টমস ও কর ক্যাডার থেকেই নিয়োগ দেওয়া উচিত। এতে সংশ্লিষ্ট খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন, যা কার্যক্রমগুলো আরও সুচারুভাবে পরিচালনায় সহায়ক হবে।
গত রোববার অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এক আলোচনা সভায় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ তাদের পূর্বের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তারা স্পষ্ট বলে দেন, এনবিআরের অপসারণসংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব তারা সমর্থন করেন না; তবে এনবিআরের বিশেষায়িত কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রশাসন বা অন্য কোনো ক্যাডারের চেয়ে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞ জনবল—বিশেষত কাস্টমস ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তারাই অধিক উপযুক্ত।
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা এই মতামত স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টার কাছে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, সহসভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, মেট্রো চেম্বারের সভাপতি কামরান টি রহমান এবং সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের গ্রুপ সিইও সিমিন রহমান।
বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন।
গত রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত-সংক্রান্ত কার্যবিবরণিতে জানানো হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান সংকট দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটির সভাপতিত্ব করবেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। সদস্য হিসেবে থাকবেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, শ্রম ও কর্মসংস্থান, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা।
একইসঙ্গে, জনস্বার্থে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট ও শুল্ক স্টেশনের সব শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী মহলের আলাপ ও প্রস্তাবনা সূত্রে এইদিন, ২৯ জুন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এনবিআরের বিদ্যমান সংকট (সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলন) দ্রুত সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে কমিটি করা হলো। এই কমিটি গঠন করার আলোকে একটি সিদ্ধান্তও জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
তবে পরদিন, সোমবার, মন্ত্রিপরিষদের জারি করা প্রজ্ঞাপন ও তার আগের দিন উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের কার্যপরিধির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য দেখা যায়নি।
যদিও এনবিআরের চলমান সংকট নিরসনে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, গেজেটে উল্লিখিত সেই কমিটির দায়িত্ব একেবারেই ভিন্ন। সেখানে বলা হয়েছে—কমিটি ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, বন্দর ও রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবে এবং সেসবকে অধিকতর গতিশীল করতে সুপারিশ দেবে।
কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কমিটির কাজ হওয়ার কথা ছিল—এনবিআরের প্রস্তাবিত সংস্কার নিয়ে বিরোধ কেন তৈরি হলো, কেন এনবিআরের কর্মকর্তারা আন্দোলনে গেলেন, এবং সংস্কার কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে, তা নিরূপণ করা।
এই প্রজ্ঞাপন ও সিদ্ধান্তের অসামঞ্জস্যতায় এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এমন অসঙ্গতি আসলে কার্যকর সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত দেয়, যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে এবং সমাধানকে দীর্ঘায়িত করছে।
এনবিআরের বর্তমান সংকটের অনেক আগে, গত বছরের অক্টোবর মাসে এনবিআর সংস্কার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সদস্য হিসেবে ছিলেন আরও চার সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা— নাসিরউদ্দিন আহমেদ, দেলোয়ার হোসেন, ফরিদ উদ্দিন ও আমিনুর রহমান।
এই পরামর্শক কমিটি এনবিআর ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের প্রস্তাবের পক্ষে সুপারিশ করে। তারা যে রিপোর্ট ও সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞ জনবল—অর্থাৎ এনবিআরের কাস্টমস ও কর ক্যাডার থেকেই নিয়োগের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
তবে এই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি, যদিও বিগত সময়ে গঠিত অন্যান্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের রাজস্ব কাঠামো সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পরামর্শ দিয়ে আসছে। সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব আহরণে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম পৃথক করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই প্রক্রিয়া কীভাবে বাস্তবায়ন করলে তা সবচেয়ে কার্যকর হবে, তা নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রাক্তন কর্মকর্তাদের নিয়েই এই পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
পরামর্শক কমিটির প্রস্তাবনাগুলোর মতোই সম্প্রতি গৃহীত আরও কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ দমনমূলক নীতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আন্দোলন বন্ধে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এনবিআরকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সেবা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালায় প্রাপ্য সময়সীমা না মেনে জরুরিভিত্তিতে বদলির আদেশও জারি হয়েছে—যা নিয়েও দমননীতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
এছাড়া ঠিক এই সময়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুই সদস্যসহ পাচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করেছে। এই সব যুগপৎ পদক্ষেপ এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে অনেকে এনবিআরের আন্দোলনকারীদের চাপে রাখার কৌশল হিসেবেই দেখছেন।
তবে ইতিবাচক দিক হলো, অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি সকলকে নিয়মিতভাবে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে কাউকে শাস্তির মুখে না ফেলার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
আরও আশার কথা হলো, গত সপ্তাহান্তে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বার নেতৃবৃন্দ এগিয়ে এসে সরকারপক্ষ ও এনবিআর—উভয়ের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করেন। এর ফলে অচলাবস্থা কাটিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতিতে ইতিবাচক অগ্রগতির সূচনা হয়।
ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, এনবিআর সংস্কার অধ্যাদেশ ঘিরে তৈরি হওয়া সংকটের মূল কারণ হলো উপদেষ্টা পরিষদ ও এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পর্যাপ্ত সংযোগের অভাব। তারা এও আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সংকট ঘনীভূত করার পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থাকতে পারে।
উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা শেষে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে সরাসরি ও খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের সংকটের দ্রুত ও টেকসই সমাধান সম্ভব।
সংকট নিরসনের জন্য গঠিত কমিটি ও পরবর্তী দিনে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা এবং একই সময়ে গৃহীত অন্যান্য কঠোর পদক্ষেপ ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সব মহলকে আবারও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
তবে, সংস্কারের মূল বিষয়ে কোনো পক্ষের দ্বিমত না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে, এমন অসামঞ্জস্যতা থেকে উদ্ভূত যাবতীয় সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে উভয় পক্ষের সরাসরি আলাপ-আলোচনা জরুরি। এছাড়া, প্রাক্তন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ও পরামর্শ আলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেও সমস্যার সমাধান সম্ভব।
সব মিলিয়ে, সবাই আশা করেন, রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ নতুন বিন্যাসে আরও গতিশীল ও কার্যকর হবে।