মাইক্রোসফট এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) মডেল তৈরি করেছে, যা বাতাসের গুণমান, আবহাওয়ার ধারা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্রান্তীয় ঝড়ের গতিপথ নির্ধারণে বর্তমান পূর্বাভাস পদ্ধতিকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এ সংক্রান্ত গবেষণা বুধবার নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
‘অরোরা’ নামের এই নতুন পদ্ধতি ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস দিয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ আরো দ্রুত, কম খরচে ও অধিক নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। তবে অরোরা এখনো বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়নি।
জ্যেষ্ঠ লেখক ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশলের সহকারী অধ্যাপক প্যারিস পারডিকারিস বলেন, ‘এই প্রথমবারের মতো একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পদ্ধতি ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসে সব কার্যকর কেন্দ্রকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।’
শুধুমাত্র অতীত তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত অরোরা ২০২৩ সালের সব ঘূর্ণিঝড়ই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের (ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার) চেয়ে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিতে পেরেছে।
ঐতিহ্যবাহী আবহাওয়া পূর্বাভাস পদ্ধতিগুলো ভরসা করে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতিগুলোর ওপর- যেমন ভর, ভরবেগ ও শক্তি সংরক্ষণ এবং এগুলো চালাতে প্রয়োজন হয় বিশাল কম্পিউটিং শক্তি।
গবেষণা অনুযায়ী, অরোরার প্রক্রিয়াগত খরচ এসব প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় কয়েক শ’ গুণ কম।
এই পরীক্ষামূলক ফলাফল চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘প্যাংগু-ওয়েদার’ নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলের ধারাবাহিকতায় এসেছে এবং এটি বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পারডিকারিস আরো বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আমরা এখন বায়ু-পদ্ধতি বিজ্ঞানে এক রূপান্তরমূলক যুগের সূচনায় রয়েছি। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে মূল চ্যালেঞ্জ হবে এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করা, যা স্যাটেলাইট বা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে উচ্চ রেজুলেশনের পূর্বাভাস দিতে পারবে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে।’
ডিজাইনারদের মতে, অরোরাই প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল, যা ধারাবাহিকভাবে সাতটি আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রকে পেছনে ফেলে পাঁচ দিনের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস দিতে পেরেছে।
উদাহরণস্বরূপ, এটি সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিয়েছিল কোথায় এবং কখন প্রশান্ত মহাসাগরে ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় ‘ডোকসুরি’ ফিলিপাইনে আঘাত হানবে, এমনকি চার দিন আগেই। অথচ ২০২৩ সালের সরকারি পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, সেটি তাইওয়ানের উত্তরে যাবে।
মাইক্রোসফটের এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মডেল ১০ দিন মেয়াদি বৈশ্বিক পূর্বাভাসে ইউরোপীয় মাঝারি-মেয়াদি আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র (ইসিএমডব্লিউএফ)-এর তুলনায় ৯২ শতাংশ ক্ষেত্রেই ভালো ফল দিয়েছে, যেখানে রেজুলেশন ছিল প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার।
ইসিএমডব্লিউএফ ইউরোপের ৩৫টি দেশের জন্য পূর্বাভাস প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান, যা পূর্বাভাসের নির্ভুলতায় বৈশ্বিক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গুগল জানায়, তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মডেল ‘জেনকাস্ট’ ২০১৯ সালে রেকর্ডকৃত ১ হাজার ৩২০টি জলবায়ু দুর্যোগের মধ্যে ৯৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় কেন্দ্রটির চেয়ে ভালো পূর্বাভাস দিয়েছিল।
এই পরীক্ষামূলক ফলাফলগুলো যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, বিশ্বের বড় বড় আবহাওয়া সংস্থাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
এর মধ্যে ফ্রান্সের আবহাওয়া সংস্থা মেতেও-ফ্রান্সসহ কয়েকটি সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পদ্ধতির পাশাপাশি প্রচলিত মডেলের সহাবস্থানে কাজ শুরু করেছে।
ইসিএমডব্লিউএফ-এর মহাপরিচালক ফ্লোরেন্স রাবিয়ের বলেন, ‘আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’
তিনি জানান, ফেব্রুয়ারিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য তারা যে প্রথম ‘লার্নিং মডেল’ চালু করেছে, তা প্রচলিত মডেলের তুলনায় কম্পিউটিং সময়ের দিক থেকে প্রায় ১ হাজার গুণ সাশ্রয়ী।
যদিও এর রেজুলেশন এখনো অরোরার তুলনায় কম (৩০ বর্গ কিমি), তথাপি সেটি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে।
সূত্র : বাসস