আত্মহত্যা মানবজাতির একটি পুরাতন সমস্যা। সেই প্রাচীনকাল হইতেই কিছু মানুষ তাহাদের জীবনের পরিসমাপ্তি টানিয়া আসিতেছে আত্মহননের মাধ্যমে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে আত্মহত্যা হইল একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষত গত অর্ধশতকে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এইরূপ প্রবণতা বাড়িয়াছে ৬০ শতাংশ। স্বাভাবিক কারণে বাংলাদেশও তাহার ব্যতিক্রম নহে; কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হইল, এই দেশে ভবিষ্যৎ কর্ণধার তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এখন তুলনামূলকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িতেছে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের (আইএএসপি) মতে, প্রতি বৎসর বিশ্বব্যাপী ৭ লক্ষ ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে, যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইহার সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ। আত্মহত্যার এই প্রবণতার দিক হইতে বাংলাদেশ রহিয়াছে দশম স্থানে। তবে সামগ্রিকভাবে বয়স বিবেচনায় ২১ হইতে ৩০ বৎসর বয়সি নারীদের আত্মহত্যার হার অধিক। আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দিক দিয়া স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা রহিয়াছে শীর্ষ অবস্থানে। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি জরিপে দেখা যাইতেছে, গত ২০২২ সালে দেশে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করিয়াছে, তাহার মধ্যে স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৩৪০ ও ১০৬ জন। তাহাদের এই অল্প বয়সে আত্মহত্যার মূল কারণ কী? তাহাদের আত্মহত্যার বড় একটি কারণ হইল—মান-অভিমান। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালটা তাহাদের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় অভিভাবক ও শিক্ষকদের বাড়তি যত্ন নেওয়ার কথা থাকিলেও তাহারা অধিক অবহেলা ও অনাদরের শিকার হয়। তাহাদের সামান্য চাওয়া-পাওয়াকেও আমরা অনেক সময় গুরুত্ব দিই না। এই সময় তাহাদের উপর পড়াশুনার চাপ থাকে অত্যধিক। এই সময় তাহাদের ব্যক্তিত্ব গড়িয়া উঠিবার কথা; কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই আমরা তাহাদের আবেগ, উদ্বেগ ও প্রেমঘটিত বিষয়াদি যথাযথভাবে সামাল দিতে পারি না। প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব থাকে। অন্যান্য কারণের মধ্যে রহিয়াছে—তাহাদের আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াইয়া দিয়া তাহাদের হেয় করা, শিক্ষক কর্তৃক সকলের সম্মুখে অপমান করা, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না করা ইত্যাদি। এই জন্য শুধু শারীরিক নহে, তাহাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও আমাদের এখন হইতে অধিক যত্নবান ও সচেতন হইতে হইবে।

আত্মহত্যা করা স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রের চাইতে ছাত্রীর হার অধিক। ইহার কারণও আমাদের অজানা নহে। আমাদের সমাজে নারীর নিরাপত্তার অভাবই এই জন্য দায়ী। তাহাদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত তাহাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব? স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এইরূপ প্রবণতা কমাইতে হইলে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করিবার পাশাপাশি তাহাদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে করিতে হইবে আনন্দময়। তাহাদের মনে ছোটবেলা হইতেই আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করিতে হইবে। শক্ত করিতে হইবে মনোবল। সর্বত্র স্বাবলম্বীর দীক্ষা দিতে হইবে। সামাজিকীকরণ ও বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তাহাদের সঠিক ধারণা দিতে হইবে। এই জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগ প্রদান করিয়া তাহাদের মাধ্যমে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তাহার ‘সুইসাইড’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, আত্মহত্যা আসলে একটি সামাজিক ঘটনা। সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততা বা বিচ্ছিন্নতাই হইল আত্মহত্যার মূল কারণ। অথচ ধর্ম ও আইনের দৃষ্টিতে ইহা একটি মারাত্মক অপরাধ। তাই পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পার্থক্য, সব সময় নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতা ইত্যাদি হইতেও আমাদের ছেলেমেয়েদের দূরে রাখিতে হইবে। সর্বোপরি নিয়মিত সাইকোথেরাপি, ইতিবাচক মনোভাব, সহানুভূতি, সহযোগিতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদির মাধ্যমেও আমরা তাহাদের আত্মহত্যার প্রবণতা কমাইয়া আনিতে পারি বহুলাংশে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews