ড. এম আবদুল আজিজ

মরহুম শাহ্ আবদুল হান্নান এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। তার সান্নিধ্যে যে-ই এসেছে, সে-ই তার দর্শন ও চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছে। তার সাথে যাদের নিবিড় যোগাযোগ হয়েছে, তাদের সবারই তার কর্ম ও জীবন সম্পর্কে ব্যক্তিগত অনুভূতি অসাধারণ, অভিজ্ঞতাও ব্যতিক্রমী। তিনি ইসলামী জ্ঞানচর্চায় এক স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৩৯ সালের ১ জানুয়ারি তার জন্ম। ২০২১ সালের ২ জুন ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আজ ২ জুন তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

১৯৮৮-১৯৮৯ সালে তার সাথে প্রথম দেখা হয়। তাকে পেয়েছি সত্যিকারের অভিভাবক হিসেবে, আদর্শ শিক্ষক হিসেবে, সর্বোপরি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তি হিসেবে।

কুরআন অনুধাবনে তিনি ছিলেন অগ্রসর। নারীর ভূমিকার ব্যাপারে নবতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। সমাজ কতটুকু স্পেস নারীদের দিচ্ছে আর কতটুকু দেয়া উচিত এবং নারীর পেশা ও কর্র্মস্থল, সম্পত্তি বণ্টন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পোশাকের ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষিত সমাজের বিতণ্ডা কিভাবে নিরসন করা যায়- এসব ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, বলেছেন। সামাজিক কাজে ও ইসলামের শিক্ষা প্রচারে নারীদের সম্পৃক্তকরণে সমাজে দৃষ্টিভঙ্গিজাত সমস্যার সমাধানের পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন।

শাহ্ আবদুল হান্নান ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুহাম্মদ আসাদের বিখ্যাত তাফসির ‘দ্য মেসেজ অব দ্য কুরআন’ সব মহলে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আসাদের তাফসিরকে উইমেন ফ্রেন্ডলি তাফসির মনে করা হয়। একই সাথে তিনি ড. আব্দুল হামিদ আবু শুককাহর ‘রাসূলের যুগে নারী স্বাধীনতা’ বইটি বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশ এবং তা সব মহলে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেন।

মুক্তচিন্তা ও মধ্যমপন্থার প্রচারে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। সমসাময়িক ইস্যুতে ইসলামের যুগোপযোগী ব্যাখ্যার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সরব। মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি এটা করতেন এবং দেশের শীর্ষ আলেম সমাজ তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করত। বায়তুল মোকাররমের খতিব ওবায়দুল হকসহ শীর্ষ আলেমদের সাথে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে শাহ্ আবদুল হান্নান নিয়মিত আলাপ-আলোচনা করতেন।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ মওলানা আকরাম খান রচিত ‘তরজমায়ে কুরআন মাজিদ’ থেকে তার তত্ত¡াবধানে একটা টিম নির্দিষ্ট কিছু বিষয় চিহ্নিত করে, যেসব বিষয়ে লেখকের চিন্তাধারা অনন্য। শাহ্ আবদুল হান্নান মওলানার এসব দৃষ্টিভঙ্গি তার লেখনীর মাধ্যমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেন।

প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি দেশ-বিদেশের স্কলারদের মতামত পাশাপাশি তুলে ধরেন। সব ক্ষেত্রে মধ্যপন্থাকে- আল ওয়াসাতিয়াহ অনুসরণ করতেন।

শাহ্ আবদুল হান্নানের মাধ্যমেই বহু যুবক-কিশোর হাদিসের সনদ-মতন সম্বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি ‘সহিহ’ ও ‘জয়িফ’ হাদিস নিরূপণ পদ্ধতি। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের ভরসাস্থল ছিলেন শাহ্ আবদুল হান্নান।

হাশিম কামেলীর ‘প্রিন্সিপলস অফ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’ এবং ত্বাহা জাবির আল-আওয়ানী ও ইমাদ দীন খালিলের ‘দ্য কুরআন অ্যান্ড দ্য সুন্নাহ : দ্য টাইম-স্পেস ফ্যাক্টর’ বই দু’টিকে ‘ইসলামী আইনের মূলনীতি’ এবং ‘কুরআন ও সুন্নাহ : স্থান-কাল পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে বাংলায় অনুবাদ করিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। একই সাথে ‘ইসলামী উসূলে ফিকহ্’ নামে বাংলা ও ইংরেজিতে একটি বই রচনা করেন, যা আধুনিক ও ইসলামী উভয় ধারার লোকদের কুরআন, সুন্নাহ ও শরিয়াহ বুঝতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

উদাহরণস্বরূপ, নবীজীর সাথে বিবি আয়েশার বিয়ের বয়স নিয়ে যে বিভ্রান্তি এবং এ অভিযোগের মাধ্যমে রাসূলকে হেয় করার যে প্রচেষ্টা, আদিল সালেহীর লেখা ‘মুহাম্মদ (সা.) : ম্যান অ্যান্ড প্রফেট’ গ্রন্থের ‘আয়েশার বিবাহ এবং তাঁর বয়স’ অংশটি অনুবাদ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে তিনি এ অভিযোগের অপনোদন করেন।

বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে পাশ্চাত্যের দর্শন যেভাবে পড়ানো হয়, ইসলামী দর্শন সেভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। শাহ্ আবদুল হান্নানের অবদান হচ্ছে, বিকল্প পাঠ্যক্রম তৈরি করা, টেক্সটবুক প্রস্তুত করা, রেফারেন্স বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করা এবং এর ভিত্তিতে পাঠদান করা।

তার লেখা ‘শিক্ষা, ধর্ম ও সেক্যুলারিজম’ প্রবন্ধটির হাজার হাজার কপি তিনি নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিতরণ করেন। ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তা, ইতিহাস, ইসলামী সভ্যতা, দর্শন, সংস্কৃতি ইসলামের নৈতিকতা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গ্লোবাল স্টাডিজ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর স্টাডি সার্কেল পরিচালনা করেন। এর মধ্যেই জীবনের সুখ ও সার্থকতা খুঁজে পেতেন।

কিশোর-যুবকদের কল্যাণকর কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছিল উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রতিটি ইস্যুতে ওয়েস্টার্ন ন্যারেটিভসের বিপরীতে কাউন্টার ন্যারেটিভস নিয়ে তিনি সহজ সরল ভাষায় প্রবন্ধ লিখেন, ছাপার ব্যবস্থা করেন এবং হাজার হাজার কপি জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন। জ্ঞান আহরণের জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি সক্ষম হন।

সুদভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা, ইসলামী ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা, কর্জে হাসানা, দাতব্য সমাজকর্ম উৎসাহিত করা, ওয়াক্ফ জনপ্রিয় করা, এসব ছিল তার জীবনের ব্রত।

শাহ্ আবদুল হান্নান মনে করতেন, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে সক্ষম নেতৃত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে তিনি অনেক ইসলামী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মানারাত ইউনিভার্সিটি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ও ঢাকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

অর্থনীতির ইসলামীকরণে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ইসলামী ব্যাংক কনসালটেটিভ ফোরাম, সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, ইসলামী ব্যাংক টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, মুসলিম এইড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গবেষণা ও থিংক ট্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট, ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, ইসলামিক ল রিসার্চ কাউন্সিল অ্যান্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ, সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

১৯৮৩ সালে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (আইআইআইটি)। মুসলিম স্কলার ও চিন্তাবিদদের স্থাপিত এ প্রতিষ্ঠান শাহ্ আবদুল হান্নানকে বাংলাদেশে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আইআইআইটি গ্লোবালকে বাংলাদেশে পরিচিত করতে নেন বিভিন্ন উদ্যোগ। এ ছাড়া তিনি আইআইআইটির সংশ্লিষ্ট স্কলার ড. আবদুল হামিদ আবু সুলাইমান, ড. আহমাদ তুতুঞ্জী, ড. দাতি মালকাভি, ড. হাশিম কামালীসহ বরেণ্য স্কলারদের বাংলাদেশে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। ফলে বাংলাদেশের ইসলামী স্কলাররা পাশ্চাত্যের ইসলামী স্কলারদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হয়।

শাহ্ আবদুল হান্নানের চিন্তা-চেতনা ও কর্মতৎপরতার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামকে জনমানুষের সামনে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা ও ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটানো। তিনি কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেও তাকে কোনো ইসলামী বই, ন্যূনপক্ষে তার নিজের লেখা প্রবন্ধ অথবা কোনো প্রখ্যাত চিন্তাবিদের নিবন্ধ দিয়ে আসতেন। তিনি বাংলাদেশের ইসলামসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

পেশায় সরকারি আমলা হলেও কার্যত তিনি ছিলেন শিক্ষক, মানুষ বানানোর কারিগর। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই তিনি শিক্ষক ছিলেন না, মাদরাসার আলেম ও কলেজ শিক্ষকদেরও শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতেন। তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলাদা স্টাডি ক্লাস নিতেন। তার নিজের গড়া উইটনেস-পাইওনিয়ার ছাড়াও যেসব প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়েও ক্লাস পরিচালনা করতেন। এমনকি সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়েও ক্লাস করাতেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ইসলামী জ্ঞানের পিপাসা থেকে শাহ্ আবদুল হান্নান আরবি ভাষা শেখেন। তিনি ইসলামী ফাউন্ডেশনের আরবি ভাষা কোর্সে অংশ নেন। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটি পরে শিক্ষার্থীদের আরবি ব্যাকরণ পাঠদান করেন এবং উসূলে ফিকহ্ ওপর বই লিখেন।

তিনি উদার মানবতাবাদী ছিলেন। সব ঘরানার মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন। তার সতীর্থ এক কমরেডকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্য দিতেন। তিনি বাসার কাজের লোককে নিয়ে একই সাথে ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতেন। বাসার লোকদের থাকার সুব্যবস্থা করেছেন।

তিনি কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। নির্মোহ ব্যক্তিত্ব শাহ্ আবদুল হান্নান চাকরি জীবনের শুরুতে শুল্ক ও আবগরি বিভাগে কাজ করেছেন। দুর্নীতি দমন বুরে‌্যার মহাপরিচালক ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার সময় অর্থ-সম্পদ পুঞ্জীভূত করার সুযোগ তার ছিল। কিন্তু তিনি সততার পথই বেছে নিয়েছিলেন।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews