১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানি লেখকদের মধ্যে দ্বিবিধ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একশ্রেণির পাকিস্তানি লেখক যেকোনো অবস্থায় শাসকদের সব অপকর্মের সাফাই গেয়েছেন। আরেক শ্রেণির লেখক পাকিস্তানি ‘মন’ নিয়েও সত্যাসত্য বিচারের চেষ্টা করেছেন। ইকবাল আখুন্দ ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বে তিনি কায়রো ও বেলগ্রেডে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই মেমোয়ারস অব আ বাইস্ট্যান্ডার: আ লাইফ ইন ডিপ্লোমেসি এবং আরও কিছু গবেষণামূলক বইয়ের আলোকে এই ধারাবাহিকের দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো আজ।

৩ ডিসেম্বরের পর ‘উপমহাদেশীয় যুদ্ধ’ চলে দুই ফ্রন্টে। একটি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত, অপরটি জাতিসংঘ। পাকিস্তান ভেবেছিল, ভারতকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেবে। বহির্বিশ্বকে দেখাবে যে এটা দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ। রাজনৈতিক সংকট তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি পেছনে পড়ে যাবে। কিন্তু তাদের এই ভাবনা বুমেরাং হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে সব আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।

জাতিসংঘে পাকিস্তান বা চীন যখন ভারতের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ আনে, তখন ভারতে এক কোটি মানুষের আশ্রয় নেওয়া, বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবকে জেলে রাখা এবং গণহত্যার বিষয়টি সামনে আনে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপীয় দেশগুলো সরাসরি বাংলাদেশকে সমর্থন না করলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন বন্ধ এবং শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেয়। পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বরাবর তার অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ কংগ্রেস সদস্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জবরদস্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে পাকিস্তানের ওপর মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটি প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়নি। মার্কিন জনমতও ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। সাধারণ পরিষদে পাকিস্তান বেশ কিছু দেশের সহানুভূতি পেলেও নিরাপত্তা পরিষদে সুবিধা করতে পারেনি। পাকিস্তান যতই বলে আমরা আক্রান্ত, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি হোক, ভারত তার বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি, পাকিস্তানি শাসকের চণ্ডনীতির কারণে এক কোটি মানুষের দায় তাদের নিতে হয়েছে।

জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছেন, তিনি মহা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন, তাঁর শিকড় জনগণের ভেতরে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি এখানে এসেছেন। ভারতীয় প্রতিপক্ষ এর উত্তরে বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি সেখানে সরকার গঠন করতে পারেন। কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, তাঁকেই দেশশাসনের অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানিরা যখন একের পর এক রণাঙ্গনে হেরে যাচ্ছে, তখন জাতিসংঘে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করাতে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিটি প্রস্তাবেই ভেটো দেয়। ভারত ও সোভিয়েতের কথা হলো, যুদ্ধবিরতির আগে যুদ্ধের কারণটি খুঁজে বের করতে হবে। কারণগুলো দূর করতে হবে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুগোস্লাভিয়ায় দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত ইকবাল আখুন্দকে ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘে পৌঁছার নির্দেশ দেয়। তিনি জে এফ কেনেডি বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ভুট্টো যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন, সেখানে ছুটে যান। ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেন, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো ফল পাওয়া যাবে কি না। ভুট্টো সরাসরি জবাব দিলেন, ‘আমি জানি না।’ ভুট্টোর মনে তখন অন্য চিন্তা। তিনি ইয়াহিয়া খানের সরকারের একজন মন্ত্রী না থেকে নিজেই সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

 ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে কয়েক দফা চেষ্টা করেও টেলিফোনে ইয়াহিয়া খানকে ধরতে পারেননি। এরপর ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা আসে, যার মর্মার্থ হলো ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান এ কে নিয়াজি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। ইয়াহিয়া নিজেও এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁর মতে, এই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থ হবে অবমাননাকরভাবে অখণ্ড পাকিস্তানের অবসান। তিনি কোনোভাবে এই আত্মসমর্পণের অংশীদার হতে চান না।

জবাবে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন, তাঁরা যেন অন্তত এক সপ্তাহ যুদ্ধ চালিয়ে যান। পরদিন ভুট্টো পাকিস্তানের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সবার মুখে একটি প্রশ্ন: চীন পাকিস্তানের পক্ষে এগিয়ে আসবে, না আসবে না। ভুট্টোর সঙ্গে যে সামরিক কর্মকর্তা ইসলামাবাদ থেকে গিয়েছেন, তিনি বললেন, ‘এখনই চীনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’ এরপর ভুট্টো ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠালেন যে চীনা সহায়তার জন্য তিনি যেন নিজে বেইজিং সফর করেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার আর সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তার আগেই নিয়াজি আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে।

এদিকে পূর্ব ও পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তানের জন্য একের পর এক বিপর্যয়কর খবর আসতে থাকে। যশোরসহ বেশ কয়েকটি শক্ত ঘাঁটি দখল হয়ে গেছে। সেখানে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছে। যদিও তখনো পাকিস্তানি সংবাদপত্র বলে বেড়াচ্ছে, ‘যশোর পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণেই আছে।’ হাস্যকর খবর। সারা বিশ্ব দেখেছে যশোরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সমাবেশ করেছেন। এরপর নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাবই আসুক না কেন, ভারত নাকচ করে দেয়। তাদের দৃঢ় আশা, শিগগিরই যৌথ বাহিনী ঢাকা দখল করে নেবে।

এরই মধ্যে একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা ভারতীয় ও সোভিয়েত কূটনীতিকদের কথোপকথন শুনে ফেলেন। ভারতীয় কূটনীতিক অধিবেশনটি আরও দু–এক দিন ঠেকিয়ে রাখতে বললেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্বকে এ অ্যাপল অব আওয়ার আইস ও লেনিনের স্বপ্ন বলে অভিহিত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন প্রস্তাব ছিল, বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা দেওয়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানানো। পাকিস্তানিদের চোখে এটি ছিল পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার কৌশল।

যুদ্ধক্ষেত্রে যখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিয়াজির প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠাচ্ছে, তখন নিরাপত্তা পরিষদ ভারত-পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ে নতুন করে বিতর্কে মিলিত হয়। ১৩ ডিসেম্বর সেই বিতর্ক ৪০ মিনিট চলার পর পরের দিনের জন্য মুলতবি হয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টোর ‘নাটক মঞ্চায়নের’ আগেই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালেক মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে। কিন্তু সেই বৈঠক শুরুর আগেই গভর্নর হাউসে একের পর এক বোমা হামলা হতে থাকে। ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকে এই বোমা ফেলা হয়, যাতে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ দ্রুত হয়। গভর্নর মন্ত্রিসভার বৈঠক না করে পদত্যাগ করেন।

আগামীকাল: ভুট্টো বললেন, ‘আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো’
সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews