সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারায় ইয়াহুর অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে। বিদায় দিতে হচ্ছে ইন্টারনেটের সমার্থক ইয়াহু নামটিও। ইয়াহু নামে আর কোনো স্বাধীন কোম্পানিই যে থাকছে না! দুভাগ হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। মেইল-ইন্টারনেট ব্যবসাসহ ইয়াহুর মূল ব্যবসাকে অধিগ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম প্রতিষ্ঠান ভেরাইজন।

তাদের কাছে থাকা গণমাধ্যম এওএলের সঙ্গে ইয়াহুর ব্যবসাকে একীভূত করে নতুন ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ওথ’ তৈরি হচ্ছে। এদিকে ইয়াহুর আরেক ভাগের নতুন নামকরণ হচ্ছে—আলতাবা। অর্থাৎ, একসময় ইন্টারনেটের সমার্থক ইয়াহুর অস্তিত্ব নাই হয়ে গেল। অথচ, দারুণ একসময় ছিল ইয়াহুর।

শুনলে চমকে ওঠার মতো ঘটনা, আবার আফসোসে মাথার চুল ছেঁড়ার মতোও। প্রযুক্তি বিশ্বের এখনকার অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান গুগলকে দুবার কিনে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল ইয়াহু। কত দামে জানেন? মাত্র ১০ লাখ মার্কিন ডলারে।

কিন্তু গুগলকে সেই সময়ের ইন্টারনেট জগতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ইয়াহু গোনার মধ্যেই ধরেনি। ঘটনা খুব বেশি দিন আগের নয়। মাত্র ১৮ বছর আগের কথা। ১৯৯৮ সাল। গুগলের দুই সহপ্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেজ ইয়াহুর কাছে ১০ লাখ ডলারে গুগলকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। ইয়াহু গুগলকে কেনেনি। নব্বইয়ের দশকে ইয়াহুর ব্যবসা ছিল রমরমা। কারণ, তখন তো আর ফেসবুক কিংবা গুগলের বর্তমান সার্চ ব্যবসা ছিল না। ইন্টারনেট দুনিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইয়াহুর। ইয়াহু প্রযুক্তি দুনিয়ার ভবিষ্যৎ ট্রেন্ড আন্দাজ করতে পারেনি। ফলে, তাল মেলাতে না পেরে দিন দিন পিছিয়ে পড়েছে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের চোখে ইয়াহুর বিপর্যয়ের কারণ, এর কর্মকর্তারা অনেক সুযোগ হেলায় হারিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল গুগলের পেজ র‍্যাঙ্ক সিস্টেমটিকে মাত্র ১০ লাখ ডলারে কেনার সুযোগ। ওই সময় গুগলের দুই উদ্যোক্তা স্ট্যানফোর্ডে তাঁদের পড়াশোনায় অধিক আগ্রহ দেখাতে গুগল বেচতে চেয়েছিলেন। ইয়াহু নিজেদের প্ল্যাটফর্মকে গুরুত্ব দিতে গুগলের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি।

পেজ র‍্যাঙ্ক হচ্ছে একধরনের এলগরিদম-ভিত্তিক ব্যবস্থা, যা বিভিন্ন ওয়েবসাইটকে গুগল সার্চ রেজাল্টে তুলে ধরে। এর নামকরণ করা হলো ল্যারি পেজের নাম অনুসারে। ওয়েবসাইটের গুরুত্ব বোঝায় এটি।

ইয়াহু তাদের ডিরেক্টরি নিয়ে খুশি ছিল। এর মধ্যে প্রশ্নোত্তর, মেইল, শপ, গেম প্রভৃতি প্ল্যাটফর্ম ছিল ইয়াহুর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন দুনিয়া থার্ড পার্টি অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে আসা আয়ের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে। গুগল ‘পে-পার ক্লিক’ বা অ্যাডওয়ার্ড তৈরি করে ফেলে। এর মধ্যে পার হয়ে যায় চারটি বছর। ২০০২ সালে আবার ইয়াহুর কাছে ধরনা দেয় গুগল। লক্ষ্য ছিল ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল সংগ্রহ করা। গুগল নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করছিল। ইয়াহুর প্রধান টেরি সেমেল গুগলের ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ইয়াহু তখন গুগলকে ঠেকাতে নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন তৈরি শুরু করে। ইয়াহু বলার মতো কিছুই করতে পারেনি। ফলে, ব্যর্থতার আবর্তে ঘুরতে থাকে।

যদি গুগলের সেই শুরুর দিনগুলোতে ইয়াহু গুগলকে কিনে নিত, তাহলে হয়তো গল্পটা অন্য রকম হতো। শুধু গুগলকে হাতছাড়া করার ভুল নয় ইয়াহু নিজেদের পরিবর্তন না করে আরও বড় কিছু ভুল করেছে। এর মধ্যে একটি ছিল নিজেদের মিডিয়া কোম্পানি ভাবা।

ইয়াহু কর্তৃপক্ষ বরাবরই নিজেদের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নাকি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, এ দ্বন্দ্বে ভুগেছে। এ ছাড়া সময়মতো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে ধুঁকতে থাকা ইয়াহুর ওপর চোখ রাখছিল ভেরাইজন।

একসময় ইন্টারনেট ব্যবসায় আধিপত্য বজায় রাখা ইয়াহুর মূল ব্যবসা ৪৪৮ কোটি ডলারের বিনিময়ে কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে মার্কিন টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে ইয়াহু ছেড়েছেন এর প্রধান নির্বাহী মারিসা মায়ার। ১৩ জুন ইয়াহু কর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি মেইল পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠান ছাড়ার কথা বলেন মায়ার। তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে জানাতে চাই যে আমি স্মৃতিবেদনা, আশাবাদ ও কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ।’ ইয়াহু আর এওএল-কে মিলিয়ে ওথ নামের নতুন মিডিয়া গঠন করছে ভেরাইজন। এওএল প্রধান নির্বাহী টিম আর্মস্ট্রং এ দলের নেতৃত্ব দেবেন। কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করতে হলে প্রতিষ্ঠানটিতে সমন্বয় প্রয়োজন।’

এদিকে ইয়াহুর মূল ইন্টারনেট ব্যবসায় ক্রয়ের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ২ হাজার ১০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করেছে টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। ছাঁটাইরত এই কর্মীসংখ্যা ভেরাইজনের মালিকানায় যাওয়া ইয়াহু আর এওএল-এর মোট কর্মীর ১৫ শতাংশের সমান। ১৫ জুন ইয়াহুকে ভেরাইজনের কিনে নেওয়াসংক্রান্ত সব চুক্তির অনুমোদন দেয় ইয়াহুর শেয়ারধারীরা। এরপর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারমূল্য ৫ দশমিক ১৬ ডলার বেড়ে ৫৫ দশমিক ৭১ ডলার হয়। বেড়ে যাওয়া এই শেয়ারমূল্যের হিসাবে ইয়াহু ত্যাগের সময় মায়ার ২৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ইয়াহু কর্মীরাও বড় অঙ্কের প্যাকেজ পাবেন, যার মধ্যে দুই বছর পর্যন্ত সময়ের পারিশ্রমিক আর তাদের কেনা শেয়ারের মূল্যও রয়েছে।

ভেরাইজনের মালিকানায় না যাওয়া ইয়াহুর বাকি অংশের মধ্যে ১৫ শতাংশের মালিকানা চীনা ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবা আর ইয়াহু জাপানের হাতে। এই অংশের নতুন নাম হতে যাচ্ছে ‘আলতাবা’। ইয়াহু পরিচালনা পর্ষদের সদস্য টমাস ম্যাকনারনি অ্যাটলাবার প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন।

ওএল এবং ইয়াহু প্রতিষ্ঠান দুটি অনেক দিন ধরেই বাজারে প্রতিকূল অবস্থায় সঙ্গে কঠিন লড়াই করে যাচ্ছে। গত বছর ইয়াহু দুবার সাইবার হামলার খবর প্রকাশের পর চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ইয়াহু সংশোধিত বিক্রয়মূল্যে রাজি হয়ে ভেরাইজনের সঙ্গে চুক্তি করতে সম্মত হয়। ৩০ জুনের মধ্যে ইয়াহু ই-মেইল এবং অন্যান্য অনলাইন অপারেশন নিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ভেরাইজনের।

ইয়াহুকে কেনার বিষয়ে ভেরাইজনের প্রধান নির্বাহী লাওয়েল ম্যাকঅ্যাডাম বলেন, মুঠোফোনভিত্তিক বৈশ্বিক গণমাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার লক্ষ্য থেকে ইয়াহুকে কেনা হয়েছে। অনলাইনে ইয়াহু ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে এক কোটিরও বেশি। বেশ কিছুদিন ধরে ধুঁকছিল একসময়ের ইন্টারনেটের বড় প্রতিষ্ঠান ইয়াহু। ইয়াহুর বিনিয়োগকারীরা চাইছিলেন প্রতিষ্ঠানটিকে বিক্রি করে দিতে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইয়াহুকে বিক্রি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। এরপর থেকেই চলছিল ক্রেতার খোঁজ।

বর্তমানে ইয়াহুর কর্মীসংখ্যা ৮ হাজার ৮০০।

কেন ইয়াহুকে কিনল ভেরাইজন? বর্তমান বিশ্ব ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের। এ ক্ষেত্রে গুগল ও ফেসবুক তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে ইয়াহুর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল ভেরাইজনের। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে গুগল ও ফেসবুকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে ইয়াহুর দিকে হাত বাড়িয়েছে মার্কিন টেলিকম প্রতিষ্ঠানটি। ইয়াহুর জনপ্রিয় সম্পদ বলতে ফ্যান্টাসি স্পোর্টস ও ইয়াহু মেইল। এ দুটি সেবা থেকে এখনো অর্থ আসছে। সব সেবাকে কাজে লাগিয়ে ভেরাইজন আগামী দিনের ইয়াহু হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছে। তথ্যসূত্র: দ্য ইনকোয়ারার, বিজনেস ইনসাইডার।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews