স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে যারা বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য চেতনার প্রতি যারা অনুগত তাদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একটি অবিকল্পনীয় দলিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা মারফত যে নতুন দেশটির অভ্যুদয় ঘটিয়েছিলেন,  প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন দেশটির জনকের, স্থপতির ভূমিকায়, সে দেশটির জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সেদিন অধ্যাপক ইউসুফ আলিকে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার এবং সেই ক্ষমতাবলেই তিনি শপথ পরিচালনা করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার আলোকে বাংলাদেশ ভূখন্ডে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা জনগণের দ্বারা তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের সমন্বয়ে সেদিন এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠন করেছিলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ। এ ঘোষণাপত্রটি ছিল জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই ঘোষণাপত্র, যার দ্বারা তারা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তাদের ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার আলোকে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার, আর জাতির জনকের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েই নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন যা সেই মাসেরই ১৭ তারিখে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ ঘোষণাপত্রের একটি বিশেষ দিক ছিল এই যে- এতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নিশ্চয়তা ছিল।

পরবর্তীকালে ১৯৭২-এর ১১ জানুয়ারি প্রভিশনাল কনস্টিটিউশন ঘোষণার আগ পর্যন্ত ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিলের ঘোষণাই অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের বিধানবলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে যে গণপরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছিল, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সেই গণপরিষদ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান এবং নির্দেশনায় রচিত স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, যা সে বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়েছিল। উল্লিখিত দিনগুলোর আগ পর্যন্ত এ ঘোষণাপত্রই অস্থায়ী সংবিধান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল বলে যথাযথভাবে সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে এবং সপ্তম তফসিলে এটিকে সংবিধানের অংশে পরিণত করে উল্লেখ করা হয়েছে- “২৬ মার্চ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম এবং সপ্তম তফসিলে বর্ণিত ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হইল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল, যাহা উক্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বলিয়া গণ্য হইবে।” সংবিধানের বিধি-বিধান মোতাবেক অনেক কিছুই পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব হলেও যে দুটি বিষয় কখনো পরিবর্তন করা যাবে না তার একটি হলো ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। এ দুটি বিষয় বিরাজ চির অম্লান হয়ে, অমরত্বের দাবি নিয়ে। আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ (যা অষ্টম সংশোধনী মামলা নামেও পরিচিত) মামলার রায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, সংবিধানের প্রিয়েম্বল, সপ্তম এবং অষ্টম অনুচ্ছেদ কখনো সংসদ দ্বারা পরিবর্তনযোগ্য হবে না, এগুলোতে পরিবর্তন আনতে হলে গণভোটের দরকার হবে।

আজ কিছু লোক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করার প্রবণতায় মেতে উঠে যে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন তাদের সম্বন্ধে যে কথাটি প্রযোজ্য তা হলো এই যে, তারা মনে-প্রাণে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন না। আর সে কারণেই সেই ব্যক্তিটির প্রতি তাদের অনীহা, যিনি দেশকে স্বাধীন করার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট অপপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণহত্যা শুরু হলে, কিছু লোক সেদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন শুধু পাকিস্তানিদের বুলেট থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। তাদের কারও কারও মন্তব্য থেকে পরিষ্কার যে মুক্তিযুদ্ধে না গিয়ে তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে অবস্থান নিলে পাকিস্তানি সেনারাই তাদের হত্যা করত, যেমন হত্যা করেছে বহুজনকে। কর্নেল অলি এবং আরও কয়েকজনের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ভাষণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা ২৫ তারিখে নেহায়েত নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্যই রাতারাতি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বনে গিয়েছিলেন অন্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব ধারণ না করেই। এটিও পরিষ্কার যে, সে সময় মেজর জিয়া, যিনি ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরেও সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানি সমরাস্ত্র খালাসের জন্য বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও এ ভয়েই অবশেষে তার গতি পরিবর্তন করেছিলেন যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকলে পাকিস্তানি সৈন্যরাই তাকে হত্যা করবে, যেমন বহু বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করেছে। বেশ কয়েকজন বাঙালি সৈন্য জিয়ার পথ রোধ করে তাকে এ বিষয়ে বোঝালে জিয়া ভয়ে আর সোয়াত জাহাজের দিকে এগোননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার ১৯৮১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ে যা লিখেছেন তা থেকে জিয়া-অলিদের ভূমিকা পরিষ্কার বোঝা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস না করে ২৫ মার্চ নেহায়েত নিজেদের জীবন রক্ষার্থে যারা রাতরাতি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন, তারাই বঙ্গবন্ধু এবং ভারতবিদ্বেষী রয়ে গেছেন, কেননা আদর্শগতভাবে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় তত্ত্বকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুলতানা কামাল কয়েক মাস আগে এক গোলটেবিল আলোচনাকালে এমনটিই বলেছিলেন। ২৫ মার্চ কনভার্ট হওয়া এসব মানুষ তাদের মন থেকে পাকিস্তান প্রীতি কখনো ভুলতে পারেননি, শুধু নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনের তাগিদে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন, যদিও বাঙালি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব দ্বারা তারা কখনো নিয়ন্ত্রিত হননি, মজ্জাগত ভারতবিদ্বেষ থেকেও তারা কখনো পিছপা হতে পারেননি। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার বই ‘স্বাধীনতা ৭১’-এ লিখেছেন, “৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর, পাকিস্তানের ইতিহাসে যখন এক চরম রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সূচনা হলো, তখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তার রেজিমেন্ট গঠনের কাজে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ৭১-এর মার্চের ১৫-১৬ তারিখে, জিয়াউর রহমানের ব্যাটালিয়নের দুটি কোম্পানি চট্টগ্রাম জেটি ও আরেকটি কোম্পানিকে কালুরঘাট সেতু পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময় কাজের সুবিধার জন্য জিয়াউর রহমান কালুরঘাটের কাছে বিএন কোয়ার্টার ও কন্ট্রোল রুম বসান।

২৪ মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান নিরুত্তাপেই কাটান। কিন্তু ২৫ মার্চের মধ্য রাতে ব্যাটালিয়নের বেশ কয়েকজন সদস্য জিয়াউর রহমানের কাছে নানা ধরনের কঠিন ও ভীতিপ্রদ খবর পৌঁছে দিতে থাকেন। ওই সময়কার চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামরিক বিভাগের অভ্যন্তরীণ সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসদ ব্যবহার ও আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের করণীয় কী তা জানাতে জিয়াকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ২৫ মার্চের রাত প্রচ- উত্তেজনা ও উদ্বেগের মধ্যে কাটল। ২৬ মার্চ সকালে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে জিয়াকে ডেকে পাঠানো হলো। নানা কিছু ভেবে জিয়া ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়া স্থির করেন। কিন্তু তার কিছু সহকর্মী তাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যেতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন। এত অনুরোধ ও নিষেধ উপেক্ষা করেও তিনি একটি জিপে ই.বি.আর.সি ক্যান্টেনমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার বেরিয়ে যাওয়ার সময় ৮ম রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ শিবিরে ছিলেন না। তিনি শিবিরে এসেই কমান্ডার কোথায় জানতে চান। কমান্ডার ই.বি.আর.সি হেডকোয়ার্টারের দিকে গেছেন বলে সৈনিকরা তাকে জানালে ক্যাপ্টেন অলি উন্মাদের মতো একটা মিলিটারি মোটরসাইকেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছোটেন। টাইগার পাসের কাছে তিনি জিয়ার জিপের গতিরোধ করে দাঁড়ান। জিয়ার গাড়ির সামনে অলি তার মোটরসাইকেলটি ফেলে দিয়ে চালকের আসনে বসা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্যার, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ জিয়া স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি। ব্রিগেডিয়ার ডেকে পাঠিয়েছেন।’ অলি চিৎকার করে ওঠেন, ‘আপনি এখন ক্যান্টনমেন্ট যাচ্ছেন? গেলেই আপনাকে গুলি করবে। আপনি জানেন কি, গতকাল ৪০০ বাঙালি রিক্রুটকে গুলি করে হত্যা করেছে? কুমিল্লা বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুর্মিটোলা ও জয়দেবপুর বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনের ওপর ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এসব জানার পরও কোন সাহসে আপনি ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন?’

‘কী করব? ক্যান্টনমেন্টে না গেলে যে কোর্ট মার্শাল হবে।’ এবার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কীসের কোর্ট মার্শাল? গুলি, গুলি করে মারবে ওরা। আপনি কিছুতেই ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারবেন না, বলেই ক্যাপ্টেন অলি তার রিভলভার উঁচিয়ে বলেন, ‘আপনাকে এখনো কমান্ডার হিসাবে মানি। কিন্তু আপনি যদি ক্যান্টনমেন্টে যেতে চান তাহলে আমিই আপনাকে গুলি করব। পশ্চিমাদের হাতে গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাঙালির হাতে গুলি খেয়ে মরে অনেক শান্তি পাবেন।’ অতিশয় আতঙ্কিত ও উত্তেজিত ক্যাপ্টেন অলি এ কথা বলেই জিপের সামনের সিটে বসে পড়েন। এবার অনুরোধ নয়। আদেশের সুরে বললেন, ‘গাড়ি ঘুরান।’ মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কথামত গাড়ি ঘুরিয়ে নেন। তারপর তারা শহরের মধ্যে এসে কালুরঘাট ও চট্টগ্রামের রাস্তার এক পাশে একটি গাছের নিচে বসে পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন।’ কর্নেল অলির দেওয়া এক সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, জিয়াউর রহমান ২৬ তারিখে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরেও সোয়াত জাহাজ অভিমুখে যাত্রাকালে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন, জিয়া সেগুলো সরিয়ে দিয়েছিলেন। এ থেকে পরিষ্কার যে, জিয়া সোয়াত অভিমুখে যাত্রাকালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের হত্যা করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর লেখা থেকে জানা যায় যে জিয়া প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাঠ করতে পুরোপুরি অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু পরে সবার চাপে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র মারফত বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য পাঠ করতে।

বঙ্গবন্ধু যে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তার অগণিত প্রমাণের অন্যতমটি পাওয়া যায় সিদ্দিক সালিক নামক এক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তার লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ পুস্তকের ৭৫ পৃষ্ঠায় তার লেখনী থেকে। তিনি লিখেছেন- “When the first shot had been fired the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wave length close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the Peoples Republic of Bangladesh” সিদ্দিক সালিকের ভাষায় শেখ মুজিব আরও বলেছিলেন, “This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the Pakistani occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved. ”

সিদ্দিক সালিকের লেখা সংক্ষেপে বাংলায় তরজমা করলে যা দাঁড়ায় তা নিম্নরূপ : “প্রথম গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর, যেটি ভেসে এসেছিল রেডিও পাকিস্তানের কাছাকাছি একটি বেতার তরঙ্গ মারফত। শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর খুব ক্ষীণ ছিল, মনে হচ্ছিল তার এই বাণী আগেই রেকর্ড করা হয়েছে। এই বাণী মারফত শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।” শেখ মুজিব বলেছিলেন, “এটিই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমি দেশের সকল মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের হাতে যা কিছুই থাক তা দিয়ে পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের প্রতিহত করুন। যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ পাকিস্তানি সৈন্যকে উৎখাত করা না হয়, এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততক্ষণ আপনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যান।”

ডেভিড লোশাক নামক এক বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক তার লেখা পুস্তক ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’-এর ৯৮/৯৯ পৃষ্ঠায় ওয়্যারলেস মারফত প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া পাকিস্তানের ডন পত্রিকা, ভারতের অমৃতবাজার এবং সিঙ্গাপুরের ‘স্ট্রেইট টাইমস’-সহ বহু বিদেশি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার কথার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৮১ সালে কলকাতা অবস্থানকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার লেখা বইতে উল্লেখ করেছেন যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চিটাগাংয়ে অবস্থানরত বহুজন ওয়্যারলেস প্রক্রিয়ায় রিলে করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিক বীরউত্তমও তার বইয়ে একই কথা লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য যে, সিদ্দিক সালিক ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক গণসংযোগ কর্মকর্তা যাকে ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর যাকে অন্যান্য পাকিস্তানি সৈন্যদের মতো যুদ্ধবন্দি হিসেবে বন্দি করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে তিনি সে সময়ের পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গেই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার ব্যাপারে তার বিকৃত তথ্য দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। শেষ বার্তায় বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেটি অনুসরণ করেই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে তার মাধ্যমে প্রথম সরকার গঠন করেছিলেন ১৭ এপ্রিল, যাতে রাষ্ট্রপতির পদে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন (শহীদ) সৈয়দ নজরুল ইসলাম। উক্ত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন (শহীদ) তাজউদ্দীন আহমদ।

১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ‘আনোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এটিকে সংবিধানের জেনেসিস বা আদি সূত্র বলে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মামলায় মূল প্রশ্নটি ছিল সংবিধান পরিবর্তনে জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদের সীমাবদ্ধতার কথা। উল্লেখ্য যে, জেনেসিস শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় আইনবিশারদ সুব্রত রায় চৌধুরী ‘দি জেনেসিস অব বাংলাদেশ’ নামক তার বইতে, এটি প্রমাণের জন্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় মোটেও আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ হয়নি। পরবর্তীকালে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট তাদের প্রকাশিত ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে সুব্রত চৌধুরীর মতবাদকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল।

১৭ এপ্রিল সে সময়ের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের এবং সে ঘোষণাপত্রের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন প্রমাণ করেছিল বাংলাদেশ কোনোক্রমেই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি। তখন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী এই বলে প্রচারণা চালাচ্ছিল যে, বঙ্গবন্ধু একক ঘোষণার মাধ্যমে সেটিই করেছে যে রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বায়াফ্রা করেছিল আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ করে; কিন্তু বাস্তবতা ছিল এই যে পূর্ব বাংলার গোটা জনসংখ্যার নিরঙ্কুশ নেতা হিসেবে এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনপুষ্ট হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার সর্বময় অধিকার তার ছিল আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেই। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ মোটেও গৃহযুদ্ধ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা এবং পরবর্তীতে ১০/১৭ এপ্রিলের ঘোষণাপত্র থেকে এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সংবিধান হলো, আইনের ভাষায় যাকে ‘autochthonous’ বলা হয়, যাকে বাংলায় ‘ভূমিপুত্র’ সংবিধান বলা যেতে পারে। এ ধরনের ভূমিপুত্র সংবিধানের দৃষ্টান্ত আর কোথায়ও নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার ক্ষেত্র তৈরি করলেও সবশেষে প্যারিস নগরীতে ১৭৮৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং তার সংবিধান কোনো বহুজাতিক চুক্তির ফল ছিল না, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট পেয়েই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ একত্রিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে যে দলিলটি প্রণয়ন করেছিলেন, সেটিও বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই করেছিলেন, কোনো বাহ্যিক হস্তক্ষেপ বা মধ্যস্থতা ছাড়া। আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলায় উক্ত ঘোষণাপত্রকে অন্তত যৌক্তিকভাবেই ‘জেনেসিস’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন এ কারণে যে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রভিশনাল সংবিধান অর্ডার জারি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত ঘোষণাপত্রই ছিল বস্তুত বাংলাদেশের সংবিধান যা অনুসরণ করে উল্লিখিত সময় পর্যন্ত দেশ শাসিত হতো। ১৯৭২ সালে আমাদের সংবিধান প্রণয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। যে চারটি চেতনা, যথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কথা, তার সূত্রও ঘোষণাপত্রের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় সেই অধ্যায়ে যেখানে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে।” এ তিনটি বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে চারটি চেতনাই এই তিনে প্রতিফলিত। যারা বলে এতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না, তারা ইচ্ছা করেই এর অপব্যাখ্যা করছেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ছাড়া অচিন্তনীয়।

আমাদের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার জয়যাত্রায়, উক্ত ঘোষণাপত্রের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলো, এর পরিধি এবং গুরুত্ব বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে এ ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা, যা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসরণ করেই নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ প্রণয়ন করেছিলেন তা নতুন করে জানার প্রয়োজন না থাকলেও একে আমাদের প্রতিদিনই মনে ধারণ করতে হবে। এক কথায় এ ঘোষণাপত্রের পবিত্রতা অবশ্যই সব সময় রক্ষা করতে হবে।





লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews