দেশে রাস্তাঘাটে বেড়ে ওঠা শিশুদের বেশির ভাগেরই তিন বেলা খাবার, মাথার ওপর ছাউনি, কিংবা গায়ের কাপড়ের নিশ্চয়তা নেই। এসব শিশু অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, সহিংসতাসহ নানা বঞ্চনার শিকার। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, মুক্ত জায়গা কিংবা রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে রাত কাটে তাদের।
‘দ্য কোয়ালিটি স্টাডি অন চিলড্রেন লিভিং ইন স্ট্রিট সিচুয়েশনস ইন বাংলাদেশ ২০২৪’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে। তারা দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পথশিশুদের প্রতি ১০ জনের ৮ জনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতনের বা হয়রানির শিকার হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২ অক্টোবর পালিত হচ্ছে জাতীয় পথশিশু দিবস।
বেসরকারি সংস্থা জুম বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এস টি শাহীন প্রধান বলেন, রাজধানীর কমলাপুর, সদরঘাট, গুলিস্তান, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। এই
সংস্থার তালিকাভুক্ত ১২ বছর বয়সী আরিফা
জানায়, ক্ষুধা না লাগলে কারও কাছে সে হাত পাতে না। কারণ, খাবার চাইলেই লোকজন থাপ্পড় মারতে আসে।
১৫ বছর বয়সী রহমান বলে, ‘আমরা রাস্তাঘাটে থাকি বইলা আমাদের সঙ্গে লোকজন বাজে আচরণ করে। এতে অনেক কষ্ট পাই। রেলস্টেশনে ঘুমানোর চেষ্টা করলে অনেকেই আমাদের দিকে পানি ছুড়ে মারে। তারা আমাদের অপমানজনক নামে ডাকে।’
সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২ প্রতিবেদনে রাস্তাঘাটে বসবাসকারী শিশুর মোট সংখ্যা না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলেন, পথশিশু ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। তাদের ৮২ শতাংশই ছেলে। তাদের বেশির ভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ এতিম অথবা বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা তা তাদের জানা নেই। এই শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন ঘর থেকে বঞ্চিত। তারা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায় শুধু একটি পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরো বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে। পথশিশুদের প্রতি সহিংসতার প্রতি তিনটি ঘটনার একটি (৩০ দশমিক ৪ শতাংশ) রাতে তাদের ঘুমের সময় ঘটে থাকে।
যৌন নির্যাতনের শিকার পথশিশুরা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এনজিওকর্মী জানান, রাজধানীর মিরপুর শাহ আলী মাজার প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুরা রাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কুলি, নৈশপ্রহরী, এলাকার বখাটে-মাস্তানদের দ্বারা পথশিশু ছেলে ও মেয়ে উভয়ই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়ে পথশিশুরা রাস্তাঘাটে বিচরণকারী নানা মানুষের কুনজরে পড়ে। অনেক শিশুকে কৌশলে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বেসরকারি সংগঠন পথবাসী সেবাকেন্দ্র (সাজেদা ফাউন্ডেশন) জানায়, যৌন নিপীড়নের শিকার ১৩ হাজারেরও অধিক পথশিশুকে সেবা দিয়েছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ চাইল্ড হেল্প লাইন ১০৯৮
সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘বাংলাদেশ চাইল্ড হেল্প লাইন ১০৯৮’-এর মাধ্যমে সরাসরি শিশুদের সেবার আওতায় নিয়ে আসছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ৪৭ হাজারেরও বেশি শিশু এই হেল্প লাইন থেকে সেবা গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৯০০ পথশিশু তাদের সমস্যা জানায় এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করে। এই হেল্প লাইনের ব্যবস্থাপক চোধুরী মো. মোহায়মেন সমকালকে বলেন, শিশুরা পথে জন্মায় না। তারা নানা কারণে পথে আসে। পারিবারিক ও ভৌগোলিক কারণেই বেশি শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা দেশের বিভিন্ন শহরে (যেখানে মানুষের আনাগোনা বেশি) অবস্থান নেয় এবং টিকে থাকার চেষ্টা করে। মুনাফালোভী একশ্রেণির মানুষ পথশিশুদের বিপথগামী করে। তিনি জানান, পথশিশুদের সুরক্ষায় করোনাকাল থেকে তৎকালীন সরকার ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ‘চাইল্ড প্রটেকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় হাব চালু করে। পথশিশুদের সুরক্ষায় হাবের সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। মানুষের মধ্যে পথশিশুদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।