রাজনীতির মাঠে বিএনপিকে একঘরে করার ফন্দি আঁটছে কেউ কেউ। নিজের ঘর সামলানোর মুরোদ নেই; কিন্তু রাজ্য শাসনের স্বপ্নে বিভোর তারা। ভাবখানা এমন ‘মুই কী হনু রে’। ৫ আগস্টের পর পর জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কেনস্ট্রাইনের দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নিজ পাতিলের খবর না থাকলেও অন্যের সাম্রাজ্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দলটি। বিএনপি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা নয়; কিন্তু এই মুহূর্তে বিএনপি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার অনিবার্য কা-ারি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী। আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে কোনঠাসা করতে বক্তৃতা, বিবৃতি ও অনলাইন মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সাথে সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনকে।
শুরুতে জামায়াতের পরিকল্পিত বক্তা মিজানুর রহমান আজহারিকে দেশে এনে শোডাউন করে জামায়াতে ইসলামী। আজহারির ডায়ালগ ছিল ‘এক দল খাইছে, আরেক দল খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আছে’। পরে রাজনৈতিক মঞ্চেও জামায়াত নেতারা বারবার একই ডায়ালগ উচ্চারণ করেন। এরপর রাখডাক না রেখে প্রকাশ্যেই জামায়াত বক্তৃতা, বিবৃতি এবং তাদের প্রশিক্ষিত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট দিয়ে বিএনপিবিরোধী প্রচারণায় নামে। দেরিতে হলেও বিএনপি নেতারা বুঝতে পেরেছেন রাজনীতি থেকে বিএনপিকে মাইনাসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তারা। বিএনপিও এখন জামায়াতকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। কিন্তু অনলাইন প্লাটফর্মে উপযুক্ত প্লেয়ারের অভাবে পিছিয়ে রয়েছে বিএনপি। সর্বশেষ মিডফোর্টে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে আরেকবার সুযোগ নেয় জামায়াত ও সহযোগী সংগঠনগুলো। তারা বিএনপির ‘চাঁদাবাজি’ বিষয়টি সামনে এনে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। নিঃসন্দেহে মিডফোর্ট হত্যাকা- এই সময়ের সবচেয়ে বর্বর ও নৃশংস ঘটনা। কিন্তু জামায়াতের প্রতিবাদের আড়ালে ছিল বিএনপিকে ঘায়েল করাই উদ্দেশ্য। এ আন্দোলনে তারা সঙ্গী হিসাবে পেয়েছে ইসলামী আন্দোলনকে। এই দলও বিএনপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে। এদিকে জামায়াত নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ সোহাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদ মিছিলে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে শ্লোগান তুলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ‘ডাল মে কুচ কালা হায়’! অথচ কিছুদিন আগে গাজীপুরে মসজিদের ইমাম রইস উদ্দিনকে মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রকাশ্যে মব সৃষ্টি করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সুন্নী আলেমরা ছাড়া কাউকেই প্রতিবাদে সরব হতে দেখা যায়নি। জামায়াত-শিবির, চরমোনাই কেউই রাজপথে নেমে আসেননি। বরং পুলিশে মামলা দিতে গেলে থানার ভেতর তথাকথিত তৌহিদি জনতা মব সৃষ্টি করেছে। আন্দোলনে পুলিশি হয়রানির পাশাপাশি চট্টগ্রামে সুন্নীদের উপর জামায়াত-শিবির আক্রমণ করেছে। এ থেকে কি প্রমাণিত হয়? অন্যায়ের প্রতিবাদ নাকি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল!
২০০১ সাল থেকে বিএনপির ধামাধরা ছিল জামায়াত। প্রায় দুইযুগ বিএনপিকে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন দল বলে আসলেন জামায়াত নেতারা। কিন্তু এখন এ দলটিকে আওয়ামী লীগের চেয়ে খারাপ প্রমাণ করতে আদাজল খেয়ে নেমেছেন তারা। এর উদ্দেশ্য কী? ক্ষমতা? ডা. শফিকুর রহমানের আমলে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত অনেকটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটি ভূতুরে গল্পের চরিত্র। বিখ্যাত ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলি তার ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন- ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামের বিজ্ঞানী মৃত মানুষের হাড়গোড় একত্রিত করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে তাতে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা চালান। এতে তিনি সফল হলেও হাড়গোড় থেকে জীবিত মানুষের বদলে এক দানবের জন্ম হয়। এই দানবই পরবর্তীতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভাই ও স্ত্রীকে মেরে ফেলে এবং স্বয়ং ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে মারতে উদ্যত হয়। বর্তমানে জামায়াতের বিএনপি বিরোধী অবস্থান সেই গল্পটিই মনে করিয়ে দেয়।
স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন একমাত্র ভরসা ছিল বিএনপি। বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের পক্ষে বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা তখন বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দেন; কিন্তু যুদ্ধের মাঠে জোটসঙ্গীকে একা ফেলে যায়নি বিএনপি। জামায়াতের দলীয় নিবন্ধন বাতিল হয় ২০১৩ সালে। আর ’১৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায়নি জামায়াত-বিএনপি। কথিত আছে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াতই বিএনপিকে নির্বাচনে না যেতে প্ররোচিত করে। ২০১৮ সালে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। বিএনপি তাদেরকে ২২টি আসন ছেড়ে দেয়। ২০২৪ এর নির্বাচন বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে জামায়াতও বাদ পড়ে। এই পুরো সময় বিএনপির পিঠে চড়ে জামায়াত নিজেদের রক্ষা করে। সর্বশেষ ২০২৪ এ জুলাই আন্দোলন চলাকালে জামায়াতকে দল হিসাবে নিষিদ্ধ করা হয় তখন বিএনপিই জামায়াত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সরব হয় এবং বিবৃতি দেয়। কিন্তু এখন জামায়াতের ভূমিকা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের ন্যায় দেশছাড়া করার মতো। অবশ্য বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘জামায়াতে ইসলাম এরা হলো বেঈমান, এরা হলো মুনাফিক! এদের কাছে দেশ বড় নয়, মানুষ বড় নয়, মানুষের জীবন বড় নয়’! তাহলে জামায়াত বিএনপি’র সাথে সেই বেঈমানিই করছে?
২০১৩ সালে শাপলার গণহত্যার পর জামায়াত তার রাজনীতির খোলস পাল্টে ফেলে। তারা রাজপথের আন্দোলন থেকে মোটাদাগে সরে আসে। সে সময় আওয়ামী লীগের একমাত্র টার্গেটে পরিণত হয় বিএনপি এবং ব্যক্তি তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য বিবৃতিই ছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। জামায়াত এখন অপরাপর রাজনৈতিক দলের সাথে সন্ধি করে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে একা করতে চায়। বর্তমানে জামায়াতের কাছের বন্ধু চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন, যারা আওয়ামী শাসনামলের পুরোটা সময় রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করেছে। ২০২৩ সালের বরিশাল সিটি নির্বাচনের আগে ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করিমের মেয়ের বিয়েতে আওয়ামী সরকারের স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমন্ত্রণ করে রসনা বিলাস করানো হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে করেছেন খোশগল্প। আওয়ামী তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল রুঠিনওয়ার্ক।
আওয়ামী লীগ বাউন্ডারির বাইরে থাকলেও দেশ অস্থিতিশীল। ড. ইউনূস দৃশ্যত কার্যকর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিক। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, মববাজি সমানতালে চলছে। এই অবস্থা কি স্বাভাবিক নাকি এর পেছনে অন্য খেলা লুকিয়ে আছে! আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে মাঠে না থাকলেও ১৬ বছরের তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন কি একেবারেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে? প্রতিবেশী দেশের ইন্টেলিজেন্স কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে? এমতাবস্থায়, আওয়ামী বিরোধী শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার বদলে ক্রমশ পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। রাজনৈতিকভাবে কে কাকে ঘায়েল করতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলছে। জামায়াত-চরমোনাই আদাজল খেয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। কিন্তু বিএনপি ছাড়া দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় তারা কি সিকিভাগও সক্ষম, এমন প্রশ্ন আসে। এই বিভাজনের ফাঁদ কার? জামায়াত-চরমোনাই কি তা অনুধাবন করতে পারছে না। কোন চোরাবালিতে আটকা পড়ে আছে তারা? নাকি সম্ভাব্য ক্ষমতার মোহ দেশের চেয়েও বড় হয়ে তাদের সামনে এসেছে। এখনই সময় জাতীয় ঐক্যের। নতুবা পরাধীনতার দিন ক্যালেন্ডারের পাতায় গুনতে হবে। আধিপত্যবাদ আর দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা পড়বে জুলাই-আগস্টের খুনঝরা অর্জন।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।