নারীরা কেন জঙ্গি হবে

বর্তমানে দেশে যে চলমান সংকটগুলো রয়েছে তার মধ্যে জঙ্গিবাদ অন্যতম। সেই জঙ্গি সংকটে নতুন করে যোগ হয়েছে “নারী জঙ্গি” সমস্যা। গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার কয়েকদিন পরেই সিরাজগঞ্জে চার নারী জঙ্গিকে আটক করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই নারী জঙ্গিদের আস্তানা থেকে ১৩টি জিহাদি বই, ছয়টি তাজা ককটেল ও গ্রেনেড তৈরির চারটি খোল এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছিল। অবস্থা দেখে এটি সহজেই অনুমেয় যে, হলি আর্টিজানের মত এমন আরেকটি ট্র্যাজেডি ঘটানোর জন্যেই সে আস্তানায় জড়ো হয়েছিল। আটককৃত নারী জঙ্গিদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, তাদের স্বামীরাও একই পথের পথিক, অর্থাত্ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে অনেক আগে থেকেই নিখোঁজ হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ এবং অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে অর্থাত্ মা হয়েও এদের মধ্যে কেউ কেউ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে!


ওই চার নারী আটকের কয়েকদিনের মধ্যেই আবারো ঢাকার কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এদের তিনজন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্রী এবং একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য পাস করা ডাক্তার, যে ওই মেডিক্যালেই ইন্টার্ির্ন করছিল। অর্থাত্ এদের কেউই অর্থাভাবে জঙ্গিবাদে জড়িত হয়নি। দুশ্চিন্তার পারদ এখানেই ঊর্ধ্বমুখী। কারণ অর্থাভাব মেটানো যায়, কিন্তু যখন মানুষ আদর্শিকভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে তখন দেশে ঘোর সংকট নেমে আসে।


নারী জঙ্গিবাদে সবচেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছে পুলিশ। এমনটাই পড়লাম কোনো এক জার্নালে। সেখানে অনেকগুলো কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আসলে নারী জঙ্গি বা জঙ্গিবাদে নারীদের অংশগ্রহণ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। আমি জঙ্গিবাদ নিয়ে অনেক আগে “সবুজ মাঠ পেরিয়ে অথবা একটি শীষ আংটির গল্প” নামে একটি কলাম লিখেছিলাম যেখানে আমি স্ব-অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরেছিলাম কিভাবে নারীদের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার ঘটছে। অনেকের ধারণা নারী জঙ্গিবাদ কেবল গ্রামের অশিক্ষিত নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ব্যাপারটা এমন যে গ্রামে জঙ্গিরা গেল, সেখানে টাকা দিয়ে হোক, ধর্মের নামে হোক, কোনো এক ভাবে নারীদের প্ররোচিত করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল, যা কিনা মানারাতের ছাত্রীদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার পরে একেবারেই পরিষ্কার। আমাদের বাংলাদেশে নারীরা যেভাবে সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে এমনটা পৃথিবীর অনেক দেশে ধারণাতীত। নারীরা এ সুযোগ আবার সফলভাবে কাজেও লাগাচ্ছে। যেমন: আমাদের বাংলাদেশে এখন নারী পাইলট রয়েছেন। এমনকি সীমান্ত রক্ষায়ও সফলভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন নারীরা। এমন অবস্থায় দেশের সেই শিক্ষিত নারীরা যখন বিপথগামী হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে তখন জঙ্গিবাদের উত্থান এবং বিস্তার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়।


বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূত্রপাত ঘটে ২০০১-এর পর, একটি নির্দিষ্ট জোট ক্ষমতায় আসার পরে। সেই জোটের একটি অংশ যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সারা দেশে চালায় নারকীয় তাণ্ডব। সারা দেশের ৬৩টি জেলায় একবারে একসময়ে বোমা হামলা চালিয়ে সারাদেশকে পরিণত করে মৃত্যুপুরীতে। সেখানেই থেমে থাকেনি। একের পর এক হামলা চলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়। উদীচী হামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, রমনার বটমূলে হামলা, সিনেমা হলে হামলা, মসজিদে, মন্দিরে বাদ যায়নি কোনো জায়গায়। তারপর যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরলেন তখন ঘাপটি মেরে গেল সব। মূল পরিকল্পনাটা হয় তখনই। নীরবে...


 সেই জোটের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা দলটির একটি আলাদা বিশেষ সংগঠন রয়েছে। যার নাম ইসলামী ছাত্রী সংস্থা। এ সংগঠনের সম্পর্কে বিস্তারিত নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৯৭৮ সালে সংগঠিত এই ছাত্রী সংস্থা বাংলাদেশে রুট লেভেলে জঙ্গিবাদ বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে বহুকাল। এদের কৌশলটি খুবই সুপরিচিত। এর আগে বহুবার আলোচনা করেছি। এরা জঙ্গিবাদ বিস্তারে মূলত ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মকে এদেশের মানুষ সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখে। সেই ধর্মকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ছাত্রী সংস্থার মেয়ে কিংবা মহিলারা। এরা প্রথমে মানুষের সাথে আন্তরিকতা বৃদ্ধি করে। খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলে। ধর্মীয় আলোচনা, সবকিছুর খোঁজখবর নেওয়া এদের অনেকটা রুটিন-ওয়ার্ক। তারপর একদিন সেই সদ্য পরিচিতের বাসায় মাহফিল বসায়। সেখানে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করে। কোনোভাবেই ধরতে পারবেন না যে এরা আপনাকে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছে বিপথগামী পথে! এরা মাহফিলে খুব সুন্দর ইসলামী কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাত্ করেই আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সুকৌশলে রাজনৈতিক আলাপে চলে আসে। সেই পরিচিতের অন্তরে টেকনিক্যালি কিছু চিন্তার খোরাক ঢুকিয়ে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের দলে ঢুকিয়ে নেয়। সেই মাহফিল থেকে ছাত্রী সংস্থার এজেন্টরা আর্থিকভাবেও সুবিধা নেয়। মাহফিল থেকে তারা টাকা সংগ্রহ করে। কেউ একশ’ টাকা, কেউ দু’শ’, আবার কেউ হাজার টাকাও আল্লাহর রাস্তায় দান করছে ভেবে সেই ছাত্রী সংস্থার এজেন্টদের দিয়ে দেয়। এভাবে আর্থিকভাবেও এরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এছাড়াও এদের বানানো বিভিন্ন ইসলামিক বই বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। সেই অর্থ দিয়েই বিস্তার ঘটছে জঙ্গিবাদের।


জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে আরেকটি কৌশল অবলম্বন করে থাকে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে বহু মানুষ এখনও অর্থকষ্টে জীবন পার করছেন। জঙ্গিগোষ্ঠি এই সুযোগটিকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। গ্রামের মানুষ সহজ সরল। কোনো একজন যদি অর্থকষ্টে থাকেন এবং কোনো জঙ্গিগোষ্ঠি যদি তাদের সেই অভাব-অনটন দূর করে দেয় তাহলে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিভিন্ন রকমের জঙ্গি কর্মকাণ্ডতে সেই লোক অংশগ্রহণ করে থাকেন। এভাবে আস্তে আস্তে পর্যায়ক্রমে ছোট থেকে বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। আমাদের দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশ এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলের মত বড় বড় প্রজেক্ট হচ্ছে এদেশে। আমাদের রিজার্ভ এখন রেকর্ড পরিমাণ। দেশ যখন এগিয়ে চলেছে সুখী-সমৃদ্ধির দিকে ঠিক তখনই আমাদের উপরে আক্রমণটা করা হলো।


 এখনই জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা না করলে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রামে গ্রামে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে, যেন কোনোভাবেই এসব মাহফিলের নামে জঙ্গিবাদের বিস্তার না ঘটতে পারে। বরং, সরকার ভালো ভালো আলেম দিয়ে এরকম মাহফিলের আয়োজন করতে পারে এবং সে মাহফিলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার করতে পারে। তবে শুধু সরকার নয়, জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে। নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক সচেতনতা একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকে যদি আমি এর প্রতিরোধ না করি কাল নিজেই হতে পারি এর শিকার।


n লেখক :ডাইরেক্টর, রেডিও ঢোল, এফএম ৯৪.০ ফাউন্ডার, দ্যা লাভলি ফাউন্ডেশন


silvia.parveen¦gmail.com






Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews