এ বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হতে পারে চতুর্থ পর্যায়ের ‘স্বাস্থ্য জনসংখ্যা এবং পুষ্টিবিষয়ক খাতভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি, ২০১৭-২০২১।’ এ খাতে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বিনিয়োগ হতে পারে, যা ছিল ২০১১-২০১৬ সালের তৃতীয় কর্মসূচিতে ৭.৭ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এছাড়া পুলের বাইরে অবস্থিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অনেক দাতা সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অপরাপর দাতব্য সেবা সংস্থা ও ব্যক্তি বিনিয়োগ করছে। তারপরও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু কমপক্ষে ৩৪ ডলার ব্যয় করার যে মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, এ বিনিয়োগ তার তুলনায় অর্ধেক। এখনও জনগণ নিজের পকেট থেকে ৬৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে নিজস্ব চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য এবং কমপক্ষে ৬০ শতাংশের বেশি লোকজন ট্রেডিশনাল মেডিসিন, ওঝা, বৈদ্য ও ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করে অকালে কর্মক্ষমতা হারায় এবং নিয়তিকে অভিশাপ দেয়। বাংলাদেশে এখনও স্বাস্থ্য বীমার উপকারিতা এবং তার সুযোগ প্রসার লাভ করেনি।

বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে দ্রুতগতিতে, লক্ষ্য ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পরিচিতি লাভ করবে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশের অধিক হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। গত বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ হারে এবং বিগত ১৫ বছরে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতে অর্জিত বেশকিছু সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ চমক সৃষ্টি করতে পেরেছে।

কিন্তু তারপরও সেবার গুণগত মান সংরক্ষণে স্বাস্থ্য খাতের অপারগতা, সেবা প্রদানকারীদের অবহেলা, ভুয়া চিকিৎসকের আবির্ভাব, রোগীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে অর্থ খোয়ানো, অননুমোদিত ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সব মিলেমিশে অনেক ক্ষেত্রে হতাশার চিত্র লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সব কারণে সাধারণ চিকিৎসার জন্যও প্রচুর লোকজন দেশের বাইরে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পাড়ি দিচ্ছে অহরহ। বাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করতে গিয়ে চিকিৎসকের কথা বা আচরণে সেবা গ্রহণকারীর মনে আস্থার সঞ্চার হচ্ছে না আদৌ। তাই দেখা যায়, প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন চিকিৎসা ভিসা প্রদানের জন্য ভিন্ন কেন্দ্র ও কাউন্টার খুলেছে, যা হচ্ছে অভিনব এক উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানের প্রতি প্রকাশ্যে অবমাননা। এমন একটি পরিস্থিতি সহনীয় এবং প্রত্যাশিত নয়।

সব ধরনের অবকাঠামো বিরাজমান থাকার পরও এমনটি কেন হচ্ছে, অনেকের মতে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা অনেক সময় চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগটিকে জটিল করে ফেলছেন যা রোগীকে বিদেশে যেতে বাধ্য করছে। সেবার মানের প্রতি অবিশ্বাস বা আস্থার অভাব হচ্ছে বিশাল এক সংকট যা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে অবশ্যই।

এছাড়া হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর খবর, হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরি, হাসপাতালে মহিলা রোগীদের প্রতি অভদ্র আচরণ এবং হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার সেবা প্রত্যাশীদের হতাশ করে অনেক ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, ২০১১ সালে ১১ কোটি ৫০ লাখ লোকজন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৩ লাখ ২৫ হাজার রোগী, যার মধ্যে ২৬ হাজার রোগী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছে। হাসপাতালে ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ১ লাখ ১৬ হাজার রোগী যা যে কোনো মূল্যায়নে অধিক এবং অনভিপ্রেত। এমন পরিস্থিতিকে কোনো অবস্থায়ই সমর্থন করা যায় না।

এমন পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তাই দাবি উঠেছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন দ্রুত সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। স্বাস্থ্যসেবাদানে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে না পারলে সব উদ্যোগ এবং অর্জন অর্থহীন হবে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে গর্বভরে বলার মতো কিছুই থাকবে না। বাংলাদেশ বেনিন বা বুরুণ্ডি নয়। স্বাস্থ্য-শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায় বাংলাদেশের মান অনেক উন্নত। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের প্রায় ১২২টি দেশে রফতানি হয়। বাংলাদেশ সামাজিক ও আর্থিক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অগ্রসর। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে পেছনে থাকা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সরকার স্বাস্থ্য খাতের শূন্য পদে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবাকে প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ৪০ হাজার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ হচ্ছে বিশাল এক ব্যয়ভার রাজস্ব খাতে বহন করার উদ্যোগ। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ১১ হাজার ১৯৫টি শয্যা বৃদ্ধির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় মঞ্জুরি প্রদান করেছে। প্রতি শয্যা বৃদ্ধির সঙ্গে থাকে অনেক ব্যয়। এখনও বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে বহন করে। ভবিষ্যতে রাজস্ব খাত থেকে এ ব্যয়ের হার আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু অনেক জনবল নিয়োগ বা শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি করলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নীতকরণে সহায়ক হবে কি? এসব প্রশ্ন অনেকের।

সেবার মান বৃদ্ধি করতে হলে প্রয়োজন হবে দক্ষ এবং নিবেদিত কর্মী বাহিনীর সমাবেশ এবং সঙ্গে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় তদারকি। ই-মেডিকেল সেবা চালু হয়েছে, মোবাইল সেবার পরিধি বেড়েছে। সরকার ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ চালু করেছে যাতে নং-১৬২৬৩ এ টেলিফোন করলে সেবাপ্রাপ্তি এবং অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তারপরও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের স্থানটি সুদৃঢ় করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অনেক কাজ করতে হবে। প্রচুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বাসের জায়গায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।

বর্তমানে সারা দেশে রাজস্ব খাত থেকে পরিচালিত ১৩ হাজার ৭৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দিচ্ছে এবং ৩ হাজার ৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র চালু আছে। তারপর আছে ৪ হাজার ২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং শতাধিক মাতৃসদন। প্রতিটি জেলায় আছে জেলা হাসপাতাল এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে আছে মেডিকেল কলেজসহ উচ্চপর্যায়ের হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল। প্রচুর সংখ্যক সেবা প্রতিষ্ঠান সরকার স্থাপন করেছে গ্রাম, ইউনিয়ন এবং জেলা পর্যায়ে। এমন স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিরল; কিন্তু তারপরও সাধারণ রোগের জন্য মানুষ ছুটে আসে শহরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। কেন এ অবস্থা, কোথায় দুর্বলতা?

অনেক কর্মচারী নিয়োগ করলেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন আছে সমীক্ষার, নিবিড় বিশ্লেষণ ও তদারকির। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে সেবা প্রদানকারীদের আচরণ, দক্ষতা ও মননশীলতায় অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। সেবাকে অর্থ উপার্জনের মাপকাঠিতে বিচার না করে নৈতিকতার আদলে এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদন করতে হবে, তবেই সেবার মান বাড়বে এবং সেবা প্রদানকারীদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পাবে।

ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক সচিব


 

অবৈধ হাসপাতাল, ভুয়া চিকিৎসক, মানহীন মেডিকেল কলেজ, স্বাস্থ্যসেবার গুণগতমানের অবনমন এবং ভেজাল ওষুধের উৎপাদনের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পরিচালিত অভিযানকে সমর্থন ও সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন; এমন একটি খবর জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। একইসঙ্গে ত্রিশটি ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করেছে সরকার। আবার খবর বেরিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে ৪০ হাজার জনবল বিশেষত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যা অভিপ্রেত পদক্ষেপ হিসেবে সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। অপরদিকে আইন কমিশন থেকে ‘স্বাস্থ্যসেবা আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আইনের আওতায় আসবে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসার অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসায় শাস্তির বিধান রেখে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা, সেবা গ্রহণকারীর অধিকার, চিকিৎসকের ও সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্ধারণ করে এমন একটি আইনের সুপারিশ প্রণয়ন করছে আইন কমিশন। খসড়া আইনে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন’ এবং জেলা পর্যায়ে ‘স্বাস্থ্যসেবা নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ খসড়ায় ৬৯টি ধারা থাকতে পারে যেখানে বাংলার ব্যবহার, তথ্যের গোপনীয়তা, চিকিৎসা প্রদানে বৈষম্যের অবসান, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধিকার ইত্যাদি সব ধরনের বিষয় সন্নিবেশিত করা হবে।স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী অভিনন্দিত হয়েছে। সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি টার্গেটের মধ্যে ৩নং লক্ষ্য হচ্ছে ‘স্বাস্থ্যবান জীবন এবং সব বয়সের সব জনগণের কল্যাণকে উন্নত করা।’ সরকারের উদ্যোগ ও কার্যক্রম আভাস দিচ্ছে বাংলাদেশ বহুমুখী সংস্কার সাধনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের যেসব অর্জন হয়েছে এর মধ্যে সেবাদানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধন হচ্ছে বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং এক্ষেত্রে সাফল্য না হলে সব বিনিয়োগ অর্থহীন মনে হবে।এ বছরের জুলাই মাস থেকে শুরু হতে পারে চতুর্থ পর্যায়ের ‘স্বাস্থ্য জনসংখ্যা এবং পুষ্টিবিষয়ক খাতভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি, ২০১৭-২০২১।’ এ খাতে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বিনিয়োগ হতে পারে, যা ছিল ২০১১-২০১৬ সালের তৃতীয় কর্মসূচিতে ৭.৭ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এছাড়া পুলের বাইরে অবস্থিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অনেক দাতা সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অপরাপর দাতব্য সেবা সংস্থা ও ব্যক্তি বিনিয়োগ করছে। তারপরও স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু কমপক্ষে ৩৪ ডলার ব্যয় করার যে মাত্রা নির্ধারণ করা আছে, এ বিনিয়োগ তার তুলনায় অর্ধেক। এখনও জনগণ নিজের পকেট থেকে ৬৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে নিজস্ব চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য এবং কমপক্ষে ৬০ শতাংশের বেশি লোকজন ট্রেডিশনাল মেডিসিন, ওঝা, বৈদ্য ও ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করে অকালে কর্মক্ষমতা হারায় এবং নিয়তিকে অভিশাপ দেয়। বাংলাদেশে এখনও স্বাস্থ্য বীমার উপকারিতা এবং তার সুযোগ প্রসার লাভ করেনি।বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে দ্রুতগতিতে, লক্ষ্য ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পরিচিতি লাভ করবে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ৬ শতাংশের অধিক হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। গত বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ হারে এবং বিগত ১৫ বছরে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতে অর্জিত বেশকিছু সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ চমক সৃষ্টি করতে পেরেছে।কিন্তু তারপরও সেবার গুণগত মান সংরক্ষণে স্বাস্থ্য খাতের অপারগতা, সেবা প্রদানকারীদের অবহেলা, ভুয়া চিকিৎসকের আবির্ভাব, রোগীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে অর্থ খোয়ানো, অননুমোদিত ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সব মিলেমিশে অনেক ক্ষেত্রে হতাশার চিত্র লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সব কারণে সাধারণ চিকিৎসার জন্যও প্রচুর লোকজন দেশের বাইরে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর পাড়ি দিচ্ছে অহরহ। বাংলাদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করতে গিয়ে চিকিৎসকের কথা বা আচরণে সেবা গ্রহণকারীর মনে আস্থার সঞ্চার হচ্ছে না আদৌ। তাই দেখা যায়, প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন চিকিৎসা ভিসা প্রদানের জন্য ভিন্ন কেন্দ্র ও কাউন্টার খুলেছে, যা হচ্ছে অভিনব এক উদ্যোগ এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানের প্রতি প্রকাশ্যে অবমাননা। এমন একটি পরিস্থিতি সহনীয় এবং প্রত্যাশিত নয়।সব ধরনের অবকাঠামো বিরাজমান থাকার পরও এমনটি কেন হচ্ছে, অনেকের মতে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা অনেক সময় চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগটিকে জটিল করে ফেলছেন যা রোগীকে বিদেশে যেতে বাধ্য করছে। সেবার মানের প্রতি অবিশ্বাস বা আস্থার অভাব হচ্ছে বিশাল এক সংকট যা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে অবশ্যই।এছাড়া হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর খবর, হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরি, হাসপাতালে মহিলা রোগীদের প্রতি অভদ্র আচরণ এবং হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার সেবা প্রত্যাশীদের হতাশ করে অনেক ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, ২০১১ সালে ১১ কোটি ৫০ লাখ লোকজন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৩ লাখ ২৫ হাজার রোগী, যার মধ্যে ২৬ হাজার রোগী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছে। হাসপাতালে ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ১ লাখ ১৬ হাজার রোগী যা যে কোনো মূল্যায়নে অধিক এবং অনভিপ্রেত। এমন পরিস্থিতিকে কোনো অবস্থায়ই সমর্থন করা যায় না।এমন পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা। তাই দাবি উঠেছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন দ্রুত সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। স্বাস্থ্যসেবাদানে সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে না পারলে সব উদ্যোগ এবং অর্জন অর্থহীন হবে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে গর্বভরে বলার মতো কিছুই থাকবে না। বাংলাদেশ বেনিন বা বুরুণ্ডি নয়। স্বাস্থ্য-শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায় বাংলাদেশের মান অনেক উন্নত। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের প্রায় ১২২টি দেশে রফতানি হয়। বাংলাদেশ সামাজিক ও আর্থিক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অগ্রসর। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে পেছনে থাকা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।সরকার স্বাস্থ্য খাতের শূন্য পদে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবাকে প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ৪০ হাজার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ হচ্ছে বিশাল এক ব্যয়ভার রাজস্ব খাতে বহন করার উদ্যোগ। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ১১ হাজার ১৯৫টি শয্যা বৃদ্ধির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় মঞ্জুরি প্রদান করেছে। প্রতি শয্যা বৃদ্ধির সঙ্গে থাকে অনেক ব্যয়। এখনও বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে বহন করে। ভবিষ্যতে রাজস্ব খাত থেকে এ ব্যয়ের হার আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে; কিন্তু অনেক জনবল নিয়োগ বা শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি করলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নীতকরণে সহায়ক হবে কি? এসব প্রশ্ন অনেকের।সেবার মান বৃদ্ধি করতে হলে প্রয়োজন হবে দক্ষ এবং নিবেদিত কর্মী বাহিনীর সমাবেশ এবং সঙ্গে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় তদারকি। ই-মেডিকেল সেবা চালু হয়েছে, মোবাইল সেবার পরিধি বেড়েছে। সরকার ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ চালু করেছে যাতে নং-১৬২৬৩ এ টেলিফোন করলে সেবাপ্রাপ্তি এবং অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তারপরও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের স্থানটি সুদৃঢ় করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অনেক কাজ করতে হবে। প্রচুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বাসের জায়গায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।বর্তমানে সারা দেশে রাজস্ব খাত থেকে পরিচালিত ১৩ হাজার ৭৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা দিচ্ছে এবং ৩ হাজার ৮৮১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র চালু আছে। তারপর আছে ৪ হাজার ২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং শতাধিক মাতৃসদন। প্রতিটি জেলায় আছে জেলা হাসপাতাল এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে আছে মেডিকেল কলেজসহ উচ্চপর্যায়ের হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল। প্রচুর সংখ্যক সেবা প্রতিষ্ঠান সরকার স্থাপন করেছে গ্রাম, ইউনিয়ন এবং জেলা পর্যায়ে। এমন স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো অনেক উন্নয়নশীল দেশে বিরল; কিন্তু তারপরও সাধারণ রোগের জন্য মানুষ ছুটে আসে শহরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। কেন এ অবস্থা, কোথায় দুর্বলতা?অনেক কর্মচারী নিয়োগ করলেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন আছে সমীক্ষার, নিবিড় বিশ্লেষণ ও তদারকির। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে সেবা প্রদানকারীদের আচরণ, দক্ষতা ও মননশীলতায় অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। সেবাকে অর্থ উপার্জনের মাপকাঠিতে বিচার না করে নৈতিকতার আদলে এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদন করতে হবে, তবেই সেবার মান বাড়বে এবং সেবা প্রদানকারীদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি পাবে।ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক সচিব



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews