‘সমকামী’ সাজ্জাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?

সাজ্জাদ হোসেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক বিভাগীয় শহরের সদ্য কলেজ পাশ করা এক সদা হাস্যময়ী সমকামী তরুণ, যে কিনা কিছুদিন আগে পরিবারের চাপে বিয়ে করে বাসর রাতেই আত্মহত্যা করেছে। শুধু সাজ্জাদ নয়, এরকম সমকামী অনেক ছেলে-মেয়ে পরিবার, সমকামী হওয়া সত্ত্বেও সমাজ আর রাষ্ট্রের চাপে বিপরীত লিঙ্গের ছেলে মেয়েকে বিবাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করে নিজেদের মুক্ত করছে, আর যারা পারছে না তারা শত কষ্টে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিপরীত লিঙ্গের ছেলে মেয়ের সাথে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে।

পরিবারের নেতিবাচক মনোভাবের জন্য সাজ্জাদ প্রকাশ করতে পারেনি তার যৌন প্রবৃত্তির কথা। পরিবারের সদস্যদের বুঝাতে পারেনি যে সে একজন সমকামী। তার যে বিপরীত লিঙ্গ অর্থাৎ মেয়েদের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই, সে যে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, সে যে পুরুষকে ভালবাসে, একজন পুরুষকে নিয়ে ঘরসংসার করার স্বপ্ন দেখে তা তার পরিবারের সদস্যদের কাছে খোলাসা করে বলতে পারেনি শুধুমাত্র সমকামীতা সম্পর্কে তার পরিবারের নেতিবাচক মনোভাবের কারনে।

যদিও তার পরিবার বুঝতে পেরেছিল সাজ্জাদ একজন সমকামী ব্যক্তি, তবুও তারা তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বরং সমাজের আর দশজন মানুষের মত তারা চেষ্টা করেছিল সাজ্জাদকে একজন নারীর সাথে বিয়ে দিতে। তারা তার বিয়ে ঠিকও করেছিল এক মেয়ের সাথে। যদিও সাজ্জাদ বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের চাপে তাকে বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য হতে হয়েছিল। সাজ্জাদ পারেনি তার পুরুষবেশী দেহে লালিত নারী মনে অন্য একজন নারীকে জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করতে। তাইতো পরিণতিতে তাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে।

এখন প্রশ্ন সাজ্জাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? তার পরিবার, এই সমাজ নাকি প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা?

ব্রিটিশদের প্রণীত আইনে বাংলাদেশে সমকামীতার জন্য সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন ও সর্বনিম্ন ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থ দণ্ডের বিধান রাখা হলেও ব্রিটেনে সমকামীতা কোনো অপরাধ নয়। আর আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাত পাত ধর্ম বর্ণ পেশা লিঙ্গভেদে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করা যেখানে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব, সেখানে যৌনপ্রবৃত্তিগত সংখ্যালঘু সমকামীদের অধিকার প্রদান তো দূরে থাক তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পর্যন্ত নেই।
কোনো নাগরিক যেন সমকামী হিসাবে নিজেদের প্রকাশ করতে না পারে সেজন্য সমকামিতাকে অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছে এই রাষ্ট্রযন্ত্র। আর প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা? সেতো সমকামীতাকে ধর্ষণের চেয়েও জঘন্য বলে মনে করে। একজন ধর্ষক হয়ত ধর্ষণ করে পার পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুজন পুরুষ বা নারী পরস্পরকে ভালবেসে পার পেয়ে যাবে এ সমাজ তা কখনো মেনে নিতে পারে না। অথচ চাইলেই এ সমাজ এ রাষ্ট্র সাজ্জাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করতে পারত। কিন্তু তা না করে এ সমাজ এ রাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার প্রচলিত আইন দিয়ে সাজ্জাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

তাইতো সাজ্জাদের পরিবার যখন তাকে জোরকরে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল তখন সে পারেনি সমাজের কাছে আশ্রয় চাইতে। এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও সহযোগিতা চাইতে পারেনি। কারণ এ রাষ্ট্র সমলিঙ্গের ভালবাসা আর সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। নাগরিক হিসেবে সাজ্জাদ যখন রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে তার অধিকার চাইতে ভয় পায়, যখন তার অধিকারের কথা বলতে ভয় পায়, যখন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের নিকট যেতে পারে না তখন তার আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকে না। আর যে সমাজ যে রাষ্ট্র একজন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারে না সেখানে আইনের শাসন কোন পর্যায়ে অবস্থান করে তা সহজে অনুমানীয়।

সাজ্জাদের মৃত্যুতে হয়তোবা তা পরিবার হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। হয়তোবা তার পরিবার ভাবছে সাজ্জাদের মৃত্যুতে অন্ততপক্ষে সমাজের কাছে তাদের মাথা নিচু হওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে। এ সমাজ হয়তো ভাবছে যে অন্ততপক্ষে একজন পাপীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তার নোংরামী থেকে এ সমাজ মুক্তি পেয়েছে। এ রাষ্ট্র হয়ত ভাবছে শাস্তি প্রদানের আগেই সাজ্জাদ আত্মহত্যা করে একজন অপরাধীর সংখ্যা কমেছে। আসলে সাজ্জাদের আত্মহত্যায় মানবতা ভুলণ্ঠিত হয়েছে, আইনের শাসন ভুলণ্ঠিত হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ, জাত, পাত প্রভৃতির সংমিশ্রণে বৈচিত্রময় মানুষের একত্রে বিচরণই সৌন্দর্য।
তাইতো নারী ও পুরুষের মাঝে সমকামীদের স্বাভাবিক মানুষের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সাথে নিয়ে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায় আমাদের সবার ব্রত হওয়া উচিত। অন্যথায় সাজ্জাদের মৃত্যু কখনো আমাদের ক্ষমা করবে না, সর্বদা আমাদের পিছু তাড়া করে কুরে কুরে খাবে। আসুন সবাই মিলে সমকামীদের অপরাধীর চোখে না দেখে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত তাদের সাথে নিয়ে সবার জন্য বসবাসযোগ্য একটি মানবিক পৃথিবী গঠনে অগ্রসর হই।

লেখক: মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও ব্লগার; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; মোবাইল: ০১৭২০৩০৮০৮০, ইমেইল: saikotbihr@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews