ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র। বর্তমানে যেখানে তারা রাষ্ট্র পত্তন করেছে, সেখানেই ছিল তাদের আদি নিবাস। তাদের নেতা সাইমন বার কোখবা ১৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বারবার রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদ ক্যাসিয়াস ডাইওর বর্ণনা অনুসারে, ওই বিদ্রোহে পাঁচ লাখ আশি হাজার ইহুদি নিহত হয়েছিল। অবশিষ্ট ইহুদিরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করে চলে যায়। সেই থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আর কখনও আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। সাইমন বার কোখবার পর ১৯৪৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত আর কখনও তাৎপর্যপূর্ণভাবে কোনও রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করতে পারেনি। ইহুদিরা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
জার্মানিতে বহু ইহুদি বসবাস করতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। তখন বহু ইহুদি পালিয়ে আমেরিকা এবং রাশিয়ার চলে যায়। এখন বিশ্বে ইহুদি সংখ্যা ১ কোটি ৪৫ লাখ। ধর্মান্তরিত হয়ে ইহুদি হওয়া যায় না, জন্মসূত্রে ইহুদি হতে হয়। ইহুদিরা মূলত নিজেদের হজরত মুসার (আ.) উম্মত হিসেবে মনে করে। ইহুদিরা জীবনযাপন করেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বারবার বিতাড়িত হয়েছে। ইহুদিরা ধনাঢ্য জাতি, কিন্তু কখনও বিশ্বের কোথাও এক খণ্ড জমি কিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেনি। যখনই তারা প্যালেস্টাইন সফর করার সুযোগ পেয়েছে, তখনই তারা যিহোবার মন্দিরে ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পড়ে থাকা ভাঙা দেয়াল ধরে ঈশ্বরের কাছে কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করেছে—‘হে ঈশ্বর আমাদের দেশ ফিরিয়ে দাও।’
১৯৪৮ সালে তাদের প্রতীক্ষার অবসান হয় এবং প্যালেস্টাইনে তারা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সংক্ষেপে ইহুদি জাতির এই ইতিহাস পাঠকদের জন্য বর্ণনা করছি ইসরায়েল সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টির জন্য। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার ইসরায়েলের জাতীয় নির্বাচন। এক বছরে দুইবার হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। গত ৯ এপ্রিল ইসরায়েলি পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি ৩৫ আসন পেয়েছিল। ইসরায়েলি পার্লামেন্টে মোট সদস্যসংখ্যা ১২০ জন। ইসরায়েলে অনেক ছোট ছোট দল রয়েছে। তাদের সমর্থন নিয়ে লিকুদ পার্টি গত চারবার নির্বাচনের পর সরকার গঠন করেছে। দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রিত্বকাল ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা-পিতা (founding father) ডেভিড বেন গুরিওনকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনের পর আগের মতো ছোট পার্টিগুলো নেতানিয়াহুর সমর্থনে এগিয়ে আসেননি, তাই সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। ২১তম পার্লামেন্ট নির্বাচন সে কারণে পুনরায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত ৯ এপ্রিলের নির্বাচনের মতো এবারও লিকুদ পার্টি এবং ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ কোয়ালিশন নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট একটি বাম জোট, যার নেতৃত্বে রয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল—বেনি গ্যান্টজ। এই জোটের আরেক নেতা ইয়ায়ার ল্যাপিড, যিনি টিভি ব্যক্তিত্ব থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছেন। নেতানিয়াহুর স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির কথা বহুলপ্রচারিত। তার বিরোধীরা বলছেন, তিনি ইসরায়েলকে বিভক্ত ও সস্তা করেছেন। জেনারেল বেনি গ্যান্টজ তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন এবং কঠোর পরিশ্রম করছেন। জেনারেল গ্যান্টজ বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
গত নির্বাচনে ৩৫ আসন পেয়েছিল ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট জোটও। নির্বাচনে জিতে আসার জন্য নেতানিয়াহুর স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কথা জেনেও ইসরায়েলিরা বারবার তাকে ভোট দিয়েছে কেন? কারণ তার দৃঢ়চেতা মনোভাব। মধ্যপ্রাচ্যের ৩০ কোটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ইসরায়েলি রাষ্ট্রের অবস্থান। কোনও দুর্বল নেতৃত্বের পক্ষে অনুরূপ অবস্থানের একটা রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ইসরায়েল একটি শক্তিশালী দেশ। এর অর্জনগুলোও লক্ষণীয়। তবে ইহুদিদের ও ইসরায়েলি রাষ্ট্রের ইতিহাস বিবেচনা করে এটির নিরাপত্তাহীনতার ধারাও বোধগম্য। নেতানিয়াহু সেই ভয় নিয়েই খেলেন। তার প্রচার ইরান, সিরিয়া এবং লেবাননে ইসরায়েলের শত্রুদের মজবুত করেছে।
নির্বাচনি প্রচারে নেতানিয়াহু এই বার্তা দিচ্ছেন যে প্রতিবেশী ইসরায়েলের শত্রু রাষ্ট্রগুলো থেকে তিনিই একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি ইসরায়েলিদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। নির্বাচনি পোস্টারে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ছবি দিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। সেখানেও দুই দেশের অনন্য অংশীদারিত্বের বার্তা দিয়ে বলতে চাচ্ছেন এই অংশীদারিত্ব কেবলমাত্র নেতানিয়াহুই বজায় রাখতে পারবেন।
ইসরায়েলের মূল শক্তির আঁধার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ইহুদিদের হাতে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দা কবলিত। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্বে মন্দার পদধ্বনি। মন্দা কবলিত বিশ্বের একটি রাষ্ট্র ২৪ ঘণ্টা যুদ্ধাবস্থা নিয়ে অগ্রসর হওয়া বা টিকে থাকা মুশকিল। নেতানিয়াহু কিন্তু কোনও অবস্থায় ফিলিস্তিনি বা আশপাশে রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কোনও সমঝোতায় উপস্থিত হতে সম্পূর্ণ নারাজ। আমেরিকার অনেক বিশেষজ্ঞ ইহুদি এটাকে নেতানিয়াহুর বাড়াবাড়ি মনে করেন। যেমন আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ইসরায়েল মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে না এলে ২০৫০ সালের মধ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। হেনরি কিসিঞ্জারও ইহুদি পরিবারের সন্তান।
লিকুদ রক্ষণশীল দল। বহু বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। তারপরও সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর অবস্থান আগের থেকে দুর্বল হয়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট কোয়ালিশন নেতা জেনারেল বেনি গ্যান্টজও শক্ত মানুষ। বহু রাজনৈতিক দল থাকার কারণে ঘন ঘন নির্বাচন হয় সত্য, কিন্তু এবার যে পরিস্থিতিতে পুনরায় নির্বাচন হচ্ছে তা গত ৭০ বছরের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ইসরায়েল দখল করেছিল। জর্দান তার জায়গার দাবি পরিত্যাগ করে। তবে জর্দানের বাদশা বলেছেন পশ্চিম তীরের অধিকার তিনি ফিলিস্তিনিদের বরাবরে ত্যাগ করেছেন। বহু ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীরে বসতি গড়ে তুলেছেন। এবারের নির্বাচনি প্রচারে নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি জর্দান উপত্যকায় নিজের দখলে নিয়ে আসবেন। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশর, সিরিয়া আর যুদ্ধ করে না। সিরিয়া তার গৃহযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, আর মিশর দীর্ঘ সময়ব্যাপী নির্বাক। অবশ্য তারা বহুদিন যুদ্ধ করেছে, এখন ক্লান্ত।
এখন ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হচ্ছে গাজার হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। আগে কথায় কথায় ইসরায়েলি বাহিনী লেবাননের সীমান্ত অতিক্রম করতো, কিন্তু হিজবুল্লার উত্থানের পর এখন আর করে না। হিজবুল্লাহ দক্ষ সুনিপুণ গেরিলা বাহিনী। লেবানন সরকার তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে এবং চারজন হিজবুল্লাহ নেতাকে তাদের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী করেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর নেতানিয়াহু এক নির্বাচনি জনসভায় বক্তৃতা করার সময় যখন সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে ওঠে, তখন তিনি দৌড়ে মঞ্চ থেকে পালিয়ে যান। মঞ্চে সেলিং করেছিল হামাস। হামাস আর হিজবুল্লাহ ভূমিপুত্র। সুতরাং তাদের আক্রমণ দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।
ইসরায়েলি ভোটারদের মাঝে ২০ শতাংশ হচ্ছে ফিলিস্তিনি আরব। তাদের নেতা আহমদ তিবি একজন ইসরায়েলি আরব মুসলিম রাজনীতিবিদ। ইসরায়েলি আরবদের কাছে তিনি এক বড়মাপের নেতা। তার দলের নাম তা’ল। তিনি ইসরায়েলে আরব মুভমেন্ট ফর চেঞ্জের নেতা। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছেন। তিনি ইসরায়েল পার্লামেন্টের সদস্য এবং আরব-ইসরায়েলি জোটের পক্ষ থেকে পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকার। লিকুদ পার্টির নেতানিয়াহু এবং ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট কোয়ালিশনের জেনারেল বেনি গ্যান্টজ তাকে সমীহ করে চলে। মুসলিমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় তবে নেতানিয়াহুর অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে। ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম দল হচ্ছে জয়েন্ট লিস্ট, তার নেতা বলেছেন ব্লু অ্যান্ড হোয়াইটের সঙ্গে তিনি কোয়ালিশন করতে আপত্তি করবেন না।
নেতানিয়াহু ইরান এবং তুরস্কের প্রতি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং গাজায় ও লেবাননে বিমান আক্রমণ করছেন। মুসলমানকে হত্যা করে ভোট চাওয়া এর আগে শিমন পেরেজ করেছিলেন, তবে তিনি সফল হননি। এবার নেতানিয়াহুও হয়তো সফল হবেন না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com