পানির আরেক নাম জীবন—কিন্তু সেই জীবনধারাই এখন মৃত্যু ফাঁদ! রাজধানীর বহু এলাকায় বিগত কয়েক মাস ধরে পানির ন্যূনতম মান নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। কল ছাড়লেই ঘরভরা হচ্ছে পচা দুর্গন্ধে; কোথাও কালচে ময়লা, কোথাও আবার দেখা মিলছে পোকামাকড়ের।বিশুদ্ধতার অভাবে প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকার পরও কেন মিলছে না নিরাপদ পানি— এ প্রশ্নে ক্ষুব্ধ নগরবাসী।

গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা। এ পানি ফুটিয়েও ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন বাসিন্দারা। এতে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কলাবাগান, মগবাজার, রামপুরা, কল্যাণপুর ও যাত্রাবাড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় গত কয়েক মাস ধরেই ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিনের পর দিন এমন পানি ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকেই পেটের পীড়া, চর্মরোগসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। অভিযোগ করেও মেলে না কোনো স্থায়ী সমাধান। ওয়াসাকে একাধিকবার বিষয়টি জানানো হলেও তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

তবে ঢাকা ওয়াসা বলছে, তাদের সরবরাহে তেমন কোনো ত্রুটি নেই। সংস্থাটির দাবি, দীর্ঘদিন ধরে বাসাবাড়ির পানির ট্যাংক বা সংরক্ষণাগার পরিষ্কার না করায়ই এসব এলাকায় পানি নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের ট্যাংক পরিষ্কার করার পরামর্শও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন বশির উদ্দিন রোডের বাসিন্দারা। বিশেষ করে লাল ফকিরের গলি, শাপলা গার্ডেনের গলি ও আশপাশের এলাকাগুলোর বাসিন্দারা গত কয়েক মাস ধরেই ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা, পোকামাকড় ও দুর্গন্ধের অভিযোগ করছেন। অনেকেই বলছেন, সকাল-বিকেল কল ছাড়লেই ঘরে ভেসে আসে পচা গন্ধ আর অস্বচ্ছ কালচে পানি।

বশির উদ্দিন রোডের ৬৭ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকেন মুদি দোকানদার আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিতে পোকা ও দুর্গন্ধ পাচ্ছি। বাধ্য হয়ে ওয়াসার ওয়াটার এটিএম বুথ থেকে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। তবে রান্না ও অন্যান্য কাজে ওই নোংরা পানি দিয়েই চলতে হয়। বাড়ির মালিকের কাছে অভিযোগ করার পর তিন দিন আগে ট্যাংকি পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে পোকা কমলেও দুর্গন্ধ এখনো পুরোপুরি যায়নি।

লাল ফকিরের গলির একটি বাড়িতে দারোয়ান হিসেবে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন মো. বাবু মোল্লা। তিনি বলেন, আমাদের গলির প্রতিটি বাড়িতে পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। কল ছাড়লেই হলদেটে পানি আসে, মাঝে মাঝে পোকাও ভেসে ওঠে। খাওয়ার পানি কিনে আনলেও গোসল করতে হয় ময়লা পানি দিয়েই, যার ফলে শরীরে চুলকানি হয়ে যায়। বিশেষ করে রোজার সময়ে এই সমস্যায় ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়।

শাপলা গার্ডেন গলির ৬৩/এ বাসায় ভাড়া থাকা বেসরকারি কর্মচারী মো. হামিদুর রহমান বলেন, ওয়াসাকে এই সমস্যার কথা জানিয়েছি। তাদের বক্তব্য, পুরাতন লাইনের সঙ্গে নতুন লাইনের সংযোগ দেওয়ায় পানিতে নোংরার সমস্যা হতে পারে। তারা ট্যাংকি পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছে।

কলাবাগান এলাকা ঢাকা ওয়াসা মডস জোন-৩-এর আওতাধীন। জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত সাহা বাংলানিউজকে বলেন, যে বাড়ির পানিতে সমস্যা রয়েছে, সেই বাড়ির ঠিকানা আমাদের দিন। তারপর আমরা পরিস্থিতি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তার আগে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়।

কলাবাগানের মতো মগবাজার এলাকার অনেক বাসাতেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। মগবাজারের একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. রাজীব বলেন, গত দুই মাস ধরে আমার বাড়ির পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ রয়েছে। বাড়ির মালিককে জানানো হলেও এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মগবাজার চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা সোনিয়া শারমিন বলেন, কল ছাড়লেই হলুদ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি বের হয়। সঙ্গে ছোট ছোট পোকাও দেখা যায়। এই পানি ব্যবহার করলেই বমি আসে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকায় ছেঁকে ব্যবহার করি, তবু দুর্গন্ধ কমে না।

ঢাকা ওয়াসা মডস জোন-৬-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের জনতথ্যে যোগাযোগ করেন। তারাই ভালো বলতে পারবেন।

রামপুরা, কল্যাণপুর ও যাত্রাবাড়ির বাসিন্দারা একই ধরনের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। জুরাইন মুরাদনগর এলাকার বাসিন্দা রকিবুল ইসলাম বলেন, বছরের পর বছর ধরে আমরা এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। আগে পুরাতন লাইনে পানি আসত, তখনও পোকা ভেসে আসত আর দুর্গন্ধ ছিল। নতুন লাইন বসানো হলেও এখনো একই সমস্যা রয়েছে।

বিষয়গুলো নিয়ে কথা হলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মানুষের জীবনের জন্য পানি অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু যদি পানি নোংরা, দূষিত বা জীবাণুযুক্ত হয়, তবে তা অসুস্থতা ও প্রাণহানীর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার ওয়াসার পানিতে যে দূষণ ও দুর্গন্ধ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই পানি পানযোগ্য নয়। এই পানি পান করলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, ফুড পয়জনিংয়ের মতো পানিবাহিত রোগ ছড়াতে পারে। একই পানি দিয়ে গোসল করলে চর্মরোগ হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রায় দুই বছর আগে বিশ্বের একটি সুপরিচিত জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতে পানিবাহিত রোগগুলি ক্রমশ ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এর ফলে সাধারণ ওষুধ দিয়ে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি, ওয়াসার পানিতে ময়লা, দুর্গন্ধ ও দূষণের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। তাই কোনো মানবিক বিপর্যয় ঘটার আগেই এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। বর্তমান সরকারকেও এ বিষয়ে সরাসরি নজর দিতে অনুরোধ করছি।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) সংস্থার সদস্য সচিব ও অ্যাক্টিভিস্ট শরীফ জামিল বাংলানিউজকে বলেন, যদি কেউ তার পানির ট্যাংক পরিষ্কার না করে, তাহলে শুধু ওই বাড়ির পানিতে ময়লা বা পোকা থাকবে, কিন্তু পুরো এলাকায় এমন সমস্যা হবে না। মূল সমস্যা ওয়াসার পানির লাইনে রয়েছে। ওয়াসাও আগে এই বিষয় স্বীকার করেছে। আমাদের দেশে সংস্কারকাজগুলো সমন্বিত না হওয়ায় সমস্যা বাড়ে। যেমন টেলিফোন বা বিদ্যুতের লাইন ঠিক করতে গিয়ে ওয়াসার লাইন কেটে ফেলা হয়, যার ফলে ময়লা ঢুকে পড়ে। এতে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয় এবং এর দায় ওয়াসারই। ওয়াসাকে এই সমন্বয় করতে হবে এবং বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়াসাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনাটাই উচিত।

এসসি/এমএমআই/এমজে



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews