অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ একজন অসাধারণ ভালো মানুষ, আদর্শ শিক্ষক ও দক্ষ প্রশাসক ছিলেন।  তিনি ছিলেন আমার একজন প্রিয় মানুষ, অনেক প্রিয় মানুষ। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় ঢাকায় তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অতঃপর তাঁকে সিলেট এমসি কলেজে বদলি করা হয়। তিনি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সিলেট থেকে তাঁকে পাঠানো হয় যশোর। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেখান থেকে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। তাঁর মানবিক ও প্রশাসনিক গুণাবলি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তাঁর পিতা অধ্যাপক আবু হেনা সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ও এস এম (সলিমুল্লাহ) হলের প্রভোস্ট ছিলেন। মরহুম মেজর জেনারেল আনিস ওয়ায়েজ অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজের ছোট ভাই। অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ এবং তাঁর পিতা অধ্যাপক আবু হেনা ছিলেন বিরল প্রকৃতির ভালো মানুষ। তাঁরা ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, নিয়মনিষ্ঠ ও দক্ষ প্রশাসক। তাঁরা ছিলেন কঠোর ও কোমলের সমাহার। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন কোমলপ্রাণ ও ছাত্রবৎসল। প্রশাসক হিসেবে ছিলেন দক্ষ, বন্ধুবৎসল, কিন্তু প্রয়োজনে কঠোর। নিজেরা নিয়ম-নীতির মধ্যে চলতেন, অন্যরাও যাতে নিয়ম-নীতি মেনে চলেন তা নিশ্চিত করতেন।

অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ এবং আমি প্রায় দুই বছর একসঙ্গে কাজ করি। আমি গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। তিনি আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ। জেলা প্রশাসক কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। তবে কলেজের অধিকাংশ কাজই জেলা প্রশাসকের পক্ষে আমাকেই করতে হয়। তাই হাসান ওয়ায়েজ এবং আমার মধ্যে ঘনিষ্ঠ কর্ম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কর্মসংযোগ আত্মার সংযোগে রূপান্তরিত হয়। যে কোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যৌক্তিক আচরণকে দ্বিতীয় ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ ছিলেন অসাধারণ। তিনি বয়সে আমার অনেক বড়। গাজীপুরে আসার আগে পদেও তিনি আমার থেকে অনেক ওপরে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আমরা গাজীপুর আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষের শূন্যপদ পূরণের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করি। নির্ধারিত তারিখে প্রার্থীরা হাজির হন। মোট আটজন প্রার্থী ছিলেন। আমার সভাপতিত্বে বাছাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসান ওয়ায়েজ সাহেব ছিলেন সেরা প্রার্থী। ফলে নতুন অধ্যক্ষ খুঁজে পেতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি বেসরকারি কলেজ। তবে সচ্ছল ও সুনামধারী। কলেজটি বেশি প্রাচীন নয়। কলেজটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৮১ সালের ৪ জুলাই। এখন কলেজটির বয়স মাত্র ৪২ বছর। সবার মুখে মুখে এটি শোনা যায় যে, গত ৪২ বছরের মধ্যে হাসান ওয়ায়েজ সাহেব ছিলেন এ কলেজের সেরা অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ হিসেবে সব মানদন্ডেই তিনিই সেরা। একজন সেরা মানুষকে বাছাই করতে পারার কৃতিত্ব আমাকে আনন্দ দেয়। আমি মনে করি, কাজী আজিম উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজের মতো একজন উঁচু মাপের শিক্ষককে বাছাই করতে পারা আমার কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি। এখানে গাজীপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলামকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা জরুরি। কারণ তিনি আমাকে অধ্যক্ষ বাছাইয়ের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ কেন অসাধারণ ছিলেন। তিনি ছিলেন একান্তই সময়নিষ্ঠ একজন মানুষ। তাঁর বাসা ছিল মোহাম্মদপুর। সেখান থেকে তিনি মহাখালী যেতেন। মহাখালী থেকে বাসে গাজীপুরের পুকুরপাড় বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেন। সেখান থেকে রিকশায় কলেজে। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। তা সত্ত্বেও ঝড়, বৃষ্টি, শীত কোনো কিছুই তাঁর সময়নিষ্ঠতায় আঘাত হানতে পারেনি। তিনি সব কিছু উপেক্ষা করে কলেজের কার্যক্রম শুরুর আধা ঘণ্টা আগে কলেজে উপস্থিত হতেন। এক দিনও ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রতিদিনই তিনি সবার পরে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করতেন। এক দিনও এ অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটেনি। সময়নিষ্ঠতায় তিনি ছিলেন রোল মডেল। অধ্যক্ষকত্ব শুধু শিক্ষকতার চাকরি নয়, এটি লিডারশিপ বা কমান্ডারশিপের চাকরি। তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা প্রশাসনিক লিডার। তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল দৃশ্যমান। তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করতেন। তাঁর অধ্যক্ষ থাকাকালীন কলেজে কোনো দলাদলি ছিল না। তখন কাজী আজিম উদ্দিন কলেজ ছিল এক আদর্শ বিদ্যাপীঠ।

পিতা ও পুত্র একই কলেজের অধ্যক্ষ : অধ্যাপক হাসান ওয়ায়েজ ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর পিতা অধ্যাপক আবু হেনা ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম (সলিমুল্লাহ) হলের প্রভোস্ট ছিলেন। এমসি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮২ সালে। গত ১৪১ বছরে তাঁরাই একমাত্র পিতা-পুত্র অধ্যক্ষ।  পিতা ও পুত্র দুজনই ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবুও কার কী গুণ ছিল, কে বেশি সেরা ছিলেন, এ বিষয়ে একটি গবেষণা করা যায় না?

আল্লাহ রব্বুল আলামিন অধ্যক্ষ আবু হেনা এবং অধ্যক্ষ হাসান ওয়ায়েজকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা করুন। তাঁদের পরিবার-পরিজনকে ভালো রাখুন। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব লেখক ও গবেষক।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews