আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন একটি দেশ গড়া। যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র ও ধর্ম নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ বিভিন্ন বইয়ে রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। এসব নিয়েই বাংলা ইনসাইডারের এই আয়োজন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ২৫৮ নং পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,‘ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে;কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না এ ধারণা অনেককেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। আওয়ামী লীগ ও তার কর্মীরা যে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করে। আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছেন যারা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রবাদের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনদিন কোন রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না।তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান’।
আতিউর রহমান সংকলিত ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম’ বইয়ে ধর্ম ও রাষ্ট্র বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর আরো কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়। ১৯৫৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে আইন পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সকল ধর্মের সমতা বিধান প্রসঙ্গে বলেন,‘এ দেশে ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবই থাকবে এবং বাংলাদেশও থাকবে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর গত এক দশকে যে অত্যাচার হয়েছে তারও অবসান হবে’।
১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকার রমনায় সত্যিকারের ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে জাতির পিতা বলেন,‘বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র এবং তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না’।
১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে দেওয়া ভাষণে নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ শান্তি ও স্বপ্ন এবং আশা –আকাঙ্ক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি’।
একই ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন,‘ধর্মের নামে ভাড়াটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মানুষের আত্মার স্পন্দনকে পিষে মারার শামিল’।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের যৌথ অধিবেশন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন,‘আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা ক্ষমতার জন্যে রাজনীতি করি না। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্যই আওয়ামী লীগ রাজনীতি করে’।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মভিত্তি হবে না, রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে,শান্তিতে থাকবে’।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না’।
ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতার মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন,‘বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতার মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে।এখানে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না’।
সংবাদপত্রে অসাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমরা গণতন্ত্র চাই, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা চাই না, কারো বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করতেও চাই না। অথচ কোনো কোনো কাগজে লেখা হয়েছে, ‘মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য সংঘবদ্ধ হও। যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমার দেশের মানুষ রক্ত দিয়েছে, সেখানে বসে কেউ যদি তার বীজ বপন করতে চায়, তাহলে তা কি আপনারা সহ্য করবেন?’
বঙ্গবন্ধু ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই সচেতন ছিলেন,‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না । যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি’।
বাংলা ইনসাইডার/এসএফ