সমীক্ষা ছাড়াই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) হাজারীবাগ ও কাপ্তান বাজারে ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে দুটি পশু জবাইখানা। কোথা থেকে পশু আসবে, কীভাবে আসবে, জবাইয়ের পর মাংস কীভাবে নিয়ে যাবে-এসব প্রস্তুতি ছাড়াই জবাইখানা দুটি তৈরি হয়। চার বছর আগে জবাইখানা নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন শেষ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখানে কেউ পশু জবাই করছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তাদের মতে, নিজস্ব জনবল না থাকায় জবাইখানা পরিচালনার জন্য ছয়বার দরপত্র আহ্বান করেও আগ্রহী কাউকে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থার তিন বছর আগে নির্মাণকাজ শেষ করেও কাপ্তানবাজার জবাইখানার জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান করেনি ডিএসসিসি।
তারা বলেন, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সময় কার্যকর সমীক্ষা না করেই এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তার মেয়াদকালে হাজারীবাগ জবাইখানার উদ্বোধন করা হলেও সেখানে পশু জবাই কাজ শুরু করে যেতে পারেননি তিনি। তারপর মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সংস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন না করেই বাস্তবায়ন কাজ অব্যাহত রাখে। দুই মেয়র এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতায় সরকারের বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত আধুনিক জবাইখানা ও যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত হতে চলেছে। ইউরোপের কথা বলে চীন থেকে আনা যন্ত্রপাতিগুলোও অকেজো হয়ে গেছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, হাজারীবাগের আধুনিক জবাইখানার অবকাঠামো নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৯ কোটি টাকা এবং কাপ্তান বাজার আধুনিক জবাইখানার অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় ১৬ কোটি টাকা। আর যন্ত্রপাতি ক্রয়ে হাজারীবাগ জবাইখানায় খরচ হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা এবং কাপ্তানবাজার জবাইখানায় খরচ হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।
নির্মাণকাজ শেষে যন্ত্রপাতি স্থাপন করে ২০১৯ সালে হাজারীবাগ জবাইখানার উদ্বোধন করেন তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। কাপ্তানবাজার জবাইখানা নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনকাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। এখন পর্যন্ত একটিও চালু হয়নি। এ পর্যায়ে এসে তারা কার্যকর সমীক্ষা না হওয়ায় প্রকল্পের দুর্বলতাগুলো বুঝতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা থেকে উত্তরণের উপায় বের করার কোনো উদ্যোগ তাদের মধ্যে নেই।
ডিএসসিসির পশু জবাইখানা তদারকির দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। ভেটেরিনারি কর্মকর্তারা এসব দেখভাল করে থাকেন। ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, পশু জবাই এবং মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১ এর ধারা ৩(১) অনুযায়ী, ‘পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়া খোলা স্থানে পশু জবাই নিষেধ।’ কিন্তু বাস্তবে এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। অভিযোগ পাওয়া যায়, কসাইরা অনেক সময় মৃত বা অসুস্থ পশু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, অসুস্থ পশুর মাংস খেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া পশু কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে ভোক্তাও তাতে আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। সেই চিন্তা থেকে আধুনিক পশু জবাইখানা নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি। তবে পশু আনা এবং মাংস নেওয়ার চেইন সিস্টেম তৈরির জন্য প্রকল্পে কোনো কিছুই ভাবা হয়নি। এছাড়া যত্রতত্র পশু জবাইয়ে কঠোরতা আরোপ এবং জনসচেতনতাও জরুরি। এসব কাজ না করলে আধুনিক জবাইখানায় পশু জবাই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, পাঁচতলাবিশিষ্ট হাজারীবাগ পশু জবাইখানায় সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। তবে ভবনের প্রধান ফটকের একাংশে ছোট্ট একট গেট খোলা রয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, ওই ভবনের নিচতলার একপাশ স্থানীয় ওয়ার্ড কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। এক নিরাপত্তাকর্মী জানান, ওই জবাইখানার জন্য একজন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা আছেন। তিনি প্রতিদিন সেখানে যান এবং কিছুসময় অফিস করে আবার নগর ভবনে চলে যান। পুরো জবাইখানার ভেতরে ঘুরে সুনসান নীরবতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। আশপাশের এলাকার শিশু-কিশোরদের ভেতরে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে। নিরাপত্তাকর্মী এবং এলাকাবাসী জানান, উদ্বোধনের পর থেকে ওই জবাইখানায় তারা কখনো কোনো পশু জবাই করতে দেখেননি।
কাপ্তানবাজার জবাইখানার সামনে ও পেছনে দুটি গেট রয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে গেট দুটি বন্ধ। এর ভেতরে পশু জবাইয়ের জন্য বিদেশ থেকে আনা সব ধরনের যন্ত্রপাতি রেখে দেওয়া হয়েছে। কখনো ওই জবাইখানা খুলতে দেখেন না বলে জানিয়েছেন আশপাশের দোকানদাররা। তাদের ধারণা, কয়েক বছর আগে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় তা হয়তো অকেজো হয়ে গেছে। এ কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ডিএসসিসির প্রকৌশলীরা। কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি আনার কথা থাকলেও চায়নার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। যন্ত্রপাতিগুলো ভালো আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামসুল কবির যুগান্তরকে বলেন, মানসম্মত পশুর মাংস নিশ্চিত করতে আধুনিক জবাইখানা অপরিহার্য। তবে এজন্য শুধু ভবন ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করলেই হবে না। পাশাপাশি মানুষ যাতে পশু জবাইখানায় গিয়ে পশু জবাই করে, সেই আয়োজনও সরকারকে করতে হয়।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী যুগান্তরকে বলেন, দুই দফায় ছয়বার দরপত্র আহ্বান করেও আগ্রহী কোনো ইজারাদার পাওয়া যায়নি। এর অন্যতম কারণ রাজধানীতে পশু ব্যবসায়ীরা যত্রতত্র পশু জবাইয়ে অভ্যস্ত এবং নগরবাসী সেসব মাংস দেদার কিনছেন। সরকারও যত্রতত্র পশু জবাই বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এজন্য ইজারাদাররা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, পশু জবাইখানার ইজারা নিলে তাদের টাকা উঠবে না।
ডিএসসিসির জবাইখানা বাস্তবায়ন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক এবং সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকের যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি মেয়র সাঈদ খোকনের সময়ে গ্রহণ করা হয়। সেসময় প্রকল্প পরিচালক একজন ছিলেন। এরপর আরেকজন দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। এজন্য প্রকল্প গ্রহণ পর্যায়ের বিষয়গুলো তার পরিষ্কার জানা নেই।