ষাটের দশকে উর্দু চলচ্চিত্রের স্রোতে বাংলা চলচ্চিত্র যখন বিপন্ন, তখন লোককাহিনি-নির্ভর চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ নির্মিত হয়। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন যুগের সূচনা ছিল। জানা গেছে, তখন রূপবান ছবিতে রূপবানের স্পর্শকৃত বাঁশটি উঠেছিল নিলামে। সিনেমাটির একটি দৃশ্যে সুজাতা একটি বাঁশে হাত রেখে গান গেয়েছিলেন। ভক্তকুলের অভিলাষে সেই বাঁশটি বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। তখন যার মূল্য এক বা দুই আনার বেশি হওয়ার কথা নয়। যাত্রাপালায় তখন ‘রূপবান’-এর জয়জয়কার। দলবেঁধে ‘রূপবান’ দেখতে যেত মানুষ। এ গল্প সিনেমার পর্দায় আনলেন সালাহ্উদ্দিন।

মূল পরিকল্পনায় ছিলেন তাঁর সহকারী সফদার আলী ভূঁইয়া। ১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর সিনেমাটি মুক্তি পায়। তখন ছবিটির বাজেট ছিল দেড় লাখ রুপি। বক্স অফিসে ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর বাণিজ্যিক সাফল্য অতীতের সব রেকর্ড ভাঙে। চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে ‘রূপবান’ এর ভূমিকা ছিল অনন্য। ছবিটি তখন প্রায় ২০ লাখ রুপির ব্যবসা করে। চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দী ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সামাজিক অঙ্গীকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে যেখানে অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের মাত্র চার বা পাঁচটি সিনেমা হলে রিলিজ হতো, সেখানে রূপবান ১৭টি হলে রিলিজ হয়েছিল। শুধু রূপবানের প্রদর্শনীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় অনেক অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল।

টিনের চালার এসব প্রেক্ষাগৃহ, অ্যানালগ সিনেমা হলের পর্দা আর কাঠের বেঞ্চের ছারপোকার ছড়াছড়ির মাঝেই নিজেদের স্থান করে নিতেন রূপবানের দর্শকরা। ঢাকার স্টার সিনেমা হলে প্রতি বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ছিল নারীদের জন্য বিশেষ শো-এর ব্যবস্থা।

১৯৬৫-পরবর্তী যুগকে সিনে-সাংবাদিকরা রূপবান যুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তখন রূপবানের ভূত চেপেছিল সর্বত্রই। রূপবান সিগারেট, রূপবান আলতা, রূপবান ঘুমের বটিকা, রূপবান মার্কা কেরোসিন তেল থেকে শুরু করে আরও কত কী।

১২ বছরের রূপবানের সঙ্গে রাজপুত্র রহিম, যে কিনা সদ্য জন্মলাভ করেছে, তার বিয়ের মাধ্যমে এ কাহিনির বিস্তৃতি ঘটে। তারপর দৈববাণীর কল্যাণে ১২ দিনের স্বামী রহিমকে নিয়ে ১২ বছরের রূপবানের বনবাস। রূপবানের বনের সংগ্রামী জীবন, রহিম বাদশার বেড়ে ওঠা, অপর রাজকন্যা তাজেলের প্রেমে পড়া, পরিশেষে অমোঘ সত্য প্রকাশিত হওয়ার বিষয়াদিই রূপবান লোককাহিনির উপজীব্য। ছবিটির প্রযোজনা ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক স্বয়ং। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা, মনসুর, চন্দনা, আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, তেজেন চক্রবর্তী, তন্দ্রা, রহিমা ও হেলেন। কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন চিত্রগ্রহণে আবদুস সামাদ, সংগীত পরিচালনায় সত্য সাহা, শব্দগ্রহণে মনি বোস ও সম্পাদনায় বশীর হোসেন। সুজাতা আজিমের লেখা ‘আমার আত্মজীবনী’তে খুঁজে পাওয়া যায় ‘রূপবান’ সংশ্লিষ্ট আরও নানা তথ্য। ‘রূপবান’ চরিত্রে অভিনয়কারী সুজাতার পারিবারিক নাম ছিল তন্দ্রা মজুমদার। পরিচালকের কল্যাণে সেটা হয়ে যায় সুজাতা। রূপবান মুক্তির পর ছবিটির জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে, নায়িকা সুজাতাকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অনুরাগীদের ঢল ঠেকানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করতে হয়েছে। গ্রামের যেসব মা-চাচিরা ইতিপূর্বে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার কথা চিন্তাও করেননি, তারাও ‘রূপবান’ দেখতে গরু-মহিষের গাড়িতে হলমুখী হয়েছিলেন। ‘ও দাইমা কীসের বাদ্য বাজে গো’, ‘সাগরকূলের নাইয়ারে’, ‘মনের দুঃখ কইনারে বন্ধু রাইখাছি অন্তরে’, ‘বিদায় দেন বিদায় দেন’ শিরোনামে রূপবানের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান তখন হরহামেশাই লোকমুখে শোনা যেত। তৎকালীন দৈনিক পত্রিকায় ‘রূপবান’-এর বিজ্ঞাপন থেকেও ছবিটির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায়। ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ‘রূপবান : ৩৬তম সপ্তাহ রূপমহলে’ শিরোনামে বিজ্ঞাপন। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews