ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের (এসএম) শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা মারা গিয়েছিলেন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। জানুয়ারির শীতে বারান্দায় ঘুমানো ও রাতে ছাত্রলীগের গেস্টরুম কর্মসূচিতে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনায় হল থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। আড়াই বছর পরও সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

গণমাধ্যমে হাফিজুর মোল্লার এমন মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হলে বিক্ষোভ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে বিচারের দাবি জানিয়ে বামপন্থী নয়টি ছাত্র সংগঠনের আলাদা দুটি জোট বিক্ষোভ করে। সমাবেশ, মানববন্ধন, উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও চলতে থাকে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হাফিজুরের অটোরিকশাচালক বাবাকে ডেকে এনে ৪ লাখ টাকা অনুদান দেয়। কিন্তু ওই ঘটনায় কারা জড়িত ছিলেন, তা জানার সুযোগ কারও হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৫ বছরে রাজনৈতিক সহিংস ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঝুলে আছে তদন্ত কমিটিতে। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কোনো ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে দেয়নি প্রশাসন। আন্দোলনগুলোর কোনো কোনো দাবি প্রশাসন গায়েই মাখেনি, অথবা দমন করেছে পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগ।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪টি আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একাডেমিক বা প্রশাসনিক কাজে বাধা না দেওয়া পর্যন্ত কোনো দাবির বিষয়ে কর্ণপাত করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যখন ধর্মঘট বা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি হয়েছে, তখন তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কেবল চারটি কমিটি প্রতিবেদন দিলেও কোনোটিরই সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সময়ে ১০টি আর বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সময়ে বাকি ৪টি ঘটনা ঘটেছে।কোটা সংস্কার আন্দোলনের রাতে উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুর চলে। ৮ এপ্রিল, ২০১৮ ফাইল ছবি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক ঘটনাগুলোতে বেশ কয়েকটি পক্ষ থেকে। যেসব অভিযোগে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন যুক্ত থাকে, সেক্ষেত্রে প্রশাসন কিছু করতে পারে না। তাছাড়া, তদন্ত কমিটিতে ঘুরেফিরে প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত ব্যক্তিদেরই বারবার রাখা হয়। ফলে তাঁরা প্রাধান্য দিয়ে কোন কাজটি করবেন, সেটি নির্ধারণ করতে পারেন না। গণমাধ্যম যখন যেটি নিয়ে আলোচনা হয়, তখন সে বিষয়ে একটু অগ্রগতি হয়। প্রশাসনিক ভবনের তদন্ত শাখায়ও দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।

এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, যে মাত্রার অভিযোগ ওঠে, তদন্ত করতে গিয়ে সেটা প্রমাণিত হয় না। অভিযোগকারীরাই তদন্ত কমিটির কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেন না বা সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন না। তবে বর্তমান প্রশাসন যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

এসএম হলের হাফিজুর মোল্লার মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিতে ছিলেন আবাসিক শিক্ষক সাব্বীর আহমেদ, মো. মোফাজ্জল হোসেন ও আবু বিন হাসান। হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ ও তদন্ত কমিটির শিক্ষকেরা বলছেন, তাঁরা তদন্ত শেষ করেছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও এর কোনো অনুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলোও এত দিন পর কেউ ঠিকঠাক মনে করতে পারছেন না।সুফিয়া কামাল হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর প্রতিবাদে হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্রীদের একাংশ, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ফাইল

তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক সাব্বীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তদন্ত প্রতিবেদনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ ছিল।

অবশ্য কমিটির একটি সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ ছিল। হলে রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়ে সার্বিকভাবে বলা ছিল। সে কারণে প্রতিবেদনটি আর প্রকাশ করা হয়নি।

হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছিল। কিন্তু তার কোনো অনুলিপি নেই। এটি কোথাও পাঠালে হলের কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার খাতায় লিপিবদ্ধ থাকার কথা, তা-ও নেই।

জানতে চাইলে সাবেক প্রাধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রতিবেদনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে হাতে হাতে জমা দিয়েছেন। কিন্তু হলে একটি অনুলিপি থাকার কথা। তিনি এখন দায়িত্বে নেই, তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় উপাচার্যের বাড়ি ভাঙলো কারা?
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন চলতি বছরের ৮ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল, সিন্ডিকেট সদস্য মোসাম্মৎ নীলিমা আকতার ও এসএম বাহালুল মজনুন এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জম হোসেন মোল্লাহ ছিলেন।

কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চারবার কমিটির সদস্যরা সভা করেছেন। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের অনেকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। কমিটি গঠনের সময় ক্ষতি নিরূপণ ও দোষীদের চিহ্নিত করে দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিটি ছয় মাসেও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। পুলিশ এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক দেখিয়েছে। কিন্তু তাদের জড়িত থাকার বিষয়েও কমিটির সদস্যরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।

এ সম্পর্কে কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে কারা ওই সময় সেখানে ছিল, সেটা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি ওই সময় কোন পক্ষের অবস্থান কোথায় ছিল সেটা বের করার।’

সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে গেলে এভাবেই চারদিকে ঘিরে রেখে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ ফাইল

আন্দোলনকারীরা চাপে, ছাত্রলীগ নেত্রীর শাস্তি নেই
কবি সুফিয়া কামাল হলে গত ১০ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহানকে বহিষ্কারের দাবিতে রাতভর বিক্ষোভ করেন হলের ছাত্রীরা। ওইদিন তাৎক্ষণিকভাবে ইফফাতকে বহিষ্কার করা হলেও পরে সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে ঘটনার আগের দিন ইফফাত বিভিন্ন বর্ষের ছাত্রীদের নিজ কক্ষে ডেকে নির্যাতন করেন। দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে দড়িলাফের দড়ি দিয়ে পেটান, দুজনকে চড়-থাপ্পড় দেন এবং পাঁচ-ছয়জনকে কনিষ্ঠ ছাত্রীদের সামনে কান ধরে ওঠবস করান।

ওইদিন রাতে লাল পোকা (কেন্নো) দেখে এক ছাত্রী চিৎকার করে উঠলে আন্দোলনকারীরা ভেবেছিলেন, আগের দিনের মতোই কাউকে পেটানো হচ্ছে। প্রতিবাদে তাঁরা জড়ো হয়ে ইফফাতকে কক্ষে অবরুদ্ধ করেন। কাঁচের জানালায় লাথি দিয়ে আরেক ছাত্রী পা কাটলে ‘রগ কাটার গুজবে’ বিক্ষোভ বড় হয়। ঘটনার পর পর ইফফাতকে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইফফাতকে বহিষ্কার করে। ছাত্রলীগ সেই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়ার পর বদলে যায় দৃশ্যপট। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৫ ছাত্রীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। নোটিশে ইফফাতকে ‘পরিকল্পিতভাবে লাঞ্ছিত ও মারধরের’ অভিযোগ আনা হয়।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইফফাতের বিরুদ্ধে আনা নির্যাতনের অন্যান্য অভিযোগ আমলে নিত। কিন্তু হল প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রেজওয়ানা রহমানের স্পষ্ট বক্তব্য, ঘটনার দিনে কারও রগ কাটা হয়েছিল কি না, তাঁরা কেবল সেটিই তদন্ত করে দেখেছেন।

ছাত্রী নিপীড়নের প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে গত ১৫ জানুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রীদের নিপীড়নের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি। ঘটনার তিন মাস পর গত এপ্রিলে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, সাক্ষীরা উত্ত্যক্তকারী হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি।

রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পর তা বাতিলের দাবিতে ১১ জানুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষার্থী। ১৫ জানুয়ারি তাঁরা ক্লাস বর্জন করে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। সেখানে বিক্ষোভ দমাতে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে কয়েক শ নেতা-কর্মী আন্দোলনকারীদের ঘেরাও করেন। এ সময় ছাত্রীদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে অশোভন আচরণ করার অভিযোগ ওঠে। ছাত্রীরা সেখান থেকে একে একে ওঠে যান। আন্দোলনের সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের ভেতরে পেটানো হয়।

বিষয়টি পরদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রকাশিত হলে নিন্দার ঝড় ওঠে। এই প্রক্রিয়ায় আন্দোলন নস্যাৎ করার প্রতিবাদে অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাঁরা একত্রে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ছাত্রী নিপীড়নের বিচার চেয়ে ১৭ জানুয়ারি প্রক্টরকে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাঁদের দাবির মুখে ১৮ জানুয়ারি ছাত্রী নিপীড়নের তদন্তে একটি কমিটি করে দেয় প্রশাসন।

প্রতিবেদন জমা হওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পায়নি। প্রশাসনিক ভবনের একটি সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়া তিনজনের কেউ সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেছেন; সেখানে ছাত্রীদের ঘিরে ধরে উত্ত্যক্ত করা বা গায়ে স্পর্শ করার প্রমাণ মেলেনি।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয় পেয়েছি, তা প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রশাসনের কাছে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।’

কিন্তু তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দেওয়া এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তিনি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগের একজন নেতাকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর কাছে যা তথ্যপ্রমাণ ছিল, তা দিয়েছেন। ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘তারপরও তদন্ত কমিটি বারবার আমার কাছে ঘটনার ভিডিও চাইতে থাকে। আমরা তো কেউ ভিডিও করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি নিজেই যেখানে প্রত্যক্ষদর্শী, সেখানে তারা বলেছে যে ভিডিও দিতে না পারলে অভিযোগ প্রমাণ হবে না।’ছাত্রী নিপীড়নের বিচার চাইতে গেলে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ ফাইল

আন্দোলন দমাতে দুই কমিটি?
ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় তদন্ত কমিটি করার দিন প্রশাসন প্রক্টরকে অবরুদ্ধ করার ঘটনায় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং তাঁর কার্যালয়ের কলাপসিবল গেট ভাঙায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এর প্রতিবাদে লাগাতার কয়েক দিন কর্মসূচি শেষে ২৩ জানুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ের ফটক ভেঙে তাঁকে অবরুদ্ধ করেন আন্দোলনকারীরা। পরে ছাত্রলীগ তাঁদের পিটিয়ে উপাচার্যকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় আরেকটি তদন্ত কমিটি হয়। শেষ দুটি কমিটি এখনো প্রতিবেদন দেয়নি। কবে প্রতিবেদন জমা হবে, সে সম্পর্কেও কেউ কিছু বলতে পারেননি।

‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের’ ওই সময়কার সমন্বয়কারী মাসুদ আল মাহ্দী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি তো স্পষ্ট যে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের চাপে তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের দমন করতে আরও দুটি তদন্ত কমিটি করেছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। প্রথম থেকেই তাই আমরা একে প্রহসনের কমিটি বলে আসছি।’ তিনি বলেন, ‘২৩ জানুয়ারির ঘটনায় যদি নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের শাস্তি দিতে হবে।’

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী প্রথম আলোকে বলেন, দাবির পরও তদন্ত কমিটিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। এর মধ্য দিয়েই প্রশাসন আস্থা হারিয়েছিল। আর তদন্তে নিপীড়নের প্রমাণ পাওয়া না গেলে এটা স্পষ্ট হয় যে কী উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আর অন্য দুটো কমিটি তো আন্দোলন দমন করতেই করা হয়েছিল।

ছাত্রলীগ জড়িত থাকলে প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন হয় না
২০১৭ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে বিজয় একাত্তর হলের বিভিন্ন কক্ষে জোর করে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থী তোলা নিয়ে রাতভর তুলকালাম হয়। রাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন কক্ষে ছাত্রলীগের কর্মীদের তুলে দেওয়া, ভাঙচুর ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে। হলের আবাসিক শিক্ষকদের ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ। প্রাধ্যক্ষের কক্ষ ভাঙচুর করে। মারধর করা হয় এক সাংবাদিককে।

এ ঘটনায় ওই রাতেই আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২ এপ্রিল তদন্ত কমিটি এক প্রতিবেদনে জানায়, এক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা ও কয়েক দফায় বৈঠক করে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফকির রাসেল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক নয়ন হাওলাদার হলের কক্ষগুলো দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রতিবেদনের কোনো সুপারিশ কার্যকর করা হয়নি। বহাল তবিয়তে আছেন দুই নেতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ২০১৬ সালের ১ জুলাই সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের গাড়ি ভাঙচুর করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই বছরের স্মরণিকার এক লেখায় জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে হওয়া বিক্ষোভ থেকে গাড়ি ভাঙা হয়।সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক গাড়িতে থাকা অবস্থায় গাড়ি ভাঙচুর করে ছাত্রলীগ, ১ জুলাই ২০১৬ ফাইল

ওই বছরের ২২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. কামাল উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটিকে দুটো বিষয়ই খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছিল। কিন্তু গত ২২ মে স্মরণিকায় জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করায় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। অথচ উপাচার্যের গাড়ি ভাঙচুরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের গাড়ি ছাত্রলীগ ভাঙলেও এর পেছনে আরও উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছিল। সব কিছু প্রতিবেদনে আনা সম্ভব হয়নি।

এ সম্পর্কে ৯৭ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ওই ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ তদন্ত শেষ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘আমরা ওই অংশটিরই তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি।’

২০১৫ সালের ২ আগস্ট রাতে একই হলে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় (আইবি) বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হোসাইন মিয়াকে ছাত্রশিবিরের কর্মী আখ্যা দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় কমিটি। প্রতিবেদনে তৎকালীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ ইনান ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসাইনসহ ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের আড়াই বছর কেটে গেলেও সেই সুপারিশের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। বরং ছাত্রলীগের হল শাখার নেতা থেকে পদোন্নতি পেয়ে গত কমিটিতে দুজনই কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছিলেন।উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দিন ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানাতে গিয়ে একদল শিক্ষকের তোপের মুখে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ২৯ জুলাই ২০১৭ ফাইল

ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে দেয়নি প্রশাসন
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নতুন করে সরকার গঠন হওয়ার পর প্রথম ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্মঘট ডাকা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের বর্ধিত ফি কমানোর দাবিতে বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের ডাকা ওই ধর্মঘটে শিক্ষার্থীদের তেমন সাড়া মেলেনি। এমনকি ধর্মঘটের মধ্যেই ওই বিভাগে ক্লাস হয়। এটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কিন্তু ২২ মে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সান্ধ্যকোর্স খোলার প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকা হলে তাতে বাধা দেয় ছাত্রলীগ।

একই বছরের ২৬ মার্চ জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিশ্ব রেকর্ড গড়তে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়ে হলের ছাত্রীরা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টির সুরাহা করা হয়নি। বরং রাতের বেলা এক ছাত্রীকে কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আজমীরা বিনতে জামান ও সাধারণ সম্পাদক লিসা চাম্বু গংয়ের বিরুদ্ধে। ছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে তাঁদের দুজনকে হল থেকে নিরাপদে বের করে দেয় হল প্রশাসন। তখন একটি তদন্ত কমিটির কথা বলা হলেও সেটি কখনোই প্রকাশিত হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে হঠাৎ করে দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষার সুযোগ বাতিল করা হলে দীর্ঘ আন্দোলন করতে হয় ভর্তি পরীক্ষার্থীদের। টানা ১২৫ ঘণ্টা অনশনও করেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। কিন্তু কোনোভাবেই প্রশাসনের মন পায়নি আন্দোলনকারীরা। নভেম্বর-ডিসেম্বরে উল্টো পুলিশ ও ছাত্রলীগের একাধিকবার হামলা ও মারধরের শিকার হতে হয় তাদের। ২০১৫ সালের এপ্রিলে পহেলা বৈশাখে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে টানা কয়েক মাস কর্মসূচি ছিল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের। সেখানেও পুলিশ হামলা করেছিল। ২০১৬ সালে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হলেও বিভিন্নভাবে তাদের দমানো হয়।

২০১৭ সালের ২৯ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবি জানাতে গেলে শিক্ষকদের বাধার মুখে পড়েন একদল শিক্ষার্থী। ওইদিন ছাত্র-শিক্ষকের হাতাহাতি হলে পরদিন ঘটনা তদন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ফজলুর রহমান ও মাকসুদুর রহমান এবং লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আফতাব আলী শেখকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি হয়। কমিটির একজন সদস্যের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যে ওই কমিটির সদস্য ছিলাম, সেটিই তো মনে নেই।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews