আমি শুধু সত্যটা লিখেছিলাম। এটাই ছিল আমার অপরাধ। তিন ঘণ্টা ধরে আমাকে পেটানো হয়েছে। সেই পিটুনির দাগ আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। এখনও মাঝে মাঝে কোমরে তীব্র ব্যথা হয়।

সাংবাদিকতা একটি আন্দোলন, সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলন। সাংবাদিকতাকে নিছক একটি চাকরি নয়। এটি এমন এক পেশা যা, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো, অন্যায়কে অন্যায় বলে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ে ওঠে। যখন গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়, তখন গণমাধ্যম হয় সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা। সেই ভরসার জায়গাটি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে ছিল না। ফ্যাসিবাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, পৃথিবীর যেসব জায়গায় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই দেশগুলোতে ফ্যাসিস্টরা সর্বপ্রথম গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরেছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সেই কাজটিই করেছেন। তার শাসনামলে তার বশংবদ শ্রেণীর সাংবাদিক ছাড়া অন্যদের নানাভাবে হুমকি-ধামকির মধ্যে জীবন পার করতে হয়েছে। সাগর সারোয়ার এবং মেহেরুন রুণির রক্তাক্ত লাশ মেঝেতে পড়ে থাকতে আমরা দেখেছি। এই সংবাদটি আমরা কভারও করেছি অনেকে। কিন্তু আজও বিচার হয়নি। সাংবাদিকতাকে আমি এখন দুভাবে দেখি। তার একটি ‘জুলাই সাংবাদিকতা’, আরেকটি ‘যুদ্ধদিনের সাংবাদিকতা’। যদি জুলাইয়ের সাংবাদিকতা শেখ হাসিনার দিক থেকে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেটি ছিল ফ্যাসিবাদ রক্ষার সাংবাদিকতা। সে সাংবাদিকতা ছিল ফ্যাসিস্টের মুখপাত্রে পরিণত হওয়ার সাংবাদিকতা। আমরা, যারা সাংবাদিকতার নীতিমালাকে শ্রদ্ধা করতাম, আমরা সংখ্যায় ছিলাম অল্প। আমরা অনেকে নানাভাবে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে চাকরিও হারিয়েছে।

আমি জার্মানভিত্তিক দ্য মিরর এশিয়ার বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ ছিলাম। যার কারণে, আমার অফিসের ওপর সরাসরি সেন্সরশিপ আরোপ করা শেখ হাসিনা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। কারণ, এটি জার্মানির বন শহর থেকে প্রকাশিত হতো। ফলে এই খবরগুলো কোনো ধরনের সেন্সরশিপ ছাড়াই করা যেত, যা অনেকেই সাহস করে ছাপতে পারেননি। ১৫ জুলাইয়ের পর, যখন রাজপথ সাধারণ শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক কর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল, তখনও আমাদের হাতে কলম ছিল, চোখে দৃষ্টি ছিল, আমাদের ক্যামেরায় লেন্স ছিল। কিন্তু আমরা অনেকেই তা দেখাতে পারিনি। আমি সেটুকু দেখানোর চেষ্টা করেছি। যারা করেননি, তাদের কথা আনতে চাই না। কারণ, হাসিনার তোষামোদকারিদের নিয়ে কথা বলার মানে হয় না। যারা বিবেকের দংশনে দংশিত হয়েও ভয়ে সত্যটা তুলে ধরতে পারেননি, আমি তাদের সম্মান জানাই। সেটিকে মূল্যায়ন করি। আমাদের অনেকে পারেননি, তবে আমি সেটা করবার চেষ্টা করেছি। যেদিন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে আগুন দেয়া হয়, তখন তা আন্দোলনকে দমন করবার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেয়া হয়েছিল। সাংবাদিকরা জানেন, পেট্রোল বোমা ও গান পাউডার কালচার শেখ হাসিনার হাত ধরেই এসেছে। তিনি মনে করেছিলেন, হত্যা ও ধ্বংসের সংস্কৃতি চালু করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমানো যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

১৮ জুলাইয়ের পরে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথমে আমি ভিস্যাটের মাধ্যমে খবর পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। পরে সেই ব্যান্ডউইথ সংকুচিত করে দিলে ছবি বা ভিডিও কিছুই পাঠানো যাচ্ছিল না। তখন আমি সরাসরি মোবাইল ফোনে বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে ৪৯ টাকা মিনিটে কল করে সংবাদ দিচ্ছিলাম এবং বন শহরের অফিস তা লিখে নিচ্ছিল। সেই সময় হাসপাতাল থেকে ডেথ রেজিস্ট্রার গায়েব করা হচ্ছিল, পোস্টমর্টেম ছাড়া লাশ ফেরত দেওয়া হচ্ছিল, সঠিক মৃত্যুর সংখ্যা লুকানো হচ্ছিল। এমনকি পুলিশেরও কিছু সদস্য জনরোষে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই খবরগুলো যখন ‘দ্য মিরর এশিয়ান’-এর রেফারেন্সে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ হতে থাকে, তখন ফ্রান্সের একটি দৈনিক ‘নাইন গ্রেড চাইল্ড কিল্ড ইন ঢাকা’ শিরোনামে লিড নিউজ করে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গণহারে হত্যার এই সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে, শেখ হাসিনা মেট্রোরেল পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যারা বিদেশে তথ্য পাচার করছে, তাদের চিহ্নিত করেছি, শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে’। ওই রাতেই আমার হাতে হাতকড়া পড়ে। এর আগে আমি, কাদের গণি চৌধুরী (সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব), ডিইউজের সহসভাপতি রাশেদুল হকসহ অন্যদের নিয়ে প্রতিদিন প্রেসক্লাবের সামনে এই হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছি, বক্তৃতা দিয়েছি। কিন্তু শেখ হাসিনার ঘোষণার পর মনে এক ধরনের ‘সেন্সর সিগন্যাল’ কাজ করতে শুরু করে। আশঙ্কা জাগে। সেদিন রাত ১১টার দিকে আমার মগবাজারস্থ বাসায় ফিরি। আমার ছোট সন্তান অসুস্থ, তার গলায় অপারেশন হয়েছে। বড় ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। আমি আমার স্ত্রীকে কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি সেফ জায়গায় চলে যাব’। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে আমি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাব, এই সময়েই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি আমাকে ফোন করেন। তিনি প্রায়ই আমার কাছ থেকে কিছু তথ্য ও আপডেট নিতেন। যখন তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলছিলাম, সেই আলাপও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ট্র্যাক করে ফেলে। এরপর থেকেই তারা আমাকে সন্দেহ করতে থাকে, এই নাশকতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে। ২৫ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার, রাত একটার দিকে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়া হয়। বাইরে থেকে বলা হয়, ‘ওয়াইফাই ঠিক করতে এসেছি’। এই অজুহাতে দরজা খুলতেই ১৫-১৬ জন সাদা পোশাকধারী লোক ঘরে ঢুকে পড়ে। আমার অসুস্থ ছোট সন্তান ও ক্লাস নাইনে পড়া বড় ছেলের সামনে তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। এমন অশ্লীল ও জঘন্য ভাষা, যা কল্পনাও করা যায় না। তারা সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যÑবিসিএস ক্যাডার, কমিশনড অফিসার, বিভিন্ন বাহিনীর মিশ্রণ। আমার স্ত্রীকেও তারা এমন ভাষায় গালি দেয়, যা আমরা সবচেয়ে তিক্ত পরিস্থিতিতেও কোনো নারীকে বলি না। আমার ছেলেকেও তারা ‘ছাত্রশিবিরের কর্মী’ সন্দেহ করে তুলে নিতে চায়। আমি অনুরোধ করি, ‘আমাকে নিয়ে যান, আমাকে যা খুশি করেন, কিন্তু আমার পরিবারকে স্পর্শ করবেন না, প্লিজ’। পরে তারা আমাকে গাড়িতে তোলেন। চোখ বেঁধে, দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে, মাথায় একটি কালো টুপি পরিয়ে দেয়। আমি নিজেই বহুবার এই টুপির সংবাদ করেছি। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের কীভাবে এই টুপির আড়ালে নির্যাতন করা হয়। তাদেরকে বললাম, ‘আমি তো কোনো সন্ত্রাসী না, আমাকে কেন এভাবে নিচ্ছেন?’ তখন পেছন থেকে একটি শক্ত কিছু দিয়ে, সম্ভবত লাঠি বা শটগানের বাট, আমার ঘাড়ের পেছনে ১৫-২০ বার আঘাত করা হয়। মনে হচ্ছিল, আমার চোখ বেরিয়ে আসবে, দাঁত খসে যাবে। আমার পাঁজরের পেছনে বেশ কয়েকবার বক্সিংয়ের মতো আঘাত করে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তখনই বুঝে যাই, এদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই, চুপ থাকাই ভালো। গাড়িতে করে দুই ঘণ্টা ঘোরানোর পর তারা আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যান। একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। হঠাৎ একজন এসে বলেন, ‘আসেন’। তখনও চোখ বাঁধা। দুইজন আমাকে ধরে নিয়ে দুই হাত ধরে ঝুলিয়ে দেয়, শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেই রাতটি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত হয়ে থাকবে। পুরো রাত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে চাপে রাখা হয়, যেন জোর করে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়। অথচ যেদিন রাজধানীতে মেট্রোরেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, সেদিন আমি ছিলাম ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে। একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে ব্যস্ত। বহু সহকর্মী ছিলেন, রেজিস্ট্রার খাতা ও প্রবেশ-প্রস্থান লগে আমার নাম আছে। তবু আমাকে সেই মামলার প্রধান আসামি বানানো হয়। পরদিন আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়। আমার প্রশ্ন, এই রাষ্ট্র কি এতটাই ভয়ানক নীরব, যে একজন সাংবাদিককে তুলে নিয়ে তার সঙ্গে এমন আচরণ করা যায়? আমি একা নই। এই ‘জুলাই স্মৃতি’ বহু সাংবাদিক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের জন্যই এখন এক আতঙ্কের নাম। জুলাই মাসজুড়েই সাংবাদিক সমাজ ছিল আতঙ্কে। চার সাংবাদিক খুন হয়েছেন, দুই শতাধিক আহত, আর অসংখ্য গুম, গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাকে যেভাবে মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হলো, আমার স্ত্রী-সন্তানের চোখের সামনে যেভাবে অসম্মান করা হয়েছে, তা শুধু ব্যক্তি সাঈদ খানের ওপর নয়, তা ছিল সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশ, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বর্বরতার নগ্ন প্রকাশ। সেদিন আমি অনুভব করেছি, গত দেড় দশক ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনে রাজনৈতিক কর্মীরা যেসব ভয়াবহ নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, আমি তার এক ক্ষুদ্র ঝলক মাত্র দেখেছি।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews