‘করোনা নামে কী যে একটা এলো পৃথিবীতে, বাড়িতে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছি।’ কিছু দিন আগে কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে কথাগুলো বলেছিলেন কবরী। নির্মম ভাগ্যলিপি, এই করোনাতে মারা গেলেন দেশের কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা কবরীর। তার মৃত্যুতে শুধু সাবিনা ইয়াসমিনই নন, বিনোদন ও অন্যান্য পেশার প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, এটি শুধু কবরীর মৃত্যু নয়, একটি নক্ষত্রের পতন হয়েছে।

এর এক দিন আগে আমরা করোনায় হারিয়েছি লোক বিশেষজ্ঞ এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানকে। তারও এক দিন আগে করোনায় মারা যান সুপ্রিম কোর্ট বারের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। এভাবে প্রতিদিনই আসছে করোনায় মৃত্যুর খবর।

করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গত বৃহস্পতিবার রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে তার ফুসফুসের সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে সিটিস্ক্যান রিপোর্ট ভালো এসেছে। তার ফুসফুসের সংক্রমণ অতি সামান্য। চিকিৎসকরা বেগম জিয়াকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ারই পরামর্শ দিয়েছেন। শনিবার তার চিকিৎসক জানিয়েছেন, বেগম জিয়ার কিছুটা জ্বর আছে। তবে শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। কৃত্রিম অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। বেগম জিয়ার এ খবরে দেশের মানুষ আশান্বিত হয়েছেন। এর আগে মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও জনগণের প্রয়োজনে মহান আল্লাহ বেগম খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে দিন, এই হোক আমাদের মুনাজাত।

বাংলাদেশে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। গত তিন দিন অর্থাৎ শুক্র, শনি ও রোববার ১০০ জনের বেশি করে মানুষ মারা গেছেন করোনায়। করোনায় প্রতিদিনই মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। গত বছরের এপ্রিলে সর্বোচ্চ দিনে মৃত্যুর রেকর্ড ছিল ৪৬ জন। সেটা ছাড়িয়ে চলতি এপ্রিলে ৫০, ৬০, ৭০, ৮০, ৯০ এবং সর্বশেষ ১০০ ছাড়িয়ে গেছে দৈনিক মৃত্যু। অবশ্য শুক্র, শনি ও রোববার এ তিন দিন ধরে সংক্রমণ কমে আসছে- এটিই আশার কথা। করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভেরিয়েন্টটিই এখন আক্রমণ চালাচ্ছে। উদ্বেগজনক খবর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তারা জানিয়েছেন, শিশুরাও এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। বমি, খিঁচুনি ও পেট খারাপ হলেই শিশুটি করোনায় আক্রান্ত বোঝা যায়। ঢাকায় করোনা আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য দু’টি হাসপাতালে বিশেষ বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনার মৃত্যু সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে গত ১৫ এপ্রিল। রোববার পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যু বাংলাদেশে ১০ হাজার ৩৮৫ জন। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় মৃত্যুতে কিছু পরিবর্তন ধরা পড়েছে রোগতত্ত্ববিদদের কাছে। কম বয়সী ও নারীদের মৃত্যু তুলনামূলক বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। করোনায় বাংলাদেশে ১৩৯ চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। পুলিশ মারা গেছেন ৯০ জন। প্রশাসনের ২৫ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। আর করোনায় সাংবাদিক মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৪ জন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় দেশে লকডাউন চলছে। তবে লকডাউনের কারণে শ্রমজীবী খেটেখাওয়া মানুষ মহাবিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে যারা দিন এনে দিন খান তাদের কষ্টের সীমা নেই। সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে শুধু শহরে কাজ হারিয়েছেন ১০ লাখ শ্রমিক।

১৩ মাস ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে এ মহামারী। করোনা মহামারীতে ইতোমধ্যে পৃথিবীর ৩০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ কোটিরও বেশি মানুষ। জনস হপকিংস এ তথ্য জানানোর আগের দিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবাণী দেয় যে, মহামারী সর্বোচ্চ মাত্রার সংক্রমণের দিকে এগোচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই সংখ্যা এখন ছয় লাখ ছুঁই ছুঁই। তার পর ব্রাজিল ও ভারতের। এই তিন দেশে ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। গত সপ্তাহে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ১২ হাজার করে মানুষ মারা গেছে। এ ছাড়া অনেকেই করোনা-পরবর্তী নানা জটিলতায় ভুগছেন। কারো মানসিক যন্ত্রণা, কারো স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ বিভিন্ন রোগ।

টিকা নিয়ে দুঃসংবাদ
করোনা সংক্রমণের যখন এ ভয়াবহ অবস্থা, ঠিক তখনই বাংলাদেশে করোনার টিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টিকাদান কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা আসার কথা থাকলেও গত দুই মাসে টিকার কোনো চালান আসেনি। কবে নাগাদ টিকার চালান আসবে কেউ তা বলতে পারছে না।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরউল্লাহ চৌধুরী টিকা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল থাকার কারণেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। শুরুতেই আমরা সরকারকে বলেছিলাম, টিকার ব্যাপারে একটি মাত্র সোর্সের ওপরই নির্ভরশীল হবেন না। বিকল্প সোর্সও থাকতে হবে। চীন তাদের সিনোভ্যাক টিকার ট্রায়াল বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল আইসিডিডিআরবির মাধ্যমে। আমরা বলেছিলাম, এক ঘণ্টার মধ্যে অনুমতি দিয়ে দিন। কিন্তু সরকার তা করেনি। আজ সেরাম ইনস্টিটিউট যখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি সরবরাহ করতে পারছে না, তখন সরকার তথা স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, রাশিয়া ও চীনসহ বিকল্প সব জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশিয়া তাদের টিকার ট্রায়াল করার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করেছিল। আমরা পারতাম। কিন্তু সরকার গণস্বাস্থ্যকে পছন্দ করে না। তাই রাশিয়াকে আমরা বলেছি সম্ভব নয়। টিকার বিষয় দলীয় দৃষ্টিতে দেখা ঠিক হয়নি।

বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ লোককে টিকা দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে যে টিকা এসেছে এবং যে সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ১০ লাখ ডোজ ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক খুরশীদ আলম বলেছেন, রাশিয়া ও চীনের সাথে টিকার ব্যাপারে প্রাথমিক যোগাযোগ হয়েছে। তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

এ দিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কোভ্যাক্স সহযোগিতায় যে এক কোটি ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল তাও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা আনার চুক্তি হয়েছিল বেক্সিমকোর সাথে। টিকার অনিশ্চয়তা নিয়ে বেক্সিমকো এখন কিছুই বলছে না। টিকা কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যের ডিজি এরই মধ্যে বলেছেন, পুরো ডোজ না দিলে টিকা কাজ করবে না। যারা প্রথম ডোজ নিয়েছে তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া নিশ্চিত করতে নতুনদের প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি। টিকার এ অনিশ্চয়তা করোনার মারমুখী আক্রমণের সময় নতুন দুঃসংবাদই বয়ে আনছে।

ভাইরাস মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞ উপদেশ
তবে করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে ধৈর্য হারালে চলবে না। সাহসের সাথে এই মহামারী মোকাবেলা তথা মহামারীকে জয় করতে হবে। এ ব্যাপারে আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ ক্লিনিকের প্রধান ডা: ফাহিম ইউনুসের পরামর্শকে অগ্রাধিকার দেয়া যায়। তিনি ২০ বছর ধরে ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি করোনাভাইরাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য টুইট করেছেন। তিনি লিখেছেন, করোনা মহামারী বা কোভিড-১৯ এর সাথে আমাদের কত মাস বা কত বছর থাকতে হবে কেউ তা জানে না। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। জীবনকে অহেতুক কঠিন করার দরকার নেই। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে- মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং এক দশমিক আট মিটার (১.৮ মিটার) দূরত্ব বজায় রেখে চলা। এ তিনটি কাজ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার সেরা পদ্ধতি। আর সুযোগ পেলেই ভ্যাকসিন বা টিকা নিতে হবে। টিকায় হয়তো এক শ’ ভাগ সুরক্ষা পাওয়া যাবে না, তবে ভোগান্তি হবে অনেক কম। বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তির আশঙ্কা কমে যাবে।

তিনি মানুষের সচেতনতার জন্য বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ১. গ্রীষ্মে ভাইরাসটি তার প্রভাব হ্রাস করে না। ভারত, বাংলাদেশ, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় গ্রীষ্মকালেই ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ২. লিটারকে লিটার গরম পানি পান করে কোনো লাভ নেই। কারণ সেল ওয়ালে ঢুকে যাওয়া ভাইরাসকে পান করা গরম পানির উষ্ণতা কোনো ক্ষতি করতে পারে না। ৩. যদি বাড়িতে কোনো কোভিড-১৯ রোগী না থাকে তবে বাড়ির মেঝে, দেয়াল, সব কিছু জীবাণুমুক্ত করে হয়রান হওয়ার দরকার নেই। ৪. কার্গো প্যাকেজ, শপিং ব্যাগ, পেট্রলপাম্প, শপিং কার্ট বা ব্যাংকের এ টি এম মেশিন সংক্রমণ সৃষ্টি করে না। হাত ধুয়ে নিন বারবার এবং যথারীতি জীবনযাপন করুন। অহেতুক জীবনকে জটিল করার প্রয়োজন নেই। ৫. কোভিড-১৯ কোনো খাদ্য সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ানো রোগ নয়। এটি ফ্লু সংক্রমণের মতো হাঁচি-কাশির ফোটা বা ড্রফলেটের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। ৭. অনেকে মনে করেন সুয়ানা নিলে গরম বাষ্প শরীরে প্রবেশ করে ভাইরাসগুলোকে হত্যা করবে, কখনোই না। যে ভাইরাস কোষে প্রবেশ করেছে তাকে কোনো প্রকার উষ্ণতা ধ্বংস করতে পারবে না। তা পানি বা বাষ্পই হোক। ৮. কোভিড-১৯ ভাইরাসটি বাতাসে ভেসে থাকে না। এটি একটি ড্রিপ সংক্রমণ যার জন্য ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রয়োজন। তাই খোলা পার্কের নির্মল বাতাসের জন্য মানুষের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরে আসতে অসুবিধা নেই। ৯. অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বিশেষ সাবান ব্যবহার না করে যেকোনো সাধারণ সাবানই করোনাভাইরাসের জন্য ব্যবহার যথেষ্ট। ১০. ভিনেগার, আদার রস, সোডা, বিভিন্ন হার্বের রস জাতীয় জিনিস পান ভাইরাস থেকে রক্ষা করে না। এর বৈজ্ঞানিক কোনো প্রমাণ নেই। তেমনি সারাক্ষণ গ্লাভস পরে থাকা একটি ভুল ধারণা। ভাইরাসটি গ্লাভসে জমে থাকতে পারে। সব সময় হাত ধোয়ার অভ্যাসটা করে ফেলতে পারলে এগুলোর অযথা প্রয়োজন নেই। সচেতন স্বাভাবিক জীবনযাপনই আসল কথা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews