চুয়াডাঙ্গার সবকিছুই এখন ক্ষমতাসীন দলের দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। বড় ভাই সদর আসনের সংসদ সদস্য এবং জাতীয় সংসদের হুইপ সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন) আর ছোট ভাই পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার। বড় ভাই বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর ছোট ভাই এবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ভাইদ্বয়ের আশীর্বাদ না থাকায় জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ গত বছরের ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন। এরপর থেকে তিনি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ২০০৪ সালের ১৬ এপ্রিল। সেখানে সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দারকে সভাপতি ও আজাদুল ইসলাম আজাদকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। আর বছর খানেক আগে বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এখনো চলছে সেভাবেই। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের শুরুতেই নেতাদের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়। তৈরি হয় গ্রুপিং। নেতারাও যে যার মতো গ্রুপ নিয়ে সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন শুরু করেন। ওই সময়ে ছোট এই জেলা শহরে বিএনপির তিনটি কার্যালয়ও তৈরি হয়। একটি অফিস বন্ধ হলেও দলের এই দুঃসময়ে বিভক্তি দূর হয়নি নেতাদের মধ্যে।
সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গাতে দুইটি সংসদীয় আসন। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের (আলমডাঙ্গা ও সদর) সংসদ সদস্য সোলাইমান হক জোয়ার্দ্দার। এখানে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। ভেতরে ভেতরে একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ সমালোচনা করলেও প্রকাশ্যে কেউ টু শব্দ করে না। আর চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের (জীবননগর ও দামুড়হুদা) সংসদ সদস্য আলি আজগর টগর। এই এলাকায় তার পক্ষে দল ও প্রশাসনসহ সবকিছু দেখভাল করেন তার ছোট ভাই আলি মনসুর।
এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিষ্টভাষী ও সুবক্তা হিসেবে পরিচিত জেলা সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ সপরিবারে বসবাস করেন দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌর শহরে। দর্শনা থেকে জেলা সদরে এসে   আওয়ামী লীগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের জেলা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে কার্যত সমস্যা সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সংগঠনের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে তিনি দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ সময় উপজেলা পরিষদে তার ব্যস্ততার কারণে দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। এরপর গত বছর অনুষ্ঠিত দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি। হুইপ এবং তার ভাই সমর্থন দিয়েছিলেন অন্য একজনকে।
নিজের পরাজয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আজাদুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘জোর করেই আমাকে পরাজিত করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার রাজনীতি এখন একটি পরিবারের পকেটে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের চেয়েও চুয়াডাঙ্গায় এই পরিবার শক্তিশালী। এক ভাই সভাপতি, আরেকভাই সাধারণ সম্পাদক হতে চান। বড় ভাইয়ের ছেলে নাঈম হাসান জোয়ার্দ্দার যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। আরেক ভাইয়ের ছেলে মোহাইমেনুল জোয়ার্দ্দার ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার জন্য ব্যানার-ফেস্টুন টাঙ্গিয়েছেন। ফলে ওই পরিবারের বাইরে কেউ কোন পদ পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘এদের কারণে আওয়ামী লীগ এখন চুয়াডাঙ্গায় জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন। তাই জনগণের সঙ্গে থাকতে গত প্রায় দেড় বছর নিষ্ক্রিয় রয়েছি। প্রয়োজন হলে আবার সক্রিয় হব।’
এমন পরিস্থিতিতে গত তিন মাস ধরে চুয়াডাঙ্গায় আলোচনা চলছে এমপির ছোট ভাই পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন আসছেন সংগঠনের জেলা সাধারণ সম্পাদক পদে। এ জন্য তিনি কাজও শুরু করেছেন। জেলা শহরের বিভিন্ন দেয়াল লিখন এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লটকানো হয়েছে একাধিক ডিজিটাল পোস্টার। তবে এক ভাই সভাপতি আর আরেক ভাই সাধারণ সম্পাদক হবে এমন বিষয় স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না নেতাকর্মীরা।
এসব বিষয় নিয়ে হুইপ সোলাইমান হক জেয়ার্দ্দার ইত্তেফাককে বলেন, ‘চারবার পরাজিত হওয়ার পর আমি এমপি হয়েছি। এর জন্য তো কাউকে দোষারোপ করিনি। কেউ নিজের অবস্থান হারালে অন্যরা সেই জায়গা দখল করবে।’ আপনি সভাপতি আর আপনার ভাই সাধারণ সম্পাদক হতে চান- এটা কিভাবে সম্ভব? জবাবে তিনি বলেন, ‘চাইলেই তো আর কেউ হয়ে যাচ্ছে না। কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত হবে। নেতাকর্মীরাই ঠিক করবেন কে সাধারণ সম্পাদক হবে। চুয়াডাঙ্গায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি আমরাই প্রতিষ্ঠিত করেছি। এখন দলের অবস্থান সুসংহত।’
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলি আজগর টগর বেশির ভাগ সময় ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় থাকেন। তার অনুপস্থিতিতে ছোট ভাই আলি মনসুর বাবু রাজনীতি দেখভাল করেন। ঠিকাদারি ব্যবসা ও প্রশাসনও তিনিই দেখভাল করেন। এখানে আওয়ামী লীগে গ্রুপিং আছে। দর্শনা পৌরসভার সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগের পৌর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান এমপি বিরোধী গ্রুপে নেতৃত্ব দেন। তার সঙ্গে আছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের প্রশাসক মাহফুজুর রহমান ও জীবননগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোর্তুজা।
তবে একটি জায়গায় চুয়াডাঙ্গাতে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দারুণ মিল। আর তা হলো ঠিকাদারি কাজ। আওয়ামী লীগের নেতারা একটু বেশি নেন; কিন্তু বিএনপি সমর্থক ঠিকাদারদের একেবারে বাদ দেন না। তারাও কিছু কাজ করছেন। সবকিছুই হচ্ছে সমঝোতার ভিত্তিতে। এমন সুবিধার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। নিজেদের কোন্দলের কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে দল চলছে। আয়োজন হয়নি কাউন্সিলের।
প্রয়াত সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বিশ্বাসের ছোট ভাই সংগঠনের বর্তমান আহ্বায়ক অহিদুল ইসলাম বিশ্বাস নিজেই শহরের কেদারগঞ্জ মহল্লায় একটি অফিস নিয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এদিকে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে শহরের শেখপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় সাবেক সংসদ সদস্য ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর ছোট ভাই জেলা যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াহেদুজ্জামান বুলার নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপও পৃথকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। এছাড়া জেলা বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক ও যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আব্দুল জব্বার সোনার নেতৃত্বাধীন আরেকটি গ্রুপও শহরের শহীদ আলাউল মিলনায়তনের কাছে নিজ ঠিকাদারি অফিসে দলীয় কার্যক্রম চালান। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় নেতাকর্মীর মধ্যে হতাশা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
গত জানুয়ারিতে আন্দোলনের সময় পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলা মামলায় গ্রেফতার হন জেলা আহ্বায়ক অহিদুল ইসলাম বিশ্বাস। কিছু দিন কারাবাসের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি কেদারগঞ্জ বাজারের দলীয় কার্যালয়টি বন্ধ করে সাইনবোর্ড নামিয়ে দেন। এরপর সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের সর্বশেষ মৃত্যু বার্ষিকীর কর্মসূচি পৃথকভাবে তিনি পালন করেন। এতে আহ্বায়ক কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরপর অহিদুল ইসলাম গত ২৭ জুন জেলা আহ্বায়ক কমিটির বৈঠক আহ্বান করলে ওই বৈঠকে ৪২ জনের মধ্যে মাত্র ৯ জন উপস্থিত হন। ফলে বর্তমানে তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, তিনজন শিল্পপতি সম্প্রতি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। তারা হলেন- মাহমুদ হাসান খান বাবু, মখলেছুর রহমান তরফদার টিপু ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুজ্জামান। কাউন্সিল হলে কমিটিতে তারা ঠাঁই পাবেন বলেই নেতাকর্মীদের ধারণা।

চুয়াডাঙ্গা জেলায় জামায়াতেরও শক্তিশালী সংগঠন আছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা হাবিবুর রহমান বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনে জীবননগরে জামায়াত তাণ্ডব চালায়। দায়েরকৃত নাশকতার মামলায় তারা এখন ন্যুব্জ। কৌশল বদল করে গোপনে সাংগঠনিক তত্পরতা চালাচ্ছে। তাদের নারী কর্মীরা বেশি সক্রিয়। জামায়াতের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার এড়াতে বর্তমানে আত্মগোপনে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews