বইয়ের আদলে তৈরি একটি কেক। কেকের পাশ দিয়ে আবার ছোট ছোট করে রেখা টানা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, বইটির অনেকগুলো পাতা। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘রূপার ডায়েরি’। নিচে ছোট করে লেখা ‘বাবা’।
রূপার বাবা ছোটদের জন্য একটি বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘রূপার ডায়েরি’। রূপার বাবার আসল নাম শমসের ভূঁইয়া। কিন্তু বইটির লেখকের নামের জায়গায় ‘বাবা’ নাম ব্যবহার করেছেন।
আজ বইটির মোড়ক উন্মোচন। তাই এমন কেক। রূপা কেক কেটে বইটির মোড়ক উন্মোচন করবে। অনুষ্ঠানে রূপার বাবা রূপার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। ইতোমধ্যে সব বন্ধু চলে এলেও একজন শুধু বাকি রয়ে গেছে।
বন্ধুটির নাম কৌশিক। তার এসে পৌঁছতে আরো কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগবে। ঢাকা শহরের জ্যামের কারণে নয়, কৌশিক আসছে ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম কুলিয়ারচর থেকে। রূপার বাবা অনেকদিন কুলিয়ারচর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার ছিলেন। সেই সূত্রে রূপারা একসময় কুলিয়ারচরে থাকতো। সেখানেই কৌশিকের সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব। তারা একই স্কুলে একসঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েছে।
রূপার বাবা বদলি হয়ে ঢাকা চলে গেলে তারপর থেকে অনেকদিন তাদের দেখা হয় না। প্রায় দুই বছর পর আজ দেখা হবে। অনেকদিন পর প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে দারুণ ভালো লাগছে রূপার। ‘রূপার ডায়েরি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বইটি নিয়ে আজ তিনজন বিশিষ্ট পড়ুয়া আলোচনা করবে। বক্তাও বলা যায় তাদের। রূপারই বন্ধু তারা। প্রথম যে বলবে তার নাম রোদ্দুর। রূপাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। পড়ছে নার্সারিতে। তারপর আলোচনা করবে মরিয়ম। রূপার ক্লাসেই পড়ে সে। মিরপুরে বাসা ওদের। সেখান থেকেই মায়ের সঙ্গে এসেছে।
সবশেষ রাইয়ান বলবে বইটি নিয়ে তার ভালোলাগার কথা। রাইয়ান রূপার ফুফাতো ভাই। থাকে খিলগাঁও। সে পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। রূপার ক্লাস আর ক্লাসের বাইরের আর যে বন্ধুরা এসেছে সবাই এই অনুষ্ঠানে কেবল অতিথি, শ্রোতা।
রূপার বাবা ভাবলেন, কৌশিক আসতে আরও বেশ সময় লাগতে পারে। সে না আসা পর্যন্ত কেকও কাটা যাবে না। এই ফাঁকে বইটির আলোচনা শুরু করে দেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমেই রোদ্দুর তার আলোচনা শুরু করল। বলল, ‘এই বইটি আমাকে পড়ে শুনিয়েছে আমার মা। বইয়ের ভেতর সুন্দর সুন্দর ছবি। ছবিগুলো আমার অনেক ভালো লেগেছে। সবাইকে ধন্যবাদ।’
রোদ্দুরের আলোচনা শেষ। সবাই হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাল রোদ্দুরকে। এরপর এলো মরিয়ম। বলল, ‘রূপার ডায়েরি’ বইটাতে আমাকে আর রূপাকে নিয়ে লেখা একটা স্মৃতিচারণ আছে। কে বেশি বই ভালোবাসে? আমি নাকি রূপা? এই নিয়ে আঙ্কেল চমৎকারভাবে লেখাটা লিখেছেন। তোমরা পড়লেই বুঝতে পারবে কতো মজার। এরকম আরো অনেক মজার মজার লেখা আছে বইটিতে। বইটি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে। থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কেল, আমাদের জন্য এতো সুন্দর একটি বই লেখার জন্য।’
মরিয়মের আলোচনা শেষ হতে ফের হাততালি বাজাল সবাই। তুমুল করতালিতে তাকে অভিবাদন জানাল। সবশেষ রাইয়ান এলো বইটি নিয়ে তার পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে। এসেই বলল, ‘এখানে মাইক নেই কোথাও? আমি আবার মাইক ছাড়া কথাই বলতে পারি না।’
রাইয়ানের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। রূপা তার প্রিয় বাঁশিটা রাইয়ানের মুখের সামনে ধরে বলল, ‘এটা মাইক, এবার বল তোর কথা।’ দুইবার হ্যালো হ্যালো, মাইক টেস্টিং, হ্যালো ওয়ান টু থ্রি…বলে রাইয়ান তার কথা শুরু করলো। শুরুতেই উপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘তোমরা কি সবাই বই ভালোবাসো?’
সবাই হাত তুলে ‘হ্যাঁ’ বলতেই রাইয়ান ফের বলতে শুরু করে, ‘তাহলে ‘রূপার ডায়েরি’ বইটি সবাইকে পড়তে হবে। এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির শিরোনাম হলো ‘রূপা যেভাবে বইপ্রেমী হয়ে উঠল।’ আমি আগে গাছপ্রেমী ছিলাম। এই বইটি পড়ে গাছের সাথে সাথে এখন বইপ্রেমীও হয়ে গেছি। আঙ্কেলের লেখা অনেক সুন্দর। নাহ্! নাহ্! হাতের লেখা নয়। বইটিতে আঙ্কেলের লেখা গল্পগুলো।’
রাইয়ানের কথা শেষ হতেই আবার হাসির রোল। এর ভেতরেই কৌশিক তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করে। কৌশিকের হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। ব্যাগভর্তি কুলিয়ারচরের কালী নদীর মাছ। রূপারা যখন কুলিয়ারচরে থাকতো, সে তার বাবার সঙ্গে প্রায় সকালেই কালী নদীর পাড়ে যেত মাছ কিনতে। সদ্য নদী থেকে ধরে আনা তরতাজা ছোট-বড় মাছ দেখতে কি যে ভালো লাগতো রূপার!
তখন থেকেই মাছ খুব প্রিয় তার। বন্ধুর প্রিয় জিনিসটাই কৌশিক এতটা পথ বয়ে নিয়ে এসেছে। মাছের ব্যাগটা রূপার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে লেখা বইয়ের জন্য অভিনন্দন।’
কৌশিককে ধন্যবাদ জানিয়ে মাছের ব্যাগটা নিজের হাতে নেয় রূপা। তারপর মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ফুল মাসীকে বলো এখনই রান্না করে যেন। অনুষ্ঠান শেষে বন্ধুরা সবাই কুলিয়ারচরের নদীর তরতাজা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যাবে।’ চার কূলে কেউ নেই ফুল মাসীর। রূপাদের বাড়িতেই থাকেন। রূপার মায়ের সব কাজকর্মে সহযোগিতা করেন। অদূরে দাঁড়িয়ে তিনি রূপার বলা কথাটা শুনতে পেলেন। শুনতে পেয়ে সাথে সাথে রূপার মায়ের হাত থেকে মাছের ব্যাগটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
অনেক বেলা হয়ে গেছে। এবার কেকটা কাটতে হবে! ভাবতে ভাবতে রূপা কেকের সামনে এসে দাঁড়ায়। সবার উদ্দেশে বলল, ‘বন্ধুরা, আজকের এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রবেশের সময় সবার হাতে একটি করে চিরকুট দেওয়া হয়েছে। যাদের চিরকুটে ‘বই’ শব্দটি লেখা আছে তারা আমার বা পাশে চলে এসো।’
তরতর করে একদল বন্ধু রূপার বাঁ পাশে এসে দাঁড়াল। এবার রূপা বলল, ‘যাদের চিরকুটে ‘প্রেমী’ শব্দটা লেখা আছে তারা আমার ডান পাশে এসে চলে এসো।
হুলুস্থুল করে আরেকদল এসে রূপার ডান পাশে দাঁড়াল। সবাইকে নিয়ে কেক কাটতে কাটতে বলল সে, ‘আজ ৯ অগাস্ট জাতীয় বইপ্রেমী দিবস। আমরা সবাই বইপ্রেমী। বইপ্রেমীদের পক্ষ থেকে ‘রূপার ডায়েরি’ বইটির লেখক শমসের ভূঁইয়া ওরফে বাবাকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন। বাবা, বন্ধুদের জন্য তুমি কিছু বলো।’
অদূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন রূপার বাবা। বইপ্রেমী দিবসটিও এত চমৎকারভাবে উদযাপন করা যায়, আজ না করলে জানতেনই না তিনি। একটু হেঁটে গিয়ে রূপার মুখে এক টুকরো কেক তুলে দিয়ে বললেন, ‘জাতীয় বইপ্রেমী দিবসে বই পড়া, বই কেনা, বই দান করা এবং অন্যদের বই পড়তে উৎসাহিত করার জন্য উদযাপন করা হয়। এটি এমনই এক উদযাপন যা বই এবং পড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে। আমার লেখা ‘রূপার ডায়েরি’ বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজনটি আজই করলাম, কারণ অনেকে এই দিনে বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের নতুন বই পড়তে উৎসাহিত করে। অনুষ্ঠানে আসা বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা রইল।’
ততক্ষণে কেকের বাকি অংশটাও কাটা হচ্ছে, বন্ধুদের দেওয়ার জন্য। কাটতে কাটতে রূপা দেখে বন্ধুরা সবাই ‘রূপার ডায়েরি’ বই হাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে, কেউ পড়ছে, কেউ বইয়ের ভেতরের ছবি দেখছে। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে মেয়ের বন্ধুদের দেখছেন রূপার মা। মুগ্ধ হয়ে দেখছেন তাদের কারোর হাতে মোবাইল নেই, ট্যাব নেই। কেউ মোবাইলে খেলছে না, অপ্রয়োজনীয় ভিডিও দেখে সময় নষ্ট করছে না। সবার হাতে বই।
বহুদিন পর এতো চমৎকার দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায় মায়ের। এতগুলো বইপ্রেমী বন্ধুর সঙ্গে ভারি সুন্দর হয়ে ওঠে আজ এই দিনটি।