বাংলাদেশের অর্থনীতি এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী আশাবাদ ফিকে হতে হতে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অনেকটা দুরাশার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং শিল্পবিরোধী নীতির কারণে দেশের বেসরকারি খাত, বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। দেশের শিল্প-কলকারখানায় যে গ্যাসসংকট চলছে, তার ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, শিল্প-কলকারখানায় গ্যাসসংকটের জন্য ৭০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তারা। এ সংকট জিইয়ে রেখে প্রকারন্তরে তাদের প্রাণে মারা হচ্ছে। রাজধানীর গুলশান ক্লাবে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-সহ বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই), ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) ও প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিজিএমইএ) যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শিল্পে গ্যাসের সমস্যা দিনদিন বাড়ছে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু উপদেষ্টা এখনো উট পাখির মতো বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছেন, বাস্তবতা দেখতে পারছেন না। শিল্প বাঁচানো না গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে, যা দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলার কারণ হবে। শিল্পবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের শিল্প-কলকারখানাগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্যাসসংকটের কারণে শিল্পোদ্যোক্তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, মূলধন কমে গেছে। আগামী ঈদে তারা বেতনভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারবেন কি না, সে আশঙ্কায়ও ভুগছেন। আমরা এ কলামে বারবার বলেছি, ব্যবসা সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর যতটুকু এগিয়েছে, তা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। এ সত্যকে মনে রেখে ব্যবসাবান্ধব নীতি অনুসরণ জরুরি। শিল্প-কলকারখানা সচল রাখতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে এখনই।

মানুষ এখন দ্বিমুখী সংকটে আছে। একদিকে গ্যাসের সরবরাহ কম, অন্যদিকে নতুন শিল্পকারখানায় দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে। এটি বেষম্যমূলক প্রস্তাব। পুরোনো শিল্পের সঙ্গে নতুন শিল্প প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। এতে বিনিয়োগে উৎসাহ কমে যাবে। ইতিমধ্যে সরকার যে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়ে দিয়েছে, তা জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল, ভ্যাট বাড়ানোর পর আরও অনেক পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে। মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, কলাবাগান, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ নেই। দিনে গ্যাস না থাকায় অনেক স্থানে রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও গ্যাসের চাপ কম। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয় শিল্পকারখানায়। এবার গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। গত রোববার গাজীপুরে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ কোটি ঘনফুট। নারায়ণগঞ্জেও চাহিদামতো গ্যাস পায়নি তিতাস। ফলে রপ্তানিশিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত নারায়গঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানাগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। কোথাও কোথাও রেশনিং করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই গ্যাসসংকট বেড়েছে। তারা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চেয়ে বিদেশ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানির ওপর জোর দিয়েছিল। এর পেছনে কমিশন বাণিজ্যও ছিল। কিন্তু উত্তরণের পথ তো বের করতে হবে। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের সময় বাড়িয়ে উন্মুক্ত করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে, সরকার দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ইতিবাচক হলেও সময়সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে সরকারকে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি তরল গ্যাস আমদানির পরিমাণও বাড়াতে হবে। চালু গ্যাসক্ষেত্র থেকে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যায় কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। ভোলার গ্যাস দেশের অন্যান্য স্থানে এলএনজির মাধ্যমে সরবরাহের কাজটিও জোরদার করা প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জ্বালানি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। বর্তমান সরকার লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে আমরা এও আশা করি, গ্যাস খাতের দুর্নীতির ছিদ্রগুলো বন্ধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এখনো বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে, যা থেকে রাষ্ট্র কোনো অর্থ না পেলেও ফায়দা নিয়ে যায় দুর্নীতিবাজরা। সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট জিইয়ে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবে না। রেশনিং পদ্ধতিতে কারখানা চালু রাখতে হলে মালিকের ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে। দেশবাসী অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে একটি বাস্তবমুখী নীতি-পরিকল্পনা এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করে।

পেট্রোবাংলা বলছে, পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করা হলে অথবা নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে ব্যবসায়ীদের পুঁজি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদেরই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের ফসল শিল্পকারখানা জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এগুলোতে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। কিন্তু নানা কারণে ব্যাংকগুলো এ সময় তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারছে না। সব মিলে শিল্প খাত কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কর্মসংস্থান, প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও জাতীয় অর্থনীতির অভীষ্ট সমৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে এ খাতের সব সংকট দূর হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য কার্যকর বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হোক। বিলম্বে ক্ষতিবৃদ্ধি; তাই শুভস্য শীঘ্রম। বেড়েছে গ্যাসের দামও। ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগের দাম বাড়ানোর ফলে এর চাপ পড়ছে দৈনন্দিন রান্নাবান্নায়। যে বা যারা বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন, তাদের প্রতি মাসে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সিস্টেম লস কমালে গ্যাস সরবরাহে সাশ্রয়ী হওয়া যেত।

আমি মনে করি, দেশ ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে বেসরকারি খাতকে আস্থায় নিতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের হয়রানি বন্ধ করা, তাদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার মতো পদক্ষে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কোনো প্রকার হয়রানিই কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews