২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ফাইভজি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ওঠে হুয়াওয়ে। ছবি: রয়টার্স
২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ফাইভজি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ওঠে হুয়াওয়ে। ছবি: রয়টার্স
বছরের পর বছর ধরে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে বারবার বাধার মুখে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ে। এর পরও লোকচক্ষুর আড়ালে চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই’সহ প্রযুক্তি দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীদের একটি হয়ে উঠেছে দেশটির এই টেলিকম জায়ান্ট।
শেনঝেনভিত্তিক এ কোম্পানিটি কেবল মার্কিন চিপ নির্মাতা জায়ান্ট এনভিডিয়ার বিকল্প হিসেবেই সামনে আসেনি, বরং শিল্পক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আয়ের দিক থেকেও এগিয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ডিজিএ-অ্যালব্রাইট স্টোনব্রিজ গ্রুপ’-এর চীনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পল ট্রিওলো বলেছেন, “কোম্পানির ওপর বাইরের থেকে আসা নানা ধরনের চাপের কারণে গত এক দশকে নিজেদের মূল ব্যবসার দিক বদলাতে ও পরিসর বাড়াতে বাধ্য হয়েছে হুয়াওয়ে।”
এ পরিসব বাড়ানোর ফলে বর্তমানে স্মার্ট গাড়ি ও অপারেটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে এআই বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিতেও জড়িয়ে পড়েছে চীনা কোম্পানিটি। যেমন– উন্নত সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ উৎপাদন, ডেটা সেন্টার ও লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের মতো প্রযুক্তিতে কাজ করছে তারা।
ট্রিওলো বলেছেন, “যতগুলো জটিল ও কঠিন খাতে হুয়াওয়ে নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়েছে ততগুলো খাতে আর কোনো প্রযুক্তি কোম্পানি এমন সফলভাবে কাজ করতে পারেনি।”
এ বছর এনভিডিয়া’র সিইও জেনসেন হুয়াং বলেছেন, “বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর একটি হুয়াওয়ে।” তিনি সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি এভাবেই চিপ রপ্তানিতে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যায় তবে দেশটিতে এনভিডিয়ার জায়গা নিতে পারে হুয়াওয়ে।
গত সপ্তাহে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য চার ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এরই মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এনভিডিয়া। জেনারেটিভ এআই মডেল ও অ্যাপ্লিকেশন প্রশিক্ষণের জন্য কোম্পানিটির উন্নতমানের চিপ ও ‘সিইউডিএ’ নামের কম্পিউটিং সিস্টেম এখনও শিল্পক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিএনবিসি লিখেছে, তবে এ ব্যবধান এখন কমে আসছে। কারণ, হুয়াওয়ে কেবল সব ধরনের খাতে কাজই করছে না, বরং খুব ভালোভাবেই সেটি করছে। এনভিডিয়ার মতো মার্কিন এআই জায়ান্টদের চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হলেও হুয়াওয়ের ইতিহাস বলছে, তাদেরকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত হবে না।
টেলিফোন সুইচ বিক্রি থেকে চীনের জাতীয় গর্ব এখন হুয়াওয়ে
বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে দুই লাখেরও বেশি মানুষ চাকরি করছে হুয়াওয়ে’তে। তবে কোম্পানিটির শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। ১৯৮৭ সালে চীনের শেনঝেন শহরের এক ছোট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে এ কোম্পানির যাত্রা শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা রেন ঝেংফেই, যা ওই সময় ছিল ছোট এক টেলিফোন সুইচ বিক্রির ব্যবসা।
টেলিকম খাতে বড় হওয়ার দিকে প্রথমে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো স্বল্পোন্নত বিভিন্ন বাজারকে লক্ষ্য করে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছে হুয়াওয়ে। পরে ধীরে ধীরে ইউরোপের মতো জায়গাতেও ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে কোম্পানিটির।
২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ফাইভজি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ওঠে হুয়াওয়ে। ওই সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বড় স্মার্টফোন নির্মাতায় পরিণত হয় চীনা কোম্পানিটি। একইসঙ্গে তাদের চিপ ডিজাইন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘হাইসিলিকন’-এর মাধ্যমে স্মার্টফোন চিপও ডিজাইন করছিল হুয়াওয়ে।
তবে হুয়াওয়ে যতই সফল হয়েছে ততই চীনের বাইরের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হয়েছে কোম্পানিটিকে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে, হুয়াওয়ের প্রযুক্তি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে চীনা কোম্পানিটি।
২০১৯ সালে হুয়াওয়ের ব্যবসা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাণিজ্যিক কালো তালিকা বা ব্ল্যাকলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে কোম্পানিটিকে। ফলে হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্রের সব কোম্পানি।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করলে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে হুয়াওয়ের সবচেয়ে বড় ব্যবসা ভোক্তা পণ্য বিভাগ, যা একসময় ছিল কোম্পানির সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস। আগের বছরের চেয়ে ২০২১ সালে এ বিভাগের আয় অর্ধের্কে, প্রায় তিন হাজার চারশ কোটি ডলারে নেমে আসে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরও এআই চিপ প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিসহ এগিয়ে যেতে থাকে হুয়াওয়ে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণে তাইওয়ানের চিপ নির্মাতা কোম্পানি ‘টিএসএমসি’ থেকে চিপ পাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় হুয়াওয়ের। তবে এর এক বছর আগেই ২০২৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের ‘অ্যাসেন্ড ৯১০’ নামের এআই চিপ এনেছিল তারা।
সিএনবিসি লিখেছে, এই চিপ ছিল কোম্পানিটির এমন এক পরিকল্পনার অংশ, যাতে সব ধরনের এআই ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ সমাধান দিতে ও বড় রকমের এক এআই কম্পিউটিং শক্তি সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারে হুয়াওয়ে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়েকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু করেছে তা এই কোম্পানিকে যেন এক প্রকার ‘শহীদের’ মতো প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছে চীনে। এর আগে, ২০১৮ সালে হুয়াওয়ের সিএফও ও প্রতিষ্ঠাতা রেন ঝেংফেইয়ের মেয়ে মেং ওয়ানঝো কানাডায় ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে চীনে ব্যাপক মনোযোগ পেতে শুরু করে হুয়াওয়ে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার প্রযুক্তি যুদ্ধ বাড়তে থাকায় ও চীনের ওপর উন্নত চিপ প্রযুক্তির নিষেধাজ্ঞা আসায় দেশটির সরকারও এআই প্রতিযোগিতায় দেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ‘উপযোগী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বেছে নিয়েছে হুয়াওয়েকে। ফলে এআই পরিকল্পনায় আরও উৎসাহ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাচ্ছে কোম্পানিটি।
ট্রিওলো বলেছেন, “মার্কিন এসব রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা হুয়াওয়েকে চীনা সরকারের আরও কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছে, যা সবসময় এড়াতে চেয়েছিলেন হুয়াওয়ের সিইও রেন ঝেংফেই।” এভাবে হুয়াওয়ের এআই হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার উন্নয়নের জন্য এক প্রকার ‘স্টেরয়েড’ বা জোরালো উত্তেজক হিসেবে কাজ করেছে এসব নিষেধাজ্ঞা।
প্রত্যাবর্তন বা হুয়াওয়ের ফিরে আসা
এক বছর ধরে স্মার্টফোন বিক্রি কমে যাওয়ার পর ২০২৩ সালে হুয়াওয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। ওই সময় হুয়াওয়ে এমন স্মার্টফোন বাজারে আনে যার ভেতরে তারা চীনে তৈরি উন্নতমানের চিপ ব্যবহার করেছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
হুয়াওয়ের ফাইভজি চিপ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মার্কিন কর্মকর্তাকে বিস্মিত করেছিল। কারণ তারা ভাবতেই পারেননি, টিএসএমসি’র সাহায্য ছাড়াই হুয়াওয়ে এত দ্রুত আধুনিক চিপ বানাতে পারবে। ওই সময় অনেকের ধারণা ছিল, এই চিপ বানাতে চীনা চিপ নির্মাতা কোম্পানি ‘এসএমআইসি’র সঙ্গে কাজ করছিল হুয়াওয়ে, যেটিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, হুয়াওয়ে ও এসএমআইসি’র এখনও খুব বেশি চিপ তৈরির সক্ষমতা নেই। তবুও হুয়াওয়ে প্রমাণ করেছে, আবার উন্নত চিপ তৈরির দৌড়ে ফিরে এসেছে তারা।
এ সময়েই হুয়াওয়ের নতুন এআই প্রসেসর চিপ ‘অ্যাসেন্ড ৯১০বি’ চিপ নিয়ে বিভিন্ন খবর প্রকাশ পেতে শুরু করে। এনভিডিয়ার সবচেয়ে উন্নত চিপের ওপর আরোপিত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে তৈরি হওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল হুয়াওয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, এ চিপের পরবর্তী সংস্করণ ‘অ্যাসেন্ড ৯১০সি’ চিপের ব্যাপক উৎপাদন এরইমধ্যে শুরু করেছে কোম্পানিটি।
‘টেকমোট কনসাল্টিং’-এর ম্যানেজিং পার্টনার জেফ্রি টোসন বলেছেন, এনভিডিয়ার শূন্যস্থান পূরণের জন্য ‘কম সক্ষমতার বিভিন্ন চিপকে একত্র করে উচ্চসক্ষমতার জিপিইউ-এর মতো কাজ করতে বড় অগ্রগতি করছে হুয়াওয়ে।”
এপ্রিলে ‘এআই ক্লাউডম্যাট্রিক্স ৩৮৪’ নামের এক সিস্টেম উন্মোচন করেছে হুয়াওয়ে, যেখানে একটি ডেটা সেন্টারে ৩৮৪টি ‘অ্যাসেন্ড ৯১০সি’ চিপ একসঙ্গে কাজ করে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে এনভিডিয়ার ‘জিবি২০০ এনভিএল৭২’ সিস্টেমকে ছাড়িয়ে যেতে পারে হুয়াওয়ের এই ক্লাউডম্যাট্রিক্স।
গত মাসে ক্লাউডম্যাট্রিক্স সম্পর্কে ফরেস্টার বিশ্লেষকরা এক প্রতিবেদনে বলেছেন, হুয়াওয়ে কেবল এনভিডিয়ার পিছু নেওয়ার চেষ্টাই করছে না, বরং ‘এআই প্রযুক্তির ভিত্তি বা কাঠামোর কাজের ধরনটাই বদলে দিচ্ছে’।
এদিকে, হুয়াওয়ে তাদের নিজস্ব ‘সিএএনএন’ সফটওয়্যার সিস্টেমও তৈরি করেছে, যা এনভিডিয়ার ‘সিইউডিএ’ সফটওয়্যারের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে।
ফরেস্টারের প্রতিবেদন বলছে, “এআই দৌড়ে জিততে চাইলে কেবল দ্রুত চিপ বানালেই হবে না, ডেভেলপারদের জন্য দরকার এমন সফটওয়্যার টুলস যেগুলো দিয়ে বড় এআই মডেল তৈরি ও চালানো যায়।”
হুয়াওয়ের টুলস এখনও ডেভেলপারদের পরিচিত বিভিন্ন সিস্টেমের সঙ্গে পুরোপুরি মানিয়ে নেয়নি। ফলে এনভিডিয়া থেকে সহজে সরে যাওয়া ডেভেলপারদের জন্য এখনও কঠিন।