২০১৮ সাল আবারও বাংলাদেশের জন্য নতুন এক সন্ধিক্ষণ তৈরি করেছে, এই সন্ধিক্ষণ সাফল্যেরও হতে পারে, হতে পারে ব্যর্থতারও। এই দুই সম্ভাবনা নিয়েই নতুন বছর শুরু হলো এবং বছরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে মোটামুটি এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটি স্থির লক্ষ্য নিয়েই এগুতে চাইছে। এই লক্ষ্য মূলত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান, যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের চেয়ে ভিন্নতর কিন্তু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ এবং রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে আমরা ধরে নিতে পারি।
অপরদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট এখনও তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি বিশেষ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে যে স্থির কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সেটা তাদের কর্মকাণ্ডেই স্পষ্ট। এতদিনেও বিএনপি’র পক্ষ থেকে নির্বাচনি সহায়ক সরকারের কোনও রূপরেখা তাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি, ফলে দলটির নেতাকর্মী বা সমর্থক কারও পক্ষেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হচ্ছে না। শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচন নয় সেটা দলটির পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও নির্বাচনটি কার অধীনে কী ভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানা না গেলে কারও পক্ষেই যে যুক্তি দিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয় সেটা বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিজীবী বা টকশোজীবীদের বক্তব্য শুনলেই বোঝা যায়। একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে দলটির সমর্থকগোষ্ঠীর ভেতর যে হতাশা তৈরি হয় তা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়।

কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কারও সঙ্গে কথা হলে তারা যে ধরনের ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেন তাতে যে কারোরই মনে হতে পারে যে দলটি বুঝি ২০১৮ সালের শেষার্ধে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন হয়েই আছে। যতই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বা দলটির সাধারণ সম্পাদক আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করুন না কেন, তাতে খুব কম নেতা-কর্মীকেই কর্ণপাত করতে দেখা যায়। এদেশের সকলেই এখন আওয়ামী লীগের হয় নেতা, না হয় কর্মী কিংবা সমর্থক, এরকমটাই লক্ষ্যমান। অন্য কোনও রাজনৈতিক দল যে এদেশে আছে সেটাই বোঝার উপায় নেই, জামায়াত সমর্থকও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বদান্যতায় রাতারাতি আওয়ামী লীগে নাম লিখিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই জানা যায়। এমন অবস্থায় রাজনীতিতে বা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আওয়ামী লীগের বিশেষ করে যারা ২০১৪ সালে এমপি হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং তারা যে একটি বিশাল সমর্থক-বাহিনী তৈরি করেছেন তাদের কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তারা এখনও ব্যস্ত আছেন তাদের আখের গোছানোর চেষ্টা ও চিন্তায়। এজন্য দেশ ও দলের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হলো কী হলো না তা নিয়ে তাদের কিছুই এসে যায় না। সেরকমই যদি না হবে তাহলে নির্বাচনের বছরে এসে যখন ক্ষমতাসীন সরকারি দলের আরও বেশি সচেতন ও জনঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা তখন তারা কেমন যেন লাগামছাড়া এবং এক ধরনের চিন্তাহীনও। যেন দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার একমাত্র দায়িত্ব শেখ হাসিনার। তিনি তার একক কারিশমা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন আর বাকিরা দলটির সমর্থক সেজে সকল প্রকার সুবিধা ভোগ করবেন।

নির্বাচনের বছরে যে কোনও সরকারের ক্ষেত্রেই শত্রুসংখ্যা অন্য যে কোনও সময়ের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সমস্যাটা আরও ভিন্ন। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল মূলত: দু’টি, এক. আওয়ামী লীগ এবং দুই. আওয়ামী-বিরোধী, এই দ্বিতীয় পক্ষে কেবল বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভাবলে চলবে না, বরং এমন অনেক ব্যক্তি ও দল আওয়ামী-বিরোধিতায় জীবন পার করে দিয়েছেন, যে বা যারা তাদের বিরোধিতার নামের এই বিরোধিতা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতি করতেন তাহলে হয়তো তারা এদেশের মানুষের আরও শ্রদ্ধাভাজন হতে পারতেন। ফলে আমরা শুরু থেকেই দেখে আসছি যে, এদেশে আওয়ামী-বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটি বেশ শক্ত ও পোক্ত। আর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছরে এসে এই বিরোধিতায় আরও যে পক্ষটি কোমরবেঁধে নামেন তারা আওয়ামী লীগেরই সুবিধা-বঞ্চিত অংশ, অন্য সকল বিরোধীদের চেয়েও কখনও কখনও এরা ভয়ঙ্কর হয়ে থাকেন। বাকিদের বিরোধিতা সামাল দেওয়া সম্ভব হলেও এই ঘরের শত্রুদের সামাল দেওয়া বেশিরভাগ সময়ই সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে দলটিকে যে মহা বিপদে পড়তে হয় তা হলো এই আওয়ামী লীগাররাই যখন সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে তখন জনগণ সেটা সহজেই বিশ্বাস করে আর এ কারণেই এ সমস্ত বিরুদ্ধাচারীদের আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষ নির্বাচনের বছরে বেশ মূল্য দিয়ে পালতে শুরু করে।

আমরা লক্ষ্য করে দেখছি এরকম বেশ কিছু চেহারা ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করতে শুরু করেছেন আর এমনিতে ঘরোয়া আলোচনায় এসব চেহারার আধিক্য এখন বেশ লক্ষ্যণীয়।

কিন্তু ২০১৮ সালের শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, সামনের দিনগুলো কোনোভাবেই সুখকর নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ যে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এমন অবস্থায় সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কেমন হবে বা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে কোনও ফোরামেই কোনও আলোচনা এখনও আমার চোখে পড়েনি। আমার মনে হয় দলটির নীতি-নির্ধারক মহল থেকে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা আসা উচিত।

আগেই বলেছি যে, দলটির নেতৃত্ব পর্যায়ে যতটুকু সতর্কতা ও সংযত আচরণ লক্ষ্য করা যায় তার কিয়দ্বংশও দলটির তৃণমূলে দেখা যাচ্ছে না। হতে পারে পরপর দু’বার ক্ষমতায় থাকার ফলে দলীয় নেতাকর্মীদের ভেতর এক ধরনের ‘আলগা সাহস’ তৈরি হয়েছে, যা সাধারণ ভোটারদের জন্য নিঃসন্দেহে পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভোট আসার আগেই। মানুষ তার পরিচিত চেহারাকে যতোই দাম্ভিক হিসেবে প্রমাণ পেতে থাকে ততোই তার দিক থেকে সমর্থন বা সহমর্মীতা দূরে সরে যেতে শুরু করে, এটাই স্বাভাবিক। ফলদায়ী বৃক্ষ ন্যুয়ে পড়ে– প্রবাদটি এ কারণেই বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয়েছে।

একটা ছোট্ট ও সাধারণ উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানবো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দু’বারের সরকার দেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন করেছে তা সাধারণ মানুষের কাছে এখন দৃশ্যমান। কেবল সেগুলো প্রচারণায় কিভাবে ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণ করাটা জরুরি। কেন্দ্র থেকে সে বিষয়ে প্রচার-কৌশলও নির্ধারণের কথা বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু সেটা না করে বেশিরভাগ নেতাকর্মীকেই এখনও পর্যন্ত বিএনপি নেত্রী বা বিএনপি’র সমালোচনাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সমালোচনা করা যাবে না তা নয়, কিন্তু নিজেদের সফলতা প্রমাণের জন্য এখন আর দল হিসেবে বিএনপি বা তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনার প্রয়োজন নেই, দৃশ্যমান উন্নয়ন দিয়েই আওয়ামী লীগের সফলতা প্রমাণ করা সম্ভব। বরং বিএনপি বা বিএনপি নেত্রীর যতো সমালোচনা করা হবে ততোই তারা মানুষের ‘সিমপ্যাথি’ পেতে থাকবেন, এদেশের মানুষের মনস্তত্ত্ব যে ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষের পক্ষে অনেক সময় কাজ করে তার প্রমাণও কিন্তু এদেশ থেকেই দেওয়া যেতে পারে। বরং এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে একটি উন্নয়নের শ্বেতপত্র প্রকাশ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে গত দশ বছরে দেশ কতটা এগিয়েছে সেটা উল্লেখ থাকবে আর কোন ক্ষেত্রে দেশ এখনও পিছিয়ে আছে এবং এই পিছিয়ে থাকার কারণ বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে ক্ষমতায় গেলে তা কিভাবে সমাধান করা হবে তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে। কিন্তু সেসব না করে সেই গতানুগতিক ধারায় একটানা আরেকটি রাজনৈতিক দলের সমালোচনা জনগণ কতোটা গ্রহণ করবে সে বিষয়ে নিশ্চিত সন্দেহ রয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একটি পরিপক্ক রাজনৈতিক দল বলেই বিশ্বাস করি, তাকে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই বিষয়গুলো সামনের সংকটময় দিনগুলোতে দলটি নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিলে উপকার বৈ অপকার হবে না।

সর্বশেষ, এখনও নির্বাচনের এক বছর বাকি, এখনও সরকারে থেকে আওয়ামী লীগকে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্তই নিতে হবে। সেগুলো যেন জনবান্ধব হয় এবং জনকল্যাণকর হয় সে বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারকদের নজর থাকাটাও বাঞ্ছনীয়। যেমন, ঐতিহ্যবাহী ও একাত্তরের স্মৃতিময় যশোর রোড প্রশস্তকরণের জন্য হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলার যে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা কোনোভাবেই গণবান্ধব-পরিবেশবান্ধব সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এমনকি নির্বাচনের বছরেও উন্নয়নের নামে এই বৃক্ষনিধন যজ্ঞকে কোনও ঘোর আওয়ামী সমর্থকও মেনে নেবেন বলে মনে করি না। অবিলম্বে সরকারের উচিত এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। আদালত যদিও এরই মধ্যে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু এরকম সিদ্ধান্ত যে একটি সরকারকে চরম বিপদে ফেলতে পারে এবং ভবিষ্যতে ভোটের রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়টি যে আওয়ামী লীগের মতো দলকে স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে সেটাই  বিস্ময়কর ঠেকছে আমার কাছে। রাজনৈতিক দল যে ক্ষমতায় গিয়ে কেবল ‘সরকার’ হয়ে যায়, অন্তত আওয়ামী লীগের মতো স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দলের কাছ থেকে সেটা কেউ আশা করে না।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

masuda.bhatti@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews