পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। নদীনালা, পুকুর, খাল-বিলের পানি ‘ভূপৃষ্ঠস্থ’ এবং মাটির নিচ থেকে উত্তোলিত পানি ‘ভূগর্ভস্থ পানি’ হিসেবে পরিচিত। ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ উভয় পানিই কৃষিতে সেচ, পানীয়, শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর মোট পানির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। বাকি ৩ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি। আবার ৩ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির মধ্যে ভূগর্ভে ৩০.১ শতাংশ, আইস ক্যাপস ও গ্ল্যাসিয়ারসে ৬৮.৭ শতাংশ, ভূপৃষ্ঠে ০.৩ শতাংশ ও ০.৯ শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া যায়।

পৃথিবীর মোট ভূপৃষ্ঠস্থ পানির ২ শতাংশ নদী, ১১ শতাংশ ডোবা-নালা ও বাকি ৮৭ শতাংশ লেকস থেকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, পৃথিবীর ৩ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির মধ্যে মাত্র ০.৩ শতাংশ ভূপৃষ্ঠস্থ পানি। আবার বিশুদ্ধ পানির মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশে ভূগর্ভস্থ ও আইসের পানি পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টির প্রাধান্য দিয়ে ব্যবহৃত হয়।

মানবজীবনে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির গুরুত্ব অপরিসীম। শতাংশের হিসাবে এ পানির পরিমাণ খুবই কম। অন্যদিকে এ পানি সূর্যের আলোর প্রচণ্ড তাপে বাষ্পীয় আকারে বায়ুমণ্ডলে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি ও স্রোতে পরিণত হয়ে ভূপৃষ্ঠে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে চক্রাকারে পানির ঘূর্ণনকে হাইড্রোলজিক্যাল সাইকেল বলা হয়। অনেক সময় পানির প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ঘূর্ণনের কারণে ভূপৃষ্ঠে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় পৃথিবীতে খরার সৃষ্টি হলে কৃষি ফসল ও মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

অন্যদিকে পৃথিবীর অধিকাংশ পানিই লবণাক্ত। এ লবণাক্ত পানি পৃথিবীর বহু দেশে নদীর মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়। ফলে ওই অঞ্চলে খাবার পানিসহ ফসলের মাটিতেও লবণাক্ততার হার লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। লবণাক্ততার প্রাদুর্ভাবে পানিতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম-জাতীয় আয়নের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সবজি, ডাল ও দানাজাতীয় ফসলের চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

শীতকালে মাটিতে লবণের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় কৃষি ফসল উৎপাদন অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ওই অঞ্চলে তখন একমাত্র সংগৃহীত বৃষ্টির পানির মাধ্যমে চাষাবাদ করা যায়, যদিও লবণাক্ততাসহিষ্ণু কিছু ফসলের চাষাবাদ স্বল্প পরিসরে করা হয়। লবণাক্ততার প্রভাবে বিশুদ্ধ পানি দূষণ বেড়ে যাওয়ায় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনসহ জীববৈচিত্র্যও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

মানুষ জীবনযাপনের জন্য ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ উভয় পানির ওপর নির্ভরশীল। যদিও লবণাক্ততার প্রাদুর্ভাব কোস্টাল বেল্টে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে দিন দিন পানিদূষণ বেড়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ কমে যাচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি বেশি পরিমাণে উত্তোলন করছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বর্ষাকালে ভূগর্ভস্থ পানির লেভেলের গড় গভীরতা ৩.৪ মিটার এবং শীতকালে পাওয়া যায় ৪.৬৭ মিটার যা বর্ষাকালের তুলনায় শীতকালে ভূগর্ভস্থ পানির লেভেলের গভীরতার প্রায় ৩৭ শতাংশ বেশি। উপরের মাটির নিুমুখী চাপ ও নিচের পানির ঊর্ধ্বমুখী চাপের মাঝখানে শূন্যতা বেড়ে যাওয়ায় সুনামি ও ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ভবিষ্যতে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভূপৃষ্ঠের পানির সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির নিবিড় সংযোগ রয়েছে। ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ যে হারে বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানি দূষণও সেই হারে বাড়ছে। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে গৃহস্থালির ময়লা, ট্যানারির বর্জ্য, শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দূষিত ময়লা-আবর্জনা ট্রিটমেন্ট ছাড়াই পানিতে ফেলে দিচ্ছে। এসব ময়লা-আবর্জনায় নন বায়োডিগ্রেডেবল ও হ্যাজারডাস উপাদান থাকায় মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

পানিতে ফিজিওকেমিক্যাল উপাদান বেড়ে যাওয়ায় পানি দূষণও বেড়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক, লেড, ক্রোমিয়াম ও নিকেলের সহনীয় মাত্রা হল যথাক্রমে ০.০১, ০.০৫, ০.০৫ এবং ০.০৭ মিলিগ্রাম। গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যে এসব ক্ষতিকর উপাদান ঢাকাসহ পৃথিবীর অনেক মেগা শহরে প্রতি লিটার জলাশয়ের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত গাইডলাইনের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায়। আবার ওই পানিতে বায়োলজিক্যালি অক্সিজেনের চাহিদা, মোট কঠিন পদার্থ, দূরীভূত অক্সিজেন, নাইট্রেট, সালফেট ও কার্বনেটের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে, যা পানিদূষণের মাত্রা লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে পানিতে বসবাসরত মাছসহ অন্যান্য অ্যাকোয়াটিক জীবের টেকসই জীবনযাপনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের ওপর পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাবও বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যায়, তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে পোকামাকড়ের বায়োটাইপও পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে এসব পোকার জেনাস ঠিক থাকলেও প্রজাতির পরিবর্তন হচ্ছে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাবে সুপারিশকৃত কীটনাশকের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় মাটিতে দীর্ঘদিন রেসিডিউ আকারে থেকে যাচ্ছে। ফলে কীটনাশক মাটি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে পানিতে চলে যায় যা জলাশয়ে বসবাসরত মাছসহ অন্যান্য অ্যাকোয়াটিক জীবের বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে।

মোটা দাগে বলা যেতে পারে, হেবি মেটালস ও কীটনাশকের অ্যাকটিভ উপাদানগুলো নালার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের পানিতে স্থানান্তরিত হয়। ওই ক্ষতিকর উপাদান খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে জুপ্লাংটন হয়ে বড় মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর উপাদানের আত্তীকরণ বায়োঅ্যাকোমোলেশন নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, এসব ক্ষতিকর উপাদানের ঘনমাত্রা খাদ্যশৃঙ্খলের ভেতর বেড়ে যেতে পারে, যা বায়োম্যাগনিফিকেশন নামে পরিচিত। যদি ক্ষতিকর উপাদানগুলো এক জীব থেকে অন্য জীবে প্রবেশের সময় ঘনমাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে ওই উপাদানগুলো মানুষসহ অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্যঝুঁকি লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে দেয়। এসব ক্ষতিকর উপাদান মানবদেহে প্রবেশের ফলে ফুসফুসে ক্যানসারসহ লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, এমনকি অবশেষে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

করোনাভাইরাস বর্জ্যরে মাধ্যমে পানিতে স্থানান্তরিত হতে পারে। সম্প্রতি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, করোনা গোত্রের সব ভাইরাস পানিতে (২৩-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় সর্বোচ্চ ১০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। আবার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানিতে ১০০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। করোনাভাইরাসের এ স্থায়িত্ব নির্ভর করে পানির তাপমাত্রা ও পানিতে উপস্থিত ক্লোরিন জাতীয় অক্সিডেন্টের ওপর। সার্সকোভি-২ ভাইরাসের তুলনায় করোনা গোত্রের পলিভাইরাস দীর্ঘদিন ট্যাপের পানিতে থাকতে পারে।

আশার কথা হল, করোনাভাইরাস পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারে না। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার গবেষণা মারফত জানা যায়, করোনাভাইরাসের পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার মতে, করোনাভাইরাস পানিতে নেই, তবে এ ভাইরাসটির পানিতে স্থায়িত্ব ও স্থানান্তর নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যা হোক, যদি পানির মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়, তাহলে সারা বিশ্বে এ করোনা মহামারীর আকার নতুন রূপ ধারণ করবে। যেহেতু বর্জ্যরে মাধ্যমে করোনাভাইরাস পানিতে স্থানান্তরিত হয়, সেহেতু বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, কলকারখানাসহ সব জায়গায় বর্জ্য নিষ্কাশনের আগে অবশ্যই ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণুগুলো ধ্বংস করতে হবে।

বিশুদ্ধ পানির মাত্র ০.৩ শতাংশ ভূপৃষ্ঠস্থ পানি। তাই ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানিই শুধু মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। একদিকে মানবজাতিরই পানির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অন্যদিকে মানুষই সবচেয়ে বেশি পানিদূষণের জন্য দায়ী। মোদ্দাকথা পানি দূষণ কমানো মানবজাতির নৈতিক দায়িত্ব।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, পানিদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে মানুষের সচেতনতার গুরুত্ব বেশি। মানবজাতিকে করোনার মহামারী থেকে শিক্ষা নিয়ে পানিদূষণ কমানোর বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে পানিবাহিত রোগজীবাণু কমানোর বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews