মেয়ে হওয়ার কারণে আমি কি সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো, ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার, আমি ভবিষ্যতে যৌন কর্মী হতে চাই, কারন এটাও তো শ্রম? লজ্জা নয়। গর্বের সাথে বলবো আমিই আমার শরীরের মালিক, গর্ভপাত করা আমার স্বাধীনতা? হালাল বৈবাহিক সম্পর্কের উপর দাড়িয়ে কি বলতে পারবো, আমার স্বামী আমাকে ধর্ষণ করেছে? কুরআনের বিধানকে পাশ কাটিয়ে বলতে পারব, বাবার সম্পত্তিতে ভাই-বোনের সমান অধিকার চাই? -হয়তো পারবো। কারণ রাষ্ট্র, মিডিয়া, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং তথাকথিত মানবাধিকারপন্থীরা আমাদের সেদিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। শাহবাগ আন্দোলনের নামে তৈরি হওয়া নতুন প্রজন্মের সামাজিক চেতনা এবং নারী অধিকার কমিশনের উত্থাপিত প্রস্তাবনাগুলোর ভেতর দিয়ে আজ এক ভয়ংকর বিতর্ক জন্ম নিচ্ছে, যা সরাসরি ইসলামের মৌলিক বিধান এবং সমাজের ধর্মীয় কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেন কুরআনের দেওয়া সম্মান, অধিকার, মর্যাদা কিছুই নয়-সবকিছু বাতিল করে এই জড়বাদী মুক্তিই এখন একমাত্র লক্ষ্য। যেন নারী তখনই মুক্ত, যখন সে আল্লাহর আইন উপেক্ষা করে নিজের কামনা-বাসনার পুজারী হয়ে ওঠে। এই যে মুক্তি’র নতুন সংজ্ঞা, এটা কি সত্যিই মুক্তি, নাকি আত্মপ্রবঞ্চনা?
নারী অধিকার নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। আসছে সংস্কারের প্রস্তাবনা। কিন্তু এসব সংস্কারের নামে এমন কিছু দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে, যা সুক্ষ্মভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পশ্চিমা বিশ্বে যেমন ওপেন সেক্স, গর্ভপাত, নারী-পুরুষের সমান অধিকার চাওয়া, তেমনই নারীবিষয়ক কমিশনও পশ্চিমাদের নীতিমালার অনুসরণকারী এক এজেন্টে পরিণত হয়েছে। কমিশন যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তা জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর বিদেশি এনজিওগুলোর চাপিয়ে দেওয়া মতামত, যার ভেতরে ইসলামী সমাজ ও পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস করার নীতি লুকিয়ে আছে। তারা চায় নারীর ‘স্বাধীনতা’র নামে ধর্মীয় শাসন মুছে ফেলতে, পরিবার ভেঙে দিতে, নারীকে যেন নিজ শরীর আর যৌনতা নিয়েই ব্যস্ত রাখতে। এই কমিশনের ভাবনা ও শব্দচয়ন পশ্চিমা সমাজের নারীবাদী আন্দোলনের প্রতিধ্বনি। তারা চায় নারীকে পুরুষের মতো বানাতে, অথচ ইসলামী সমাজে নারী ও পুরুষ পরিপূরক, প্রতিযোগী নয়। কমিশন তাদের সুরে কথা বলেই এমন সব প্রস্তাব দিচ্ছে, যা ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ নিয়ে যারা সোচ্চার তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। কয়েকটি শহরের উচ্চবিত্ত শিক্ষিত গোষ্ঠী, যাদের বেশিরভাগই পশ্চিমা শিক্ষায় প্রভাবিত এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি তীব্র বিরাপ্রবণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত সামান্য সংখ্যার এই শ্রেণিটিই যেন দেশের শিক্ষা, মিডিয়া, সংস্কৃতি ও আইন তৈরির প্রায় প্রতিটি স্তরে এক ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ঠিক করে, টেলিভিশনের নাটকে কাহিনি বেছে নেয়, নারী বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কমিশনের ভাষা লিখে দেয়, এমনকি আদালতের ভাষাতেও তাদের ছায়া পড়ে। প্রশ্ন হলো, তাদের পেছনে কারা? কাদের এত আগ্রহ যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনার বাইরে গিয়ে পশ্চিমপন্থী চিন্তাবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টদের চিন্তা, ধারণা ফেরি করছে। তারা জানে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কখনোই স্বেচ্ছায় এই সংস্কৃতি গ্রহণ করবে না। তাই তারা আইনের ভাষা বদলায়, মিডিয়ার মাধ্যমে চিন্তায় হস্তক্ষেপ করে, শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে বিষ ঢেলে দেয়, যেন মানুষ বুঝতেই না পারে সে কোথায় যাচ্ছে, কী হারাচ্ছে। এক প্রজন্ম পরে মানুষ আর ধর্ম-বিশ্বাসের কথা বলবে না, পরিবার-সমাজের বন্ধনের কথা ভাববে না, এটাই যেন তাদের শেষ লক্ষ্য। কিন্তু এরপরেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, আর তা হলো ইসলামের বিধান অনুযায়ী নারীর সম্মান, মর্যাদা আর অধিকার সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন, আর কতটুকু অনুসরণ করি?
এক. ধর্মীয় বিধান যেখানে নারীকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ সম্মান, নির্ধারিত অধিকার, সুরক্ষিত মর্যাদা, সেখানে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় নারী বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে ‘ধর্ম’কে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, তারা বলছে এই বৈষম্য প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় বাধা নাকি ধর্ম নিজেই! ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায়, দশম অধ্যায়ের শ্লোগানে লেখা হয়েছে, ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার’। নিজেকে শরীরের একমাত্র মালিক মনে করে খোলামেলা পোশাক পরা, বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কে জড়ানো কিংবা গর্ভপাতের মতো কাজে লিপ্ত হওয়া-এসব আচরণ কোনো ধর্মই অনুমোদন করে না। বিশেষ করে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে একজন মুসলিম নারী জানেন, এই শরীর আল্লাহর দেওয়া একটি ‘আমানত’, কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাই শরীরের ব্যবহারেও রয়েছে সীমা, রয়েছে দায়িত্ব, রয়েছে জবাবদিহিতা। একজন নারীর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে তার জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে-তার পোশাকে কতটা শালীনতা আছে, তার আচরণ কতটা মার্জিত, সে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, সে আদৌ নৈতিকতা চর্চা করে কিনা ইত্যাদি। কারণ, নৈতিকতাই মানুষের আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ও আত্মিক পরিপূর্নতার মাপকাঠি। কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন থেকে আমরা দেখি এক ভয়াবহ বিপরীত চিত্র। তাদের প্রতিবেদনের ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় তারা ‘শালীনতা’ ও ‘নৈতিকতা’এই দুইটি শব্দকেই পরিহার করার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রশ্ন আসে-এই শব্দদ্বয়ে এমন কী সমস্যা রয়েছে? তারা কি শুধু শব্দ মুছে ফেলতে চাইছে, না কি সুক্ষ্মভাবে এই মূল্যবোধগুলো-যেগুলো একটি সমাজের নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে সেগুলোকেই নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে? যদি শালীনতা ও নৈতিকতাই সমাজ থেকে মুছে যায়, তাহলে নারীর অধিকার তো নয়, বরং নারীর চরিত্রের, মর্যাদার, নিরাপত্তার ও আত্মমর্যাদার বিপন্নতা শুরু হবে।
দুই. ধর্ম যেখানে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে হারাম এবং ঘৃণ্য পাপ বলে আখ্যায়িত করেছে, সেখানে এই কমিশন তাদের ৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায় যৌন পেশাকে শ্রম আইনে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে! একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্রে এই আইন কখনো মেনে নেওয়া সম্ভব কি? যারা বর্তমানে এই পেশায় আছে, তারা আসলে কী চায়? তারা কি চিরস্থায়ীভাবে এই পেশায় থাকতে চায়, নাকি চায় নিরাপদ পুনর্বাসন, সামাজিক প্রহণযোগ্যতা এবং বিকল্প জীবনের সুযোগ? যারা এই আইন প্রস্তাব করছে, তারা কি এই পেশায় নিয়োজিত নারীদের মতামত নিয়েছে, নাকি নিজেদের ধারণাকেই দাঁড় করিয়েছে? এই নীতিনির্ধারকদের পরিবারের কোনো নারী কি এই পেশায় আছে? তারা কি চায় তাঁদের সন্তান ভবিষ্যতে এই পেশায় যুক্ত হোক? নিশ্চয়ই না। কারণ, কেউ চায় না তাদের প্রিয়জন এই পেশায় যুক্ত হোক। তাহলে যারা এই পেশায় আছে, তারা সেখানে কেন আছে? বেশিরভাগই কোন না কোন অপরাধমূলক পরিস্থিতির শিকার হয়ে, দারিদ্র্য, পাচার, নির্যাতন হয়ে এই পেশায় প্রবেশ করেছে। তাদের জীবনের ট্র্যাজেডিকে ‘শ্রম’ নামে বৈধতা দেওয়া মানে এই পাপচক্র ও অপরাধ কাঠামোকে আইনগত ছায়া দেওয়া। তখন নারী হয়ে উঠবে কেবলমাত্র এক ভোগ্যপণ্য। গড়ে উঠবে যৌন কর্মীদের ‘ইন্ডাস্ট্রি’। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এমনকি গৃহবধূরাও হয়তো পার্ট-টাইম বা ফুল-টাইম যৌনকর্মী হিসেবে রাস্তায় নামবে। মেয়েরা যাবে যৌনপেশায়, বাবার সামনে, ভাইয়ের সামনে, স্বামীর সামনে-আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। কারণ আইন তাদেরকে অনুমতি দিচ্ছে। এর ফলে সমাজে দেখা দেবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়-ভেঙে পড়বে নৈতিক, মানসিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় কাঠামো। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতেও দেখা দেবে গভীর সংকট। যৌনসংক্রমণ ও এইডসের মতো মরণব্যাধি, অনিরাপদ গর্ভপাত, মানসিক অবসাদ, ওষুধ ও মাদকে আসক্তির মতো অসংখ্য বিপর্যয় সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। শুধু ভুগবে না এই নারীরা, বরং তাদের সঙ্গী, পরিবার, সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মও হবে এই রোগ ও নৈতিক দুর্যোগের শিকার। এই বিপর্যয় শুধু নারীকেই নয়, পুরো মানবতাকেই ধ্বংস করবে।
তিন. মানুষের মধ্যে যতগুলো সম্পর্ক বিদ্যমান, তার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি সবচেয়ে মধুর, নিরাপদ এবং গভীর মানবিক বন্ধন। আর এই সম্পর্ক তৈরি হয় ‘বিবাহ’ নামক এক পবিত্র সামাজিক ও ধর্মীয় চুক্তির মাধ্যমে। বিবাহ নিছক কোনো আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি এক স্নিগ্ধ আত্মিক অঙ্গীকার, যেখানে থাকে ভালোবাসা, দায়িত্ব, নিরাপত্তা, শ্রদ্ধা, সংযম এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অভিপ্রায়। এই সম্পর্কের মাধ্যমেই মানবজাতির বংশপরম্পরা এগিয়ে চলে, সমাজে আসে স্থিতি। কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনের ৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায় এই পবিত্র সম্পর্কের শিরায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে সন্দেহের বিষ। প্রস্তাব করেছে, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ‘জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে’ ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই প্রস্তাবটি প্রথমে মানবিক শোনালেও, এর গভীরতর পরিণতি হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিতেই তৈরি হবে ভয়, বিচ্ছিন্নতা ও আস্থার ভাঙন। ইসলামে যৌন সম্পর্ক কেবল স্বামীর অধিকার নয়, স্ত্রীও এর অধিকারভুক্ত। ইসলাম শিক্ষা দেয়, এই সম্পর্ক যেন হয় পারস্পরিক সম্মতি, ন¤্রতা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। কোনো জোরজবরদস্তি ইসলাম সমর্থন করে না। তবে এই ‘ধর্ষণ’ পরিভাষা বৈবাহিক সম্পর্কে প্রয়োগ করার অর্থ হলো এই সম্পর্ককে অপরাধের ছায়ায় দাঁড় করানো, যা ইসলাম, পরিবার ও সামাজিক কাঠামোর পরিপন্থী। এই ধরনের আইন যদি কার্যকর হয়, তবে নারীর প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ রুদ্ধ হয়ে যাবে, বহু পুরুষ বিবাহ নামক এই পবিত্র সম্পর্ক গঠনে অনীহা প্রকাশ করবে। এক্ষেত্রে সমাজে পতিতাবৃত্তির মতো অন্যায়ও নিরাপদ মনে হবে, যা এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা করবে। এর ফলে বিয়ের হার কমবে, অবৈধ সম্পর্ক বাড়বে, পরিবার ভাঙবে, সন্তান জন্মাবে বিবাহবহির্ভূতভাবে, আর সমাজ হারাবে তার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি।
চার. ইসলাম নারীকে যে সম্মান ও নিরাপত্তা দিয়েছে, তা এমন এক গভীর মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা কেবল ন্যায্যতা ও দায়িত্ববোধের ভিত্তিতেই সম্ভব। একজন নারী, ইসলামি শরিয়তের আলোকে, কখনোই অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতার বোঝা বইতে বাধ্য নয়। তার জীবনের প্রতিটি পর্বেই থাকে তার অভিভাবকের নিরঙ্কুশ দায়িত্ব। শৈশবে বাবা, কৈশোরে ভাই, বিবাহের পর স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র। এই ধারাবাহিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ইসলামী কাঠামো নারীকে অর্থ উপার্জনের চাপে ঠেলে দেয়নি বরং তাকে নির্ভার করেছে, মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। স্বামীর উপার্জনে স্ত্রী সম্মানজনক অধিকার লাভ করে, কিন্তু স্ত্রীর ব্যক্তিগত উপার্জন বা অর্জিত সম্পদ তার একক মালিকানায় থাকে। স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিছু দান করে, তবে তা সদকা; কিন্তু না দিলে কেউ দাবি করতে পারে না। এই অধিকার ও স্বাধীনতাই প্রমাণ করে, ইসলাম নারীকে কখনো করণীয়র খাঁচায় আটকে দেয়নি; বরং তাকে তার মানসিক, শারীরিক ও পারিবারিক ভারসাম্যের ভিতর এক নিরাপদ অবস্থানে স্থাপন করেছে। বিবাহের সময় ‘মোহরানা’ একটি পবিত্র ও আইনসম্মত দেনমোহর, যা পুরুষ কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদান করতে হয় এবং তা একান্তভাবেই স্ত্রীর সম্পত্তি। এইসব কারণের উপর ভিত্তি করেই ইসলাম বাবার সম্পত্তিতে ভাই এর দুই ভাগ ও বোনের এক ভাগ অধিকার দিয়েছে। তবে এখানেই আশঙ্কার জায়গা, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের ১৫ ও ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় যে উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে, তা ইসলামের স্থাপিত ভারসাম্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করে। তারা নারীকে ভাইয়ের সমান সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে, অথচ একবারও বলেনি ভাগ বাড়ার পর দায়িত্বও কি সমানভাবে বণ্টন হবে? বাবা-মায়ের ভরণপোষণ, পরিবারে আর্থিক দায়িত্ব, আত্মীয়দের সহায়তা, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর যে দায়িত্বগুলো ইসলাম পুরুষকে দিয়েছে, সেগুলো নারীর উপর আরোপ করা হবে কি? যদি সম্পত্তি সমান হয়, তবে দায়িত্বেও সমতা আনতে হবে, এটাই তো যুক্তিবোধের দাবি। নতুবা এই ‘সমান অধিকার’ হবে একতরফা সুযোগ, দায়হীন মালিকানা, যা ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের মোড়কে বৈষম্যই তৈরি করবে। এখানেই ইসলামের ব্যতিক্রমী প্রজ্ঞা ও ভারসাম্য। ইসলাম বলে না ‘সমান’ ইসলাম বলে ‘ন্যায্য’। কারণ, সব সমান অংশই ন্যায্য হয় না, বরং অনেক সময় সমতা ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা এও বলছে যে, কেউ যদি ধর্মীয় আইন না মানে সে সংশোধিত আইন অনুযায়ী সম্পত্তির মালিকানা পাবে, কিন্তু যদি একই পরিবারে উভয়মতের ভাই-বোন থাকে তবে তাদেরটা কিভাবে বন্টন হবে? তাই ভাই দুই ভাগ, বোন এক ভাগ এই হিসেবের পেছনে আছে দায়িত্ব, কাঠামো, সম্পর্ক ও ভারসাম্যের পূর্ণ বিবেচনা। কিন্তু এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে সমাজের কাঠামোতে শুরু হবে গভীর সংকট। আত্মীয়তার টান হয়ে পড়বে দুর্বল, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে বাড়বে বিদ্বেষ, পরিবারে ছড়িয়ে পড়বে অবিশ্বাস। সন্তানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের জায়গায় আসবে হিসাবনিকাশ, আর সেই ধর্মীয় দায়িত্ববোধ, যা এতদিন পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিল, তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। আমরা দেখেছি পশ্চিমা বিশ্বে এই একই রকম তথাকথিত সমতার দোহাই দিয়ে পারিবারিক কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আজ তারা সেই বিভ্রান্তির ফল ভোগ করছে-একাকীত্ব, মানসিক রোগ, বৃদ্ধাশ্রমের বোঝা, আত্মহত্যার হার, সমাজবিচ্ছিন্নতা, এবং বংশপরম্পরার টানাপোড়েন। সেই পথেই কি আমরা হাঁটতে চাই?
বর্তমানে নারীর অধিকারের নামে যেসব শ্লোগান উঠছে ‘পুরুষের ক্ষমতা ভেঙ্গে গড়ো সমতা’, তা শুনতে যতটা বিপ্লবী, বিশ্লেষণে ততটাই বিভ্রান্তিকর। প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি পুরুষের কোনো অতিরিক্ত ‘ক্ষমতা’ রয়েছে, যা ভেঙে দিতে হবে? ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ দুটি পৃথক সত্তা, যাদের ভূমিকা আলাদা, দায়িত্ব ভিন্ন, কিন্তু মর্যাদা সমান। সুতরাং এখানে কারও ‘ক্ষমতা’ ভেঙে অন্যের ‘সমতা’ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই ওঠে না। বরং ইসলাম এমন এক ভারসাম্যের কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, যেখানে কেউ কারও শাসক নয়, বরং একজন আরেকজনের জন্য আবরণ, আশ্রয় ও সহযোগী। যারা ‘সমান সমান অধিকার চায়, তারাই আবার বলে, নারীর জন্য আলাদা পার্ক চাই, আলাদা বাস চাই, সংরক্ষিত আসন চাই, আলাদা নিরাপত্তা চাই। এখানেই তো বিরাট দ্বিচারিতা! যদি সব দিকেই সমান হতে চায়, তবে আলাদা সুবিধার দাবিও ত্যাগ করতে হবে। আর যদি বুঝতে পারে যে, নারী-পুরুষের শারীরিক ও সামাজিক বাস্তবতা ভিন্ন, তবে সমতার পরিবর্তে ন্যায়ের কথা বলা উচিত। কারণ, ইসলাম সমতা নয়, ইনসাফ বা ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দেয়।
লেখিকা : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান,
অরগানাইজেশন ফর নীড আস
ই-মেইল: [email protected]