বিএনপি দুজন ছাত্র উপদেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, এনসিপি তিনজনকে বিএনপির লোক বলে দাবি করল। বিএনপিও পিছিয়ে থাকবে কেন, তারাও তালিকায় আরেক জনের নাম যোগ করে ফেলল। গ্রাফিক: মো. নুরুল মোস্তফা জিনাত
বিএনপি দুজন ছাত্র উপদেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, এনসিপি তিনজনকে বিএনপির লোক বলে দাবি করল। বিএনপিও পিছিয়ে থাকবে কেন, তারাও তালিকায় আরেক জনের নাম যোগ করে ফেলল। গ্রাফিক: মো. নুরুল মোস্তফা জিনাত
বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে এতদিন ঠান্ডা যুদ্ধ চললেও হঠাৎ তা উনুনের আঁচে উত্তপ্ত হয়ে চরমে পৌঁছে গেছে। কেন এই উত্তপ্ত যুদ্ধ? কারা এই উনুনে জ্বাল দিলেন, আর কারা ইন্ধন জোগালেন, তা নিয়ে পরে আলোচনা করব। প্রথমে দেখা যাক, এই লড়াইয়ের কারণ কী? দুটি দলই ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে দেশ এখন ফ্যাসিস্টমুক্ত এবং সকলেই গণতন্ত্রের সিঁড়ি ধরে এগোবে। কিন্তু হঠাৎ ওই সিঁড়ি রাজপথে চলে এল কেন? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরুর আগেই কেন উভয়পক্ষ যুদ্ধের মেজাজে মাঠে নেমে পড়ল? সংক্ষেপে দুটি কারণ:
১. ছাত্রনেতারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, যদিও স্বল্প সময়ের জন্য। তারা আটঘাট বেঁধে নতুন দল গঠন করে ক্ষমতার পরিসর বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রয়োজনে নির্বাচনকে কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা যায় কিনা ওই চেষ্টাও করছেন বলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অভিযোগ। কিন্তু বিএনপি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ আয়ত্তে নেওয়ার জন্য যেভাবে তৎপর হয়েছে, তাতে এনসিপি নেতারা ক্ষুব্ধ। নির্বাচন হয়নি, ভোট হয়নি—তাহলে মেয়র পদ কীভাবে তাদের হবে?
২. বিএনপি ১৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক হারিকিরি করার পর ক্ষমতা তাদেরই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা ভাগাভাগি বা ‘কোয়ালিশন’ও হয়তো চলত, কিন্তু বিএনপিকে একেবারে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে না দেওয়ার চেষ্টা কীভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব?
আসলে এই দুটি বিষয় একই আয়নার এদিক-ওদিক। উভয় দলই ক্ষমতার জন্য লড়ছে। বিএনপি শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং অংশ নিয়েও পস্তিয়েছে। অনেক নির্বাচন বয়কটও করেছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা সফল হয়েছে। তাপসের পলায়ন, বিচারকদের সম্মতি, নির্বাচন কমিশনের অনাপত্তি— সব মিলিয়ে এই নির্বাচন তখন না হলেও এখন বিএনপির জন্য সৌভাগ্য বইয়ে এনেছে। ভাগ্যিস তারা তখন এই নির্বাচনটা বয়কট করেনি!
যারা ক্ষমতা চাই না, বা বলা ভালো, যারা ক্ষমতা পায় না, তাদের জন্য এটা বড় দুর্ভোগ। সিটি করপোরেশনে আমাদের কত কাজ! বিল আটকে আছে, দেনদরবার ফাইনাল, এখন শুধু চেকের অপেক্ষা। না পেলে সাব-কন্ট্রাক্টররা হয়তো পেটাতে আসবে। ট্রেড লাইসেন্স, পানির লাইনের জন্য রাস্তা কাটার পারমিট, জন্ম সনদ—এসবের কী হবে? শাহবাগ পিজি হাসপাতালে যেতে চান? রাস্তা বন্ধ। রোগীদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু রোগীরা অপেক্ষা করবে কি না, কে জানে!
ওই শেখ হাসিনার আমলে ইমরান এইচ সরকাররা যে শাহবাগ খুলেছিলেন, তারপর আর বন্ধ হয়নি। কত কত লোকের দাবি দাওয়া জানাতে কত সুবিধা এখন। যারা ইমরানদের গণজাগরণ মঞ্চকে পছন্দ করতেন না বা শাহবাগকে আগে ঝামেলামুক্ত রাখতে বিবৃতি দিয়েছেন, তারাও এখন দাবি-দাওয়া নিয়ে শাহবাগেই ধরনা দিচ্ছেন।
এবার মূল কথায় আসি। গণতন্ত্রের সিঁড়িটা রাস্তায় টেনে আনল কে? এই সিঁড়ি অনেকদিন ধরে নড়বড়ে ছিল। সংস্কারের কথা শুনতে শুনতে বিএনপি অধৈর্য হয়ে গেছে। তাদের কত জাঁদরেল নেতা, কত মন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতায় থাকতে তারা কত সংস্কার করেছেন! এনসিপির নেতারা তখন হয়তো সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, কেউ কেউ বড়জোর প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তাই তাদের জানার কথা নয়। বিএনপি চায় নিজেরা ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার করতে। তবু অন্তর্বর্তী সরকার যদি কিছু টুকটাক সংস্কার করে, তাতে ক্ষতি নেই। তবে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে, মাঠে বেশি লোক জড়ো হওয়ার আগে।
এনসিপি শুনবে কেন? তারা সবে দল গোছানো শুরু করেছে। এতে সময় তো লাগবেই। এর মধ্যে দেশের পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুন করে সংস্কার করতে হবে। কিছু সময় লাগলেও ক্ষতি নেই, মজবুত হবে বলে! দেশের ঘর মজবুত করার পাশাপাশি তাদের সবার না হলেও কারও কারও নিজেদের ঘরও গোছানো হয়ে যাবে। কিন্তু বিএনপি এতটুকু সময় দিতে রাজি নয়। তারা বলে, আর কত অপেক্ষা করতে হবে?
এর মধ্যে বিএনপির এক তরুণ নেতা বুদ্ধি বের করলেন— পুরোনো ভোটের ফাইল খুলে নগর ভবনে যাওয়া যায় কি না? বাকিটা আপনারা জানেন। প্রথমে রাস্তাঘাট বন্ধ করে আন্দোলন শুরু হলো, সিনিয়র নেতারা তা পছন্দ করেননি। সংস্কারের সময় জনগণ কী ভাববে? কিন্তু তরুণদের যুগে বড়দের কথা কে শোনে? তারাই উনুন গরম করলেন। আন্দোলন উত্তপ্ত হতেই সিনিয়র নেতারা যোগ দিলেন। জুলাই আন্দোলনের দুই নেতা, যারা এখনও সরকারে কাজ করছেন, তাদের সরানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি জানানো হলো। ধীরে ধীরে কিছু ইতিবাচক খবর আসতে শুরু করল। আপনারা সবাই এইসব খবর জানেন। আমি লক্ষ্য করেছি, বিএনপির উৎসবে এখনও দুজন মানুষ মিসিং।
এই দুজনের একজন তারেক রহমান দূরে থাকেন, তিনি না হয় না থাকলেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? তিনি ভদ্রলোক। হয়তো রাস্তা বন্ধ করে দাবি আদায় তার পছন্দ নয়। তিনিও হয়তো দেশেই আছেন, নতুবা ব্যাংকক, হংকং কোথাও একটা আছেন।
এদিকে এনসিপি দেখল, নগরপাল নিয়ে হাতাহাতি করে লাভ হবে না। কোর্টের রায়, নির্বাচন কমিশনের সম্মতি—সবই তাদের বিপক্ষে। তবে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা তাদের পক্ষে, তার হাতে কিছু ক্ষমতা আছে। এনসিপি তাই অন্য দিকে নজর দিল। তারা নির্বাচন কমিশন ও তার সব কমিশনারদের বিদায় করার দাবি জানাল। এক ঢিলে দুই পাখি—এতে সাধারণ নির্বাচনেও কাজে আসবে।
বিএনপি দুজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, এনসিপি তিনজনকে বিএনপির লোক বলে দাবি করল। আশ্চর্যের বিষয়, এদের একজনকে ছাত্রনেতাদের গুরু মনে করা হতো। রাজনীতির খেলা! বিএনপিও পিছিয়ে থাকেনি, পরের দিন তারা তাদের তালিকায় আরেকজনের নাম যোগ করল। এখন সমানে সমান—৩+৩=৬ জন উপদেষ্টা ‘অপারেশন ক্ষমতার প্রিভিউ’-এর শিকার।
আমি শুধু রানিং কমেন্টারি দিলাম। চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে অনেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই রাউন্ডে বিএনপির পাল্লা একটু ভারী মনে হচ্ছে। পাল্লার কথা উঠতেই, আসল পাল্লাওয়ালা জামায়াতে ইসলামী কোন দিকে যোগ দেবে, সেটাও দেখার বিষয়।
এনসিপির নাহিদ ইসলাম তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞ। বয়সে ছোট হলেও তিনিও হৈচৈয়ের সময় মির্জা ফখরুলের মতো চুপ ছিলেন। তবে তিনি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ড. ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। জানা গেছে, দেশের পরিস্থিতিতে তিনি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এরপর কী হবে? আমার মনে হয়, ড. ইউনূসের পদত্যাগের দায় কেউ নিতে চাইবে না। বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান এখনো লন্ডনে। তাহলে ড. ইউনূস পদত্যাগ করলে ক্ষমতা নেবে কে? কাজেই সব দল আবার তার সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেছে। সংস্কার নিয়ে নিশ্চয়ই আরও কিছু বৈঠক হবে। এই ফাঁকে শাহবাগসহ সংলগ্ন এলাকা কিছুদিন স্বস্তি পেতে পারে হয়তো। কিন্তু ঝামেলা আছে—রোগীরা হুড়মুড় করে শাহবাগে চলে আসতে পারে। আবার যানজট, ঝঞ্ঝাট বাড়বে। রোগীদের দোষ কী? কে জানে, আবার কখন আন্দোলন শুরু হবে! আহারে শাহবাগ!