মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের একটি প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্কের ঝড় চলছে। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোও বিতর্কে যোগ দেয়ায় এতে কৌশলগত নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। প্রবল প্রচারণায় আচ্ছন্ন এই ইস্যুর নিরাসক্ত বাস্তবতা উপলব্ধি করার সুযোগ সীমিত হয়ে উঠেছে। এই ইস্যুর সাথে বাইরের প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদাররাও যুক্ত হয়ে পড়ায় এর সংবেদনশীলতা অনেক বেড়েছে। এ কারণে বিষয়টির সঠিক অবস্থা বোঝাটাও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।
জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি
জাতিসঙ্ঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক চ্যানেল/করিডোর বা বাধাহীন মানবিক প্রবেশাধিকারের ধারণাকে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিষয় বিবেচনায় আনা হয়।
রোহিঙ্গা সঙ্কট : ২০১৭ সালে নৃশংস সামরিক অভিযানের পর, সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো তখন থেকে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে শরণার্থীদের নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন, রাখাইনে এখনো যারা আছেন তাদের কাছে মানবিক সংস্থাগুলোর প্রবেশাধিকার আর রোহিঙ্গাদের জন্য আইনি অধিকার ও নাগরিকত্বের পথ তৈরি করা।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতা : ২০২১ সালে সেনা-অভ্যুত্থানে অং সান সু চির পতনের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে লড়াই শুরু হয়। সেই সাথে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান, রাখাইনের মানবিক পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে। জাতিসঙ্ঘ এবং পশ্চিমা সরকারগুলো এ কারণে মানবিক প্রবেশাধিকারের অনুমতি দেয়ার জন্য পক্ষগুলোর প্রতি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। একই সাথে তারা সাহায্য, খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের জন্য মানবিক করিডোরের আহ্বানও জানায়। সেনাবাহিনীকে সাহায্য বন্ধ এবং খাদ্যবঞ্চনাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করারও দাবি জানানো হয়।
সর্বশেষ পরিস্থিতিতে তারা যা চায় তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গা এবং রাখাইন জাতিগত বেসামরিক নাগরিকসহ ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কাছে নিরবচ্ছিন্ন মানবিক প্রবেশাধিকার। সাহায্য বিতরণে নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ। সব পক্ষ, বিশেষ করে তাতমাদো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। আর বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বা জাতিগত নির্মূল প্রতিরোধ।
চীন ও ভারতের অবস্থান
রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর সম্পর্কে চীন ও ভারতের অবস্থান জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। কারণ মিয়ানমারে তাদের কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক আলাদা স্বার্থ রয়েছে।
চীনের অবস্থান : মানবিক উদ্বেগের উপর কৌশলগত আগ্রহ রয়েছে চীনের। দেশটি রাখাইনকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখে। বিশেষ করে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (চিএমইসি) চীনা স্বার্থের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যার সাথে রাখাইনের কিয়াকফিউ বন্দর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বিবেচনায় চীন স্থিতিশীলতা এবং বাইরের হস্তক্ষেপ না করার উপর জোর দেয়, প্রায়শই তার অবকাঠামো ও বিনিয়োগ রক্ষার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে একত্রিত হয়।
মানবিক প্রবেশাধিকার প্রসঙ্গে সতর্ক চীন জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে বা পশ্চিমা ধাঁচের মানবিক করিডোরের পক্ষে জোরালোভাবে সমর্থন কোনো সময় প্রদান করেনি। দেশটি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তিকে সমর্থন করে। বেইজিং বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়গুলোকে সীমিত মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে, তবে মিয়ানমারের সামরিক পদক্ষেপের সমালোচনা এড়িয়ে চলে। এ ছাড়া চীন আংশিকভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, চরমপন্থা সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং সীমান্ত অস্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।
ভারতের অবস্থান : কৌশলগত ও নিরাপত্তা স্বার্থকে ভারত সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। দেশটি রাখাইনে কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট প্রকল্পে বিশেষ বিনিয়োগ করছে, যা সিত্তে বন্দরের মাধ্যমে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মিয়ানমারের সাথে সংযুক্ত করে। ভারত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর খুব বেশি চাপ প্রয়োগ এড়িয়ে চলে, কারণ এতে দেশটির প্রকল্পগুলো ব্যাহত হতে পারে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে।
ভারত রাখাইন এবং বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে একেবারেই সীমিত মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। দেশটি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ইঙ্গিত আসার ন্যূনতম আশঙ্কা রয়েছে এমন কোনো ধারণায় সমর্থন দেয় না। এই বিবেচনার সাথে যুক্ত করে দিল্লি রাখাইনে মানবিক চ্যানেল বা করিডোরের বিরোধিতা করে। ভারতও বরাবরই দ্বিপক্ষীয় সহায়তা পছন্দ করে এবং মিয়ানমারের উপর বহুপক্ষীয় চাপ এড়িয়ে চলে। এ ছাড়া ভারত রোহিঙ্গাদের একটি নিরাপত্তা উদ্বেগ হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের বড় সংখ্যক শরণার্থীকে বহিষ্কার করেছে।
সার্বিকভাবে মনে হয় চীন ও ভারত দুই দেশই মানবিক করিডোর নিয়ে বাইরের যুক্ত হওয়ার বিরোধিতা করে ভুক্তভোগীদের সীমিত সাহায্য প্রদানকে সমর্থন করে, যেখানে জাতিসঙ্ঘের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এক্ষেত্রে চীনের প্রধান ফোকাস বিআরআই ও কৌশলগত স্থিতিশীলতায়। আর ভারতের ফোকাস দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযোগ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তায়।
চীন ভারত উভয় দেশই অধিকার-ভিত্তিক মানবিক প্রচেষ্টায় সরাসরি সম্পৃক্ততার চেয়ে সার্বভৌমত্ব, দ্বিপাক্ষিকতা এবং কৌশলগত অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেয়।
মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির অবস্থান
রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোর সম্পর্কে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী (তাতমাদো) এবং আরাকান সেনাবাহিনী (এএ) পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
সাধারণভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী স্বাধীন মানবিক করিডোরের বিরোধিতা করে। সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক নেতৃত্বাধীন করিডোরগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে, এগুলোকে সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বা তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
এটি প্রায়শই সঙ্ঘাতপূর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সাহায্য বন্ধ করে দেয় এবং সাহায্যের অ্যাক্সেসকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। বেসামরিক জনগোষ্ঠী এবং বিরোধীদের চাপ দেয়ার জন্য খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ সীমাবদ্ধ করে।
সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় রাষ্ট্র-অনুমোদিত এনজিওগুলোর মাধ্যমেই, মূলত নির্বাচিত মানবিক সহায়তার অনুমতি দেয়। তাতমাদোর কৌশলগত লক্ষ্য হলো রাখাইনের উপর পূর্ণ আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। স্বাধীন মানবিক করিডোরের অনুমতি দেয়া এএ কর্তৃত্বকে বৈধতা দিতে পারে অথবা তাদের সামরিক সুবিধাকে দুর্বল করতে পারে বলে মনে করে তাতমাদো।
অন্যদিকে আরাকান আর্মি খোলামেলাভাবে মানবিক সহায়তার জন্য জোরালো সমর্থন জানায়। এএ বিশেষ করে সঙ্ঘাতপ্রবণ এলাকায় মানবিক করিডোরগুলোকে সমর্থন করে। আরাকান আর্মি প্রায়শই আন্তর্জাতিক সংস্থা এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোকে হস্তক্ষেপ করার জন্য বা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সাহায্যের অনুমতি দেয়ার জন্য চাপ দেয়ার আহ্বান জানায়।
আরাকান আর্মি রাখাইনের কিছু অংশে সমান্তরাল বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছে, যার মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য, পুলিশিং এবং দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া। এটি রাখাইনে একটি শাসক কর্তৃপক্ষ হিসেবে তার বৈধতা বৃদ্ধির জন্য মানবিক সহায়তার জন্য সমর্থন ব্যবহার করে।
আরাকান আর্মি রাখাইনের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন বা কনফেডারেল মর্যাদা চায়, তাই মানবিক সহায়তার জন্য সমর্থন একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় উদ্দেশ্যেই কাজ করে। এটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনে সহায়ক হয়।
রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির ধারণা নিয়ে জাতিসঙ্ঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো সতর্ক এবং বিভক্ত। তাদের অবস্থান মানবিক সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতার মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য প্রতিফলিত করে।
জাতিসঙ্ঘ-প্রয়োগকৃত নিরাপদ অঞ্চলের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানায়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক-প্রয়োগকৃত নিরাপদ অঞ্চলের বিষয়টি (যেমন সিরিয়া বা বসনিয়ায় দেখা গেছে) আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের অভাবের কারণে জাতিসঙ্ঘ অনুমোদন করেনি। এক্ষেত্রে সামরিক সংঘর্ষের ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের আপত্তি ও সহযোগিতার অভাবও সক্রিয়।
‘নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের’ উপর জোর দেয় ইউএনএইচসিআর (শরণার্থী সংস্থা)। এর লক্ষ্য হলো- রাখাইনের অভ্যন্তরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যেখানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে। তারা যেন নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার, চলাচলের স্বাধীনতা এবং পরিষেবাগুলোতে প্রবেশাধিকার পায়। প্রত্যাবর্তনকারীদের সুরক্ষার জন্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকবে কিন্তু তা সামরিকায়িত নিরাপদ অঞ্চল হবে না।
পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান
পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য সমর্থন দেয় কিন্তু সামরিক নিরাপদ অঞ্চলের কথা বলে না। পশ্চিমা সরকারগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করে, এটিকে জাতিগত নির্মূল বা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং জবাবদিহিতাকে সমর্থন করে। তবে, তারা বিদেশী সৈন্যদের দ্বারা প্রয়োগ করা ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এর জন্য জোর দেয়নি, কারণ এতে তারা আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি দেখতে পায়। তারা চীন, রাশিয়া ও আসিয়ানের বিরোধিতা করার সম্ভাবনা দেখতে পায়।
একটি আনুষ্ঠানিক অঞ্চলের পরিবর্তে, পশ্চিমারা কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে ‘নিরাপত্তার পরিস্থিতি’ তৈরি করার কথা প্রচার করে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে মিয়ানমার-বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তি চায়।
কিছু পশ্চিমা কর্মকর্তা জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মতো বেসামরিক সুরক্ষাব্যবস্থা চালু করাকে সমর্থন করেছেন। যদিও তারা আসিয়ান-নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধানকে দুর্বল হিসেবে দেখে।
মূল কথা হলো- জাতিসঙ্ঘের পশ্চিমা দেশগুলোর দিক থেকে সামরিক নিরাপদ অঞ্চল কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে কোনো সরাসরি সমর্থন নেই। তারা চায় কাক্সিক্ষত সুরক্ষা, স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপদ অবস্থা, একই রকম অবস্থান এবং জবাবদিহিতা সমর্থিত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, সাহায্য অ্যাক্সেস, নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ ও মানবিক সাহায্য। তারা মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে। তারা চাপ দেয় কিন্তু সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলে।
আঞ্চলিক স্বাধীনতা সম্পর্কে পশ্চিম
সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের মতো বৃহত্তর নীতির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের আঞ্চলিক স্বাধীনতার বিষয়ে পশ্চিমাদের সাধারণ অবস্থান বোঝা যেতে পারে। তাদের অবস্থানে নিচের বিষয়গুলো দেখা যায়।
আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোসহ পশ্চিমা সরকারগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সমর্থন করে। এর অর্থ হলো- তারা মিয়ানমারের রাজ্য বা অঞ্চলগুলোর (যেমন- রাখাইন, শান, কাচিন) বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করে না, যদিও তারা প্রায়শই দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন ও অধিকারের পক্ষে কথা বলে।
ফেডারেলিজমের প্রতি সমর্থন : অনেক পশ্চিমা দেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে ফেডারেলিজমের আহ্বান জানিয়েছে। এটিকে দেশের সামগ্রিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে আরো স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দেয়ার একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়।
সামরিক শাসন নিয়ে উদ্বেগ : ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে, পশ্চিমারা মূলত সামরিক জান্তার নিন্দা করে আসছে এবং নির্বাসিত সমান্তরাল বেসামরিক সরকার জাতীয় ঐক্য সরকারকে (এনইউজি) সমর্থন করেছে। মিয়ানমারের আঞ্চলিক ঐক্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি, তারা এই ধারণাকে সমর্থন করে যে, মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ তার জনগণের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত, বিশেষ করে জাতিগত সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং জাতিগত নির্মূল প্রত্যাখ্যান : পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছে, এগুলোকে জাতিগত নির্মূল বা এমনকি গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে। যদিও তারা একটি স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে নয়, তারা বর্তমান সীমান্তের মধ্যে সংখ্যালঘুদের প্রত্যাবাসন, অধিকার ও সুরক্ষার জন্য জোর দেয়।
বাংলাদেশ কী করতে পারে
১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডোরের পক্ষে সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নৈতিক স্বার্থ এবং কৌশলগত স্বার্থÑ উভয়ই রয়েছে। তবে, আঞ্চলিক শক্তির গতিশীলতা ও নিজস্ব সীমিত প্রভাবের কারণে এর বিকল্পগুলো সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ যা করতে পারে এবং করছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে- বহুপক্ষীয় ফোরামের মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ। বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি এবং আসিয়ান-সম্পর্কিত সভায় রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল বা মানবিক করিডোরের জন্য লবিং করতে পারে। একই সাথে জাতিসঙ্ঘ বা আসিয়ান-নেতৃত্বাধীন মানবিক প্রবেশাধিকারের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চাইতে পারে। বাংলাদেশ বারবার জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কাউন্সিলে রোহিঙ্গা সমস্যাটি উত্থাপন করেছে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ প্রত্যাবাসনের আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততা বর্তমানে চাপের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন আলোচনায় সবসময় জড়িত থেকেছে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য এটিকে একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ স্থানীয় প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার জন্য চাপ দিতে পারে, যেখানে মানবিক করিডোর বা প্রবেশাধিকার পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজন হবে।
মিয়ানমারের সামরিক শাসন অসহযোগী এবং রাখাইনে নিরাপত্তাহীনতার কারণে অতীতে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ চীনের সাথে তার সম্পর্ককে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে। ভারতের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের টানাপড়েনের সম্পর্ক থাকলেও চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। মানবিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার বিষয়েও ঢাকা জোর দিতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় করতে পারে। নির্দিষ্ট মানবিক চ্যানেল খোলার সাথে সংযুক্ত পর্যায়ক্রমে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব করা যেতে পারে। সে সাথে অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি মিয়ানমারকে জবাবদিহি করার জন্য আইসিজের গণহত্যা মামলা, আইসিসির তদন্তের আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়া সমর্থন করা যেতে পারে। এটি রাখাইনের অভ্যন্তরে নিরাপদ মানবিক পরিস্থিতি তৈরির জন্য নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করে।
সার কথা হলো- বাংলাদেশ নিরাপদ অঞ্চলের জন্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে বিশেষত দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন আলোচনা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের অনুমতি দিতে জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, আসিয়ানের চাপ তৈরি করতে পারে। চীনকে সম্পৃক্ত করে কৌশলগত খেলোয়াড়দের উচ্চ পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করতে পারে। জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে মানবিক প্রত্যাবাসন কৌশলের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে।
[email protected]