দেশের রফতানি বাণিজ্যে তৈরী পোশাক (আরএমজি) ও টেক্সটাইল খাত নিরঙ্কুশ আধিপত্য ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ে তৈরী পোশাকবহির্ভূত (নন-রেডিমেড গার্মেন্টস/নন-আরএমজি) খাতগুলোর অবদান গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। বরং এ খাতগুলোর অংশ প্রায় স্থির রয়েছে। এর মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্যে বহুমুখীকরণে পর্যাপ্ত অগ্রগতি না হওয়ার ইঙ্গিত দেয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এতে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধির বড় অংশ এখনো গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাতের ওপর নির্ভরশীল বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি আয় হয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত থেকে এসেছে ৪০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার, যা মোট আয়ের ৮৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। বাকি ১৫ দশমিক ৯১ শতাংশ বা ৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার এসেছে নন-আরএমজি খাত থেকে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, হিমায়িত ও জীবিত মাছ এবং প্রকৌশলজাত পণ্য।
তথ্যে দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় গত এক দশকে গার্মেন্টস খাতে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি বৃদ্ধি পেলেও নন-আরএমজি পণ্যে তেমন প্রবৃদ্ধি আসেনি। ২০১৬-১৭ সালে রফতানি আয় ছিল ৩৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২৯ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার এসেছে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত থেকে (৮৩ দশমিক ৪০ শতাংশ)। বাকি ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এসেছিল অন্যান্য খাত থেকে। নন-আরএমজি খাতের অনেক উপখাতে রফতানি হ্রাস পাওয়ায় এই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আচিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, হিমায়িত খাদ্য রফতানি খাত গত এক দশক ধরে ক্রমাগত নিম্নমুখী রফতানির মুখোমুখি। কাঁচামালের ঘাটতি, উৎপাদন হ্রাস, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, ব্যাংক ও অবকাঠামো সুবিধার অভাবে এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশ এখনো প্রথাগত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে, যার ফলে প্রতি হেক্টরে মাত্র ৩৫০-৫০০ কেজি উৎপাদন হয়। যেখানে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো ভেননামি জাতের কম দামে বেশি উৎপাদনযোগ্য চিংড়ি চাষ করে, প্রতি হেক্টরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অনেক চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গত পাঁচ থেকে সাত বছরে বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো এখনো চালু আছে, সেগুলোর অনেকগুলোই সক্ষমতার অনেক নিচে পরিচালিত হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে দেশে ১১২টি মাছ প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট থাকলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০-২৫টিতে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হিমায়িত ও জীবিত মাছ রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৪৪১ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৬-১৭ সালের ৫২৬ দশমিক ৪৫ মিলিয়নের তুলনায় কম।
তথ্যে দেখা যায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি আয় ছিল ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ৮২০ দশমিক ১৬ মিলিয়নে। বাংলাদেশ পাটকল মালিক সমিতির (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মো: আবুল হোসেন বলেন, পাটের দাম কৃষকের পর্যায়ে কম থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। সেই সাথে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প বাজারও কমে গেছে। এ ছাড়া ভারতের জারি করা অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক ও পাটজাত পণ্যের ওপর নগদ প্রণোদনার হার কমে যাওয়াও খাতটির ক্ষতির অন্যতম কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৬-১৭ সালে এ খাত থেকে রফতানি আয় ছিল ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১৪ বিলিয়নে।
কৃষিপণ্য রফতানি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করলেও এরপর তা স্থিতিশীল থাকেনি। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে রফতানি হয়েছে ৯৮৮ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলারের, যা ২০১৬-১৭ সালের ৫৫৩ দশমিক ১৭ মিলিয়নের তুলনায় বেশি হলেও বিগত বছরের তুলনায় কম।
আলিন ফুডস এক্সপোর্ট লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, পূর্বে এই খাতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ছিল, যা কমে বর্তমানে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে ক্ষুদ্র রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, উপযুক্ত কার্গো সুবিধার অভাব এবং উচ্চ ভাড়ার কারণে এ খাতটির সক্ষমতা আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়নি বলে তিনি জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানি খাতের স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য তৈরী পোশাক নির্ভরতা কমিয়ে পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। নন-আরএমজি খাতগুলোর প্রতিটি নির্দিষ্ট সমস্যার দ্রুত সমাধান না করা গেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো ঝুঁকির মুখে পড়বে। তারা মনে করছেন, উচ্চ উৎপাদনশীল জাতের চিংড়ি চাষে উদ্ভাবন, পাট ও চামড়া খাতে আধুনিকীকরণ, কৃষিপণ্যের রফতানিতে প্রযুক্তি ও পরিবহন সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং পর্যাপ্ত নগদ সহায়তা প্রদান এসব পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।