ছয় মাস আগেও অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত তারল্যের কষ্টে ভুগেছে ব্যাংকিং খাত। প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্যের বোঝা কমাতে ডজনখানেক ব্যাংক আমানত নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল ওই সময়। তিন মাস আগেও আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করতে তৎপর ছিলেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। কিন্তু নিজেরা আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে হঠাৎ ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের পদধ্বনি দেখছেন এবার। যদিও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতির কোনও উন্নতি দেখছেন না উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে এমডিরা উদ্বিগ্ন হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ফজলে কবিরকে চিঠিও দিয়েছেন।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ৮৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য ৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি আমরা দেখছি না। এমন অবস্থায় তারল্য সংকট হওয়ার কথা নয়। যদিও ব্যাংক খাতে এখন বেপরোয়াভাবে ঋণ বিতরণ বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘গত ছয়টি নির্বাচনের বছর ও এর কাছাকাছি বছরগুলোয় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কমে যায়। অথচ হঠাৎ করে এখন ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়ে চলছে।’ নির্বাচনের বছরে এই ঋণের টাকা প্রকৃতপক্ষে কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৭ অনুযায়ী, গত ছয় বছরে সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর পরও ব্যক্তি খাত বা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২-২৩ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ। অক্টোবরে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ৬৩, সেপ্টেম্বরে ছিল ১৯ দশমিক ৪০, আগস্টে ছিল ১৯ দশমিক ৮৪ এবং জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সম্প্রতি ঋণ বিতরণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে এখন খুব বেশি উদ্বৃত্ত তারল্যে নেই। অনেকে নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে। এমন অবস্থায়  অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) কমিয়ে আনা হলে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমানতের প্রয়োজন হবে।’

এদিকে আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে ব্যাংক খাতের ঋণ ও আমানতের অনুপাত কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন সিদ্ধান্ত কার্যকর না করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)। গভর্নরের কাছে লেখা চিঠিতে এবিবি নেতারা বলেছেন, আমরা উদ্বিগ্ন যে, নিকট ভবিষ্যতে এডিআর কমিয়ে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশের আশপাশে নামিয়ে আনা হবে। তা হলে এই খাতে বাড়তি ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমানতের প্রয়োজন হবে।

দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়নি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যই এর প্রমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ৮৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তা ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরের জুন শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে ভালো না থাকায় ব্যাংকগুলো এই তারল্যের বড় অংশই স্বল্প সুদের বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে রেখেছে। ব্যাংকগুলো আড়াই শতাংশেরও কম সুদে ৭ দিন, ১৪ দিন ও ৩০ দিন মেয়াদে বিনিয়োগ করেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণ ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। তবে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকেরই ঋণ ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে গত ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগ্রাসী বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশ দেন গভর্নর।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বাড়ছে— এটা তারই প্রমাণ।’ ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকার কারণেই ঋণে সুদহার বাড়ছে বলে মনে করছেন তিনি।

সিদ্দিকুর রহমানের মতো বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীও মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ব্যাংক ঋণ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের বিষয়ে নিশ্চয়তা না পাওয়ার কারণে উদ্যেক্তারা এই খাতে এগিয়ে আসতে পারছেন না।’ তবে ব্যাংকের তারল্য কমে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, আমানতকারীদের আকর্ষণ করতে নতুন বছরে বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের সুদ হার বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন সুদ হার অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে ৩ মাস মেয়াদি আমানতে সুদ হার নির্ধারণ করেছে ৫ শতাংশ, ৬ মাস মেয়াদি আমানতে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর বা এর বেশি মেয়াদি আমানতে সাড়ে ৫ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও তিন মাস মেয়াদি আমানতে সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে প্রায় এক শতাংশ বাড়িয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ৬ মাস মেয়াদের আমানতে তারা ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং এক বছর মেয়াদিতে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছে সুদের হার। স্বল্প মেয়াদিতে আমানতে ৩ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়ী আমানতে সাড়ে ৩ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ সুদ দিচ্ছে ব্যাংকটি।

আরও পড়ুন:
আলুর বাজার খুঁজছে বাংলাদেশ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews