পদ্মাতীরের এক কুঠিবাড়ি থেকে দেশের শীর্ষ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছে ৭১ বছর। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতিতে রেখে আসছে বিশেষ অবদান। উত্তরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সারা দেশেই শিক্ষার এক অমূল্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্য বলছে, ১৬১ জন নিয়ে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের অধিক। সাথে যুক্ত রয়েছেন এক হাজার ১২ জন শিক্ষক ও বিপুলসংখ্যক গবেষক। ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসজুড়ে ১২টি অনুষদ, ৫৯টি বিভাগ ও ছয়টি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ আধুনিক অবকাঠামো রয়েছে। ১৪টি একাডেমিক ভবন, ১৭টি আবাসিক হল, আন্তর্জাতিক ডরমিটরি, গ্রন্থাগার, আইসিটি সেন্টার, জাদুঘর, স্টেডিয়াম, সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন সুবিধাও রয়েছে।

শিক্ষা ও গবেষণায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গৌরবজনক অবস্থান গড়ে তুলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন পুনরুদ্ধার, পানিকে আর্সেনিক দূষণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গ্রিন চিলি পাউডার ও সজনে পাতার গুঁড়া তৈরি এসব সাফল্যের অন্যতম।

এছাড়া সফলতার মধ্যে রয়েছে চার সবজি থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণ ও তুঁত গবেষণায় ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধী আবিষ্কার, পাটের বিকল্প আঁশ উদ্ভাবন, উন্নত প্রজাতির মাছ গবেষণা ও বিলুপ্তপ্রায় দেশী মাছের আট প্রজাতি হাওরে ফিরিয়ে আনা, বিরল অর্কিড কাঞ্চন, ফুলের জীবন্ত চিত্রকর্ম, মাটি ছাড়া ঘাস ও আনারস চাষে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফলতা।

সম্প্রতি লবণ ছাড়া চামড়া সংরক্ষণের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দেশে প্রথম সফল গবেষণা করেছেন ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। পদার্থবিদ্যায় রাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাকেরও রয়েছে সফলতা। এসব গবেষণা দেশের বাস্তব ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।

এদিকে উচ্চশিক্ষায় রাবি শিক্ষার্থীদের সফলতাও বেড়ে চলছে। সর্বশেষ তথ্যে গত ছয় মাসে ৩৪ জন উচ্চশিক্ষায় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ ও একই ল্যাবের পাঁচ শিক্ষার্থী সম্প্রতি আমেরিকার পৃথক চার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন।

গবেষণায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদা পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সবশেষ যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নেচার ইনডেক্স র‍্যাংকিং মার্চ ২০২৫ অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মধ্যে গবেষণায় শীর্ষস্থান দখল করেছে। এর আগে স্কোপাসের জরিপে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণায় সবার শীর্ষে অবস্থান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

ইউএস গ্লোবাল নিউজ র‍্যাংকিং ২০২৫ অনুযায়ী বিশ্বের গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এর অবস্থান ৬৩৮তম। এর আগে এ বছরের ২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাংকিংয়ে দেশের শীর্ষস্থান অর্জন করেছে রাবি। তাছাড়া বিশ্বসেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞান গবেষকের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবসহ ১৫ জন গবেষক স্থান পেয়েছেন।

অন্যদিকে রাবিতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। সবশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থীসহ ভর্তি হয়েছেন ১৮ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে ৯টি দেশের ৩৩ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়ন করছেন।

এছাড়া বিজেএস ছাড়িয়ে সম্প্রতি বিসিএসেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা চোখে পড়ার মতো। পররাষ্ট্র ক্যাডারে ৪র্থ ও অ্যাডমিনে ৫মসহ ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, গত চার বছর টানা ১ম স্থান অর্জনসহ সবশেষ ১৭তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষাতেও রাবির আইন অনুষদ থেকে ২৮ জন শিক্ষার্থী সহকারী জজ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান তৈরি করেছে। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো বাজার চাহিদাভিত্তিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। এজন্য কারিকুলাম আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে।’

প্রতিষ্ঠার সাত দশকে কিছু ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও কাটেনি শিক্ষক ও আবাসন সংকট, রয়েছে সেশনজটও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে সফলতা থাকলেও সংকটও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। আবাসন সংকটও বেশ পুরনো। তৃতীয় বর্ষে পড়েও রাবির অনেক শিক্ষার্থী এখনো হলে সিট পাচ্ছেন না, যা শিক্ষাজীবনের মান ও মনোবলের জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ১৭টি আবাসিক হল রয়েছে। অবশ্য নতুন আরো একটি হল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১০ তলা আবাসিক হলটির কাজ শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, ‘আবাসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরই মধ্যে নতুন পাঁচটি হল নির্মাণের প্রস্তাব সরকারে প্রেরণ করেছে। এর পাশাপাশি ছেলেদের একটি নতুন হলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ, ডিসেম্বরের মধ্যেই সেখানে ১১ শতাধিক শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাবে। মেয়েদের একটি হলের কাজও শেষের দিকে, আগামী বছরেই উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেশনজট নিরসনে প্রতিটি বিভাগের সেমিস্টার ও পরীক্ষাগুলো যেন নির্ধারিত সময়েই শেষ হয় সে বিষয়েও নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুতই এ সংকট কেটে যাবে। তাছাড়া ২০ তলা বিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ভবনটি উদ্বোধনের পর শ্রেণীকক্ষ সংকটও দূর হবে।’

সার্বিক বিষয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘রাবি বর্তমানে গবেষণা, র‌্যাংকিং ও উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো করছে। শিক্ষক-গবেষকদের পাশাপাশি ছাত্র-গবেষকদেরও উৎসাহ দিতে বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছি। সার্বিকভাবে একাডেমিক সংস্কার ও মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি বিভাগে কারিকুলাম আধুনিকায়নের কাজ চলছে। একাডেমিক শৃঙ্খলা ও ক্লাস পরিচালনায় ক্রেডিট ফলো হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে টিচার ইভালুয়েশন চালু হবে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে নাম-রোলবিহীন কোডিং-ডিকোডিং ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।’


Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews