আগামী সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদলীয় মোর্চা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ রাজনীতিতে একটি অগ্রগতি। এর আগে ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোটকে সরকারি দল স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা সিকি-আধুলিদের ঐক্য বলে উপহাস করছে। এটা কৌতুক হিসেবে চলে। কিন্তু তাঁরা সবাই ‘ষড়যন্ত্রকারী’, এই ধারণা আমাদের খাটো করে। কারণ, তাঁরা যদি ৩০ শতাংশ ভোটব্যাংকের মালিক-মোক্তার হয়ে থাকেন, তাহলে দাঁড়ায় দেশের ৩০ শতাংশ ভোটার ষড়যন্ত্রের সমর্থক। যাঁরা বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে সমর্থন করবেন, তাঁদের ভোট দেবেন, তাঁদের সবাইকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সমর্থক হিসেবে দেখাও ঠিক নয়।

বাংলাদেশ রাজনীতির ঐতিহ্যগত বন্ধ্যত্ব থেকে এবারে এ পর্যন্ত নতুন কী ঘটেছে, সেটা আমরা খতিয়ে দেখতে চাই। রাজনৈতিক সংস্কারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। রাজনীতিকেরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন; তাই বলে তাঁদের সবটাই নির্বাচনসর্বস্ব হবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। অথচ আমাদের রাজনীতিকেরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ধারাই বজায় রেখে চলছেন। ঐক্যফ্রন্টের মাধ্যমে বিএনপি তার আগের অবস্থান থেকে কতটা সরে গেল, সেটা একটা দেখার বিষয়। রাজনীতিকেরা ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচনী ইশতেহারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার করতে এবং পরে তা প্রতিপালন না করতে অভ্যস্ত।

১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা থেকে ২০০৮ সালের সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত এটাই আমরা দেখে এসেছি। জেনারেল এরশাদের সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক দশক এবং বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগের সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক দশক পর পাওয়া দুটি বিরোধীদলীয় দাবিনামার সঙ্গে আমরা যদি তুলনা করি, তাহলে একটি মিল দেখব। সেটি হলো, কোনো গুরুত্বপূর্ণ শাসনগত চলমান পদ্ধতির পরিবর্তনে কোনো নির্দিষ্ট দাবি না তোলা। তিন জোটের রূপরেখা এবং ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফার নির্বাচনকেন্দ্রিক স্পর্শকাতরতা অভিন্ন। ২৮ বছর আগের মতোই ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার (এবারে তত্ত্বাবধায়ক শব্দটির পরিহার লক্ষণীয়) গঠন এবং রেডিও-টিভিতে বিরোধী দলের মতামত প্রকাশের দাবি তোলা হলো।

২৮ বছরের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগমুহূর্তে নতুন মোর্চা গঠন করা, নির্বাচনী ফলাফল যাতে প্রভাবমুক্ত থাকে, সেই বিষয়ে দাবি তোলা এবং নির্বাচন–পরবর্তী সরকার কীভাবে চলবে, সেই বিষয়ে যত দূর সম্ভব অনির্দিষ্টভাবে দায়সারা বক্তব্য রাখা। ২০১৮ সালে এসেও আমরা এর ব্যতিক্রম দেখলাম না বললেই চলে। বিষয়টি আমরা ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্যের আলোকে যাচাই করতে পারি। আমরা তাদের শাসনগত সংস্কারমুখী চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ত্রুটিবিচ্যুতি নির্দেশ করতে চাইব এই আশায় যে, আরও গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা। এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি, তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না। কারণগুলো হলো:

এক.৭ দফা দাবির সবটাই নির্বাচনগত দাবি, শাসনগত সংস্কারের কোনো মৌলিক বিষয় এতে নেই। এর আগে বিএনপির ২০৩০ রূপকল্প এবং খালেদা জিয়ার জবানিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্দিষ্টভাবে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়ে অঙ্গীকার এসেছিল। কিন্তু তারা একে বিশ্বাসযোগ্য করতে পদক্ষেপ নেয়নি। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার অবাস্তব জেনেও তারা দাবি তুলেছে, কারণ এর গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে তারা মনে করে। একই বিচারে নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র নির্বাহী ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নির্দিষ্ট দাবি ৭ দফায় নেই। কেন নেই?

দুই. বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে ‘স্বেচ্ছাচারী’ বলা এবং সংসদে, সরকারে এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্য নির্ধারণ চমৎকার। কিন্তু তা কীভাবে আসবে, তা নিয়ে দুই বড় দল কখনো কোনো দিন আলোচনা করেনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মসিউর রহমান যাদু মিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে ‘গোপন চুক্তি’ করে তার বরখেলাপ করেছিলেন। সেই চুক্তির ৪০ তম বার্ষিকীতে নতুন চুক্তিনামার ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে আমাদের সংশয় স্বাভাবিক। অপ্রিয় হলেও পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি বিএনপি এর আগে কখনো করেনি; বরং বাহাত্তর ও পঁচাত্তরের চতুর্থ সংশোধনীর পরে পঞ্চম ও দ্বাদশ সংশোধনীতে স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থা বদলানোর সুযোগ যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া উভয়ে পেয়েছিলেন। তাঁরা হাতছাড়া করেছেন। সুতরাং সংস্কারপন্থী এই বিএনপিকে জনগণ চেনে না। চেনাতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টকে বলতে হবে, ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১০০ দিনে তারা কী পরিবর্তন আনবে। যেমন বঙ্গভবনে গিয়ে ড. কামাল হোসেন ও ড. আকবর আলি খানরা বলেছিলেন, রুলস অব বিজনেস শুধরে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অন্যের কাছে অর্পণ করা যায়। এখন ঐক্যফ্রন্ট বলুক, সেটা নির্বাচনকালে লাগলে স্বাভাবিক শাসনকালেও লাগবে।

তিন. পেশাজীবীদের সমন্বয় করে ৫০০ আসনের সংসদ, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু করা কিংবা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা ফ্রন্টের লক্ষ্যের মধ্যে না থাকা কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। আ স ম আবদুর রব দীর্ঘকাল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলে আসছিলেন, কিন্তু বিএনপির দুরবস্থার মধ্যেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করাতে পারলেন না। সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের গত তিন দশকের বেশি সময়ের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোনির্ভর যে রাজনীতির ধারা, তাকে ঐক্যফ্রন্ট চ্যালেঞ্জ করেনি। সুতরাং স্থিতাবস্থা বহাল। এটা কোনো অনবধানতাবশত বিচ্যুতি নয়। ৩০০ আসনে ৩০০ রাজনৈতিক নায়েব-গোমস্তার মাধ্যমে গোটা ভূখণ্ডের ওপর ছড়ি ঘোরানোর রাজনীতির সঙ্গে এই বিচ্যুতির সম্পর্ক নিবিড়।

চার.৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বাজেট ও সরকারের অনাস্থা প্রস্তাব ছাড়া সব বাধা তুলে নেওয়ার কথা নির্দিষ্ট না করা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। বিচারপতি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগসহ সব সাংবিধানিক ও আধা সাংবিধানিক পদধারীদের বাছাই ও নিয়োগে আমাদের একটি সাংবিধানিক কমিশন থাকলেই চলবে। এই কমিশনের সুপারিশে প্রধানমন্ত্রীর ‘মানি না’ ক্ষমতা যে থাকবে না, সেটা এখনই পরিষ্কার করে বলতে হবে।

আমরা মনে রাখব, বিএনপি কাদায় পড়েছে বলেই এসব দাবি তুলছি তা নয়, এসব যেকোনো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দরকারি। বিপদে পড়েছে বলেই কিছু সংস্কারের বিষয় তারা ‘লক্ষ্য’ হিসেবে নির্দিষ্ট করেছে মাত্র। কারণ, বিএনপি তার গঠনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণের বিষয়েও নীরব। আশা করব, আগামী নির্বাচনপূর্ব সভা–সমাবেশে বিএনপি ও তার শরিকেরা এ নীরবতা ভাঙবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা আলোচনা চান, কিন্তু এসব সংস্কারের বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য হবে না। খুবই সত্য কথা। সব বিষয়ে জাতীয় ঐক্য দরকার নেই। কিন্তু উল্লিখিত মৌলিক বিষয়ে ঐক্য আশা করি। ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের চাপে হলেও বিএনপি সংস্কারের পথে এলে গণতন্ত্রই লাভবান হবে।

আরও একটি দিকের প্রতি আমরা নজর দিতে পারি। বিশ্বের অনেক দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যে ‘সিকি–আধুলিরা’ পুরো টাকা হতে পেরেছে। জাতীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্ব, যাঁর তেমন কোনো পরিচয়ই ছিল না, তাঁরা পাদপ্রদীপে উঠে এসেছেন। ফ্রান্সের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল মাখোঁ যার একটি ভালো উদাহরণ। তাই এটা একটা প্রশ্ন যে, রাজনীতির এই সিকি-আধুলিরা ছাড়া দুই প্রধান দলের কেউই দেশশাসনের সুযোগ পেত না। তারা গত কয়েক দশকে কৌশলগত ১৫ দল, ৭ দল, ১৪ দল গড়েছেন, এ ছাড়া কী এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে সিকি–আধুলিদের অবস্থা পাল্টে যেতে পারে? তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের এক নেতার শ্লেষের জবাবে সিকি দিয়ে ষোলো আনা পূর্ণ করার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন। সিকি–আধুলিরা বিএনপি নামের অনিচ্ছুক ঘোড়াকে রাজনৈতিক সংস্কারের পানি খাওয়াতে পারবে কি?

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews