পাঠক হিসেবে আপনার জন্য একটি প্রশ্ন, আপনাকে যদি বলি, এই লেখাটি কোনো মানবলেখকের নয়, বরং একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা বা আরও সহজ করে বললে- একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের লেখা, তবে তা পড়ার সময় আপনার অনুভূতি কেমন হবে? মানবরচিত কোনো লেখা পড়ার মতোই, নাকি আরও বেশি রোমাঞ্চকর? নাকি অনুভূতিহীন এক যন্ত্রের সৃষ্টি হওয়ায় লেখাটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে? 

এতদিন পর্যন্ত কোনো বিষয়ের ওপর কোনো লেখা পড়লে তা যে মানবরচিত, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা ছিল না। তবে বর্তমান সময়ে বিষয়টি আর পুরোপুরি সত্য না হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। ব্যাখ্যা শুরু করা যাক সবচেয়ে কাছের উদাহরণটি দিয়ে।

এখনকার স্মার্টফোনের কিবোর্ড অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে বেশ জনপ্রিয় ফিচারগুলোর একটি হলো ‘নেক্সট ওয়ার্ড সাজেশন’। কোনো বাক্য লেখার সময় একটি শব্দ লেখার পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুমান করে নেয়, পরবর্তী শব্দটি কী হতে পারে। অনুমান অনুযায়ী সর্বোচ্চ সম্ভাব্য শব্দটিসহ আরও একাধিক সম্ভাব্য শব্দ প্রদর্শন করে স্ক্রিনে। অনেক সময় সেই অনুমান মিলেও যায়।

এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের মাথায় শুরুতেই আসে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিরি কিংবা অ্যামাজন অ্যালেক্সার নাম। কিন্তু এবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক নতুন আরেক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। নির্মাতা অ্যাডাম কিংয়ের নাম দিয়েছেন টক টু ট্রান্সফরমার। এর বিশেষত্ব জানার আগে চলুন নিচের অংশটি মনোযোগ সহকারে পড়া যাক।

It was cold inside the house. Darknes seemed to be swallowing me, an unknown fear was playing in my thoughts. I felt like I was not alone in the house. Then it happened, suddenly a cold wave flowed down my spine. And then I felt like I was walking on air, even though Im actually froyen. I was flying. ¸ brain was unable to process what was happening, which is why I knwe that I must have had a stroke or some sort of temporary death, but I didnt knwo hwo long it would be. The thing was so bi“arre and so different to the whole state of mind that I had just started to feel a strong physical sensation in my hands. I was trying to look at the outside world, but nothing was….

এর বাংলাটুকু পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো,

ভেতরে খুব ঠান্ডা ছিল। মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকার আমাকে গ্রাস করছে, একটা অজানা ভয় আমার চিন্তা-ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ঘরটায় আমি একা নই। তারপরই ব্যাপারটি ঘটল। হঠাৎ আমার মেরুদ- দিয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। এবং তখন আমার মনে হলো, আমি বাতাসে হাঁটছি, যদিও আমি আসলে জমে গিয়েছিলাম, তারপরও আমি উড়ছিলাম।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটছে, আমি ভাবছিলাম আমার কোনো ধরনের স্ট্রোক বা সাময়িক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম না এর স্থায়িত্ব কতক্ষণ হতে পারে। বিষয়টা এতই অদ্ভুত এবং আমার মানসিক অবস্থার জন্য অন্যরকম ছিল যে আমার হাতে একটা জোরালো শারীরিক অনুভূতি হচ্ছিল। আমি বাইরে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুই ছিল না।

উপরের অনুচ্ছেদটি কোনো অতিপ্রাকৃতিক উপন্যাসের অংশ নয়। শুরুর বোল্ড করা অংশটুকু ‘টক টু ট্রান্সফরমার’-কে ইনপুট দেওয়ার পর বাকি অংশটুকু সেই এআই সম্পূর্ণ নিজের মতো করে লিখেছে। অর্থাৎ, মানুষের লেখার অনুকরণের চেষ্টা করেছে কোনো রকম টেমপ্লেট ব্যবহার ছাড়াই, এমনকি তা কোথাও থেকে সংগৃহীতও নয়। শুধু গল্পের অংশটুকু পড়েই কি আপনি বুঝতে পারতেন, লেখাটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট নয়?

‘নেক্সট ওয়ার্ড সাজেশন’ কিংবা এরকম ‘টেক্সট জেনারেটিং’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা হলো ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলিং। ‘টক টু ট্রান্সফরমার’ এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে আরও বেশি উন্নত মডেল, ওপেনএআই ইনকর্পোরেটেডের তৈরি ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল জিপিটি-২। তবে এসব ক্ষেত্রে মডেলগুলোর জন্য ‘ফ্যাক্ট’ সৃষ্টির থেকে ‘ফিকশন’ লেখা অনেক বেশি সহজ।

২০১৭ সালের শেষদিকে বটনিক স্টুডিওজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে জে.কে. রাওলিংয়ের আসনে বসায়। হ্যারি পটার সিরিজের সব ক’টি উপন্যাস বিশ্লেষণ করে সে এআই আরেকটি গল্প লিখে, যার শিরোনাম ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য পোর্ট্রেট অব হোয়াট লুকড লাইক অ্যা লার্জ পাইল অব অ্যাশ’। হাস্যকর এই শিরোনামের তিন পৃষ্ঠার বইটি হাসির খোরাক জোগালেও পাঠক প্রতিক্রিয়া অনুসারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা খুব একটা খারাপ ছিল না। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই দক্ষতা কেবল গল্পের অংশ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তৈরি করেছে কাব্যগ্রন্থ, লিখেছে সংবাদ আর আর্টিকেলও।

গ্রোভার নামের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের ওপর ভিত্তি করে অ্যাডাম গেটজি তৈরি করেছেন ‘নিউজ ইউ কান্ট ইউজ’ নামের এক ওয়েবসাইট, যেখানে কেবল ভুয়া সংবাদ রয়েছে, যার সবটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লিখেছে। ৫,০০০-এর বেশি পাবলিকেশনের নিউজ আর্টিকেল দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে এই মডেলকে। মজার বিষয় হলো, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লেখার সামঞ্জস্য বজায় রাখলেও তথ্যের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারেনি সেই মডেলটি, কেবলই তা মানুষের সংবাদ লেখার ধরন অনুকরণ করেছে।

ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ব্যবহার করে লেখা হচ্ছে সিনেমার স্ক্রিপ্টও। এমনই আরও অনেক উদাহরণ তুলে আনা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৃতিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয়, ভবিষ্যতে মানুষের সঙ্গে সৃজনশীল এই প্রতিভার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? সত্যিকার লেখক কি তার স্থান হারাবে, ঠিক যেভাবে রোবটের কাছে চাকরি হারাচ্ছে মানুষ? নাকি নতুনত্বের প্রতি আমাদের এই শঙ্কা একেবারেই অমূলক?

শুরু থেকে বর্ণনা দিয়ে আসা এত কেচ্ছা-কাহিনীর মূলে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যা হলো তথ্য বা ডাটা। মেশিন যা কিছু করে, যা কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, তা সবই তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। এখানে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করে নতুন কোনো তথ্য সৃষ্টি করে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি গল্প বা উপন্যাস কেবলই কিছু শব্দ নিয়ে গঠিত বাক্যের পুনর্বিন্যাস নয়। একেকটি উপন্যাস একইসঙ্গে একেকটি অভিজ্ঞতা, অভিব্যক্তি এবং নতুনত্বের বহির্প্রকাশ। অনুভূতিহীন, অভিজ্ঞতাহীন একটি কম্পিউটার যে বিষয়ে এখনও একেবারেই দক্ষ নয়। তথ্য নিয়ে কাজ করতে অভিজ্ঞ হলেও সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির প্রয়োগ জানে না এই কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলো।

একটি বিষয় এখানে মাথায় রাখা জরুরি- রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিন্তু মানুষের কর্মসংস্থান সংকটে ফেলছে না, বরং কর্তৃপক্ষই লাভের আশায় কর্মী ছাঁটাই করছে। ভবিষ্যতের প্রকাশনা সংস্থাগুলো অবশ্যই লাভের অঙ্কটা বেশ ভালোমতোই হিসেব করবে, কারণ এআই জেনারেটেড কোনো বইয়ের জন্য কম্পিউটারকে এর লভ্যাংশ দেওয়া লাগবে না।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপন্যাস লেখার থেকেও আরও বড় চিন্তার বিষয় আছে এ প্রযুক্তি নিয়ে, তা হলো পক্ষপাতিত্ব। নিরপেক্ষ ফলাফলের আশায় আমরা দ্বারস্থ হয়েছি প্রযুক্তির। কিন্তু বাস্তবেই কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে?

এসব ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল দিয়ে খুব সহজেই তৈরি করা সম্ভব ভুয়া সংবাদ, বিতর্কিত বিষয়ের ওপর লেখা কিংবা বর্ণবাদ বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন খবর। ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ভুল স্থানে প্রযুক্তির প্রয়োগের মাশুল কীভাবে গুনতে হয়। ভুল হাতে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার যে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অন্যতম অস্ত্র, তা চিন্তা করা খুব কঠিন কিছু নয়। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট জুড়ে যেখানে ভুয়া সংবাদের বিচরণ, সেখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি ভুয়া সংবাদ আগুনে ঘি ঢালার শামিল। পণ্যের ভুয়া রিভিউ কিংবা অনলাইনে মানুষের সঙ্গে তর্কেও জড়াতে পারে এ প্রযুক্তি।

তবে যে প্রশ্নটি এখন গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- নতুন সৃষ্টি হওয়া এসব কন্টেন্ট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার? স্বত্বাধিকার কিংবা দায়বদ্ধতাই বা কার? যেসব আইন প্রচলিত আছে, তার বেশিরভাগ এসব প্রযুক্তির জন্য পরিষ্কারভাবে কিছু নির্ধারণ করে না। অনেক সময় আইনের থেকে প্রযুক্তির উন্নয়ন হয় দ্রুত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগুলোর কার্যপদ্ধতি আরও জটিল হচ্ছে, জনসাধারণে জন্য তা বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রযুক্তির স্বচ্ছতা তুলে ধরছে না। প্রযুক্তির কল্যাণে পর্দার অপর পাশে থাকা ব্যবহারকারী নিয়ে আগেও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে গুগল ডুপ্লেক্সের মতো প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুকরণ করেছে মানুষের চেহারা, কণ্ঠ; আর এখন করছে ভাষা। মানুষে মানুষে যেখানে অনলাইন নিরাপদ জায়গা নয়, সেখানে কৃত্রিম এই বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews