অরুনাচল উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য হলেও এটি নিয়ে চীনের সাথে যে বিরোধ তা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। ১৯১২ সালে অরুনাচল অঞ্চলটি আসামের একটি প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয়। এর নাম দেয়া হয় নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার ট্রেক্ট (এনইএফটি)। ১৯৫৪ সালে এটির নাম বদলে নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি (নেফা) রাখা হয়। ভারত ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এটিকে রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ইটানগর এর রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। রাজ্যটি ভারতের সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত। এর দক্ষিণে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত আসাম ও নাগাল্যান্ড, পশ্চিমে ভুটান, পূর্বে মিয়ানমার ও উত্তরে ম্যাকমোহন লাইনে চীনের তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের সাথে ১১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বিতর্কিত সীমান্ত রয়েছে। চীন অরুনাচল রাজ্যকে সম্পূর্ণরূপে তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের অংশ হিসেবে দক্ষিণ-তিব্বত হিসেবে দাবি করে।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, অরুনাচল প্রদেশের জনসংখ্যা ১৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭২৭। আয়তন ৮৩ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার (৩২ হাজার ৩৩৩ বর্গমাইল)। এটি ভারতের সবচেয়ে কম ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৭ অধিবাসীর বসবাস। এটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজ্য, এর পশ্চিমে প্রধানত মোনপা জনগোষ্ঠী, কেন্দ্রে তানি জনগোষ্ঠী, পূর্বে মিশামি জনগোষ্ঠী এবং তাই জনগোষ্ঠী। রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে নাগা জনগোষ্ঠী বসবাস করে। রাজ্যে প্রায় ২৩টি প্রধান উপজাতি এবং ১০০টি উপ-উপজাতি বাস করে, যার মধ্যে রয়েছেÑ নখতে, আদি, নিশি, সিংফো, গালো, তাগিং, আপাতানি। নিশি এ অঞ্চলের বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। মিশামি জাতি গোষ্ঠীর তিনটি উপজাতি রয়েছে, যথা- ইদু-মিশামি, দিগারো-মিশামি ও মিজু-মিশামি।

অরুনাচল রাজ্যের অর্থ ‘ভারের আলোয়ে ভরা পাহাড়ের ভূমি’, যা সংস্কৃত ভাষায় রাজ্যের উপাধি। রাজ্য গঠনের সময় শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এ ভূখণ্ডটিকে তিব্বতের অংশ বলে দাবি করে। এটিকে দক্ষিণ-তিব্বত বলে যার চীনা ভাষায় নামকরণ জাংনান। প্রাচীন তিব্বতি গ্রন্থে পূর্ব অরুনাচল প্রদেশ এবং তিব্বতের কিছু অংশকে লোয়ু বলা হতো। যেখানে বসবাসকারীদের লোবা বলা হতো। পশ্চিম অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং জেলা এবং পশ্চিম কামেং জেলাকে মন্যুল বলা হতো।

অরুনাচলের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। প্রধান শস্য ধান। এছাড়াও যব, বজরা, গম, ডাল, আলু, আখ, ফলমূল, তেলবীজ প্রভৃতি চাষ করা হয়। চাষের ক্ষেত্রে জুম চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাহাড়ের একটি নির্দিষ্ট অংশের সব গাছ কেটে ফেলে সেখানে কয়েক মৌসুম চাষ করা হয়। এরপর চাষের জায়গা নতুন এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। এর ফলে বনজসম্পদের ক্ষতি হয়। অরুনাচল রাজ্যে কিছু কলকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে কাঠ কাটা, ধান ও তেলের কল, সাবান ও মোমবাতি তৈরির কারখানা এবং রেশম ও হস্তশিল্প উল্লেখযোগ্য। অরুনাচলের অরণ্য, নদী, কয়লা, তেল ও অন্যান্য খনিজের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এখনো পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করা হয়নি। অংশত রুক্ষ ভূপ্রকৃতির কারণে এমনটি ঘটেছে। ১৯৯২ সালে রাজ্যটিতে সীমিত আকারে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

অরুনাচল রাজ্যে একটি এক আইনসভা আছে, যার আসনসংখ্যা ৬০। রাজ্যটি থেকে ভারতের জাতীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভায় দু’জন এবং উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় একজন প্রতিনিধি পাঠানো হয়। রাজ্যটির স্থানীয় সরকার প্রশাসন ১২টি প্রশাসনিক জেলায় বিভক্ত।

ব্রিটিশরা হিমালয়ের শীর্ষ রেখাকে সীমান্ত হিসেবে প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু চীনারা তা প্রত্যাখ্যান করে। এ প্রস্তাবিত রেখাটি ম্যাকমোহন রেখা নামে পরিচিত। বর্তমানে এটি কার্যত ভারত-চীন সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪৭ সালে চীন প্রায় সম্পূর্ণ অরুনাচল প্রদেশের উপর কর্তৃত্ব দাবি করে। ১৯৫৯ ও ১৯৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে চীনা সেনারা বেশ কয়েকবার ম্যাকমোহন রেখা অতিক্রম করে সাময়িকভাবে ভারতের সীমান্ত ঘাঁটিগুলো দখল করে। ১৯৬২ সালে চীন অরুনাচল রাজ্য থেকে পশ্চাৎপসরণ করে। এর পর বহুবার সীমান্ত বিরোধ সমাধানের চেষ্টা করা হলেও আজও কোনো সমঝোতা হয়নি।

রাজ্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো কাংটো, যার উচ্চতা সাত হাজার ৬০ মিটার (২৩ হাজার ১৬০ ফুট)। প্রধান গরিচেন শৃঙ্গ, নয়েগি কাংসাং ও পূর্ব গরিচেন শৃঙ্গ হলো হিমালয়ের অন্যান্য উচ্চ শৃঙ্গ। অরুনাচল রাজ্যের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- কামেং, সুবান সিড়ি, সিয়াং (ব্রহ্মপুত্র), দিবাং, লোহিত ও নোয়া দিহিং নদী। ভূপৃষ্ঠের প্রবাহ এবং গ্রীষ্মকালীন তুষার গলে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সিয়াং নদীর পূর্ব পর্যন্ত পর্বতমালা পূর্ব-হিমালয় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। সিয়াং এবং নোয়া দিহিংয়ের মধ্যবর্তী পবর্তমালা মিশামি পাহাড় হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তিরাপ এবং লংডিং জেলায় নোয়া দিহিংয়ের দক্ষিণে অবস্থিত পর্বতমালা পাটকাই পর্বতমালার অংশ।

অরুনাচল রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম বিদ্যমান। ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড এর চাংলাং এবং তিরাপ জেলায় ব্যাজ ক্যাম্প রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো এ অঞ্চলে ভারত সরকারের প্রভাব হ্রাস এবং অরুনাচল রাজ্যের কিছু অংশ নাগাল্যান্ডের সাথে একীভূত করতে চায়।

অরুনাচল রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার নাম চীন অনেকদিন ধরে বদলে দিচ্ছে। এবার চীন রাজ্যটির আরো ৩০টি এলাকার নাম তাদের পছন্দ মতো বদলে দিয়েছে। এবার নিয়ে চতুর্থবারের মতো চীন অরুনাচলের কিছু এলাকার নাম পরিবর্তন করে নিজেদের মতো করে রাখল। এবার ১১টি আবাসিক এলাকা, ১২টি পার্বত্য এলাকা, চারটি নদী, একটি হ্রদ, একটি গিরিপথ ও একটি ফাঁকা ভূমির নতুন করে নামকরণ করেছে চীন। এর আগে ২০১৭, ২০২১ ও ২০২৩ সালে চীন তিন দফায় অরুনাচলের বিভিন্ন এলাকার নাম নিজেদের মতো করে রেখেছিল।

চীনের দাবি, জাংনান নামক অরুনাচল রাজ্যটি দক্ষিণ-তিব্বতের অংশ। মাঝে মধ্যে চীন অরুনাচল রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার নাম নিজেদের মতো করে রাখে। ভারত প্রতিবার সে উদ্যোগ অসাড় ও অহেতুক জানিয়ে বলে আসছে অরুনাচল রাজ্য ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, আছে ও থাকবে।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন চীনা প্রশাসন ম্যাকমোহন লাইন বৈধ নয় বলে অবস্থান বজায় রাখে।

১৯৪৭ সালের অক্টোবরে স্বাধীন তিব্বত একটি নোট লিখে ব্রিটিশরা তিব্বত থেকে যে অঞ্চলগুলো দখল করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেগুলো ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। এর মধ্যে জায়উল, ওয়ালং, কিমাকো, লোনাগ, লোপা, মোন, ভুটান, সিকিম ও দার্জিলিং অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত সরকারের সাথে আলোচনার পর তিব্বত এ অঞ্চলগুলোর উপর দাবি ত্যাগ করে।

১৯৫০ সালের নভেম্বরে পিআরসি (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) বল প্রয়োগে তিব্বত দখলে প্রস্তুত ছিল। ভারত সে সময় তিব্বতকে সমর্থন করেছিল। সে সময় চীন তিব্বতিদের পক্ষে তাওয়াং দাবি করলেও তিব্বতিরা তাওয়াংকে তিব্বতের অংশ বলে দাবি করেনি।

১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত মনিপুরের রালেংনাও খাথিংকে একটি ছোট স্কট এবং কয়েক শ’ কুলিসহ তাওয়াং পাঠায়। একইসাথে তিব্বতিদের কাছ থেকে তাওয়াং অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিব্বতি প্রশাসনকে সরিয়ে দেয়। তখন সেখানকার জনগণ অত্যাচারী সামন্ততান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি হিসেবে ভারতীয় প্রচেষ্টাকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানায়।

১৯৬০ সাল পর্যন্ত চীন-ভারত সম্পর্ক ছিল আন্তরিক। সীমান্ত বিরোধের জের ধরে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যে যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধের সময় চীন তাওয়াং অঞ্চলসহ অরুনাচল রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। চীন নিজেদের বিজয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি টানে। সেই সাথে ম্যাকমোহন লাইনে ফিরে যায়। তৎপরবর্তী ১৯৬৩ সালে চীন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে দেয়।

অরুনাচলকে ভারত ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিলেও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। অরুনাচলের দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে ১৯৬২ সাল-পরবর্তী প্রায় ভারত ও চীনের মধ্যে সঙ্ঘাত দেখা দেয়। এ সঙ্ঘাতের স্থায়ী সমাধান ব্যতীত ভারত ও চীনের মধ্যে যে সীমান্ত বিরোধ তার পুনঃপুন আবির্ভাব ঘটবে। এছাড়া অঞ্চলটির নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। সুতরাং স্থলবেষ্টিত অরুনাচল নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যে বিরোধ এর চিরস্থায়ী সমাধান করা না গেলে কখন কী ঘটে তা বলা দুরূহ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail :
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews