‘থ্রি অন এ বেড’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

(প্রিয়.কম) গত সাত আট বছরের মধ্যে কলকাতা বাংলা সিনেমায় ঘটে গেছে বিশাল পালাবদল। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বদলেছে দর্শকের চাহিদা, ইমেজ আর দেখার চোখও! দর্শকশ্রেণির চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে মেইনস্ট্রিম আর আর্টফর্মের মিশেলে সেখানে তৈরি হয়েছে মিডল রোড বা মধ্যপন্থার এক নিজস্ব ধারার সিনেমা। সিনেমার গল্পের ধরণও পাল্টে গেছে আমূল, নাগরিক জীবনের নানা প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, প্রেম বিরহ আর অবদমনের গল্পগুলো হয় সিনেমার বিষয়। যে সিনেমাগুলো বেশীরভাগ সময়ই যৌনতার আবরণে মোড়ানো থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতার সিনেমায় মূল ধারা আর আর্ট ফর্মের মিশেলে যে ধারার সূচনা হয়েছে, তার অগ্রপথিক ধরা হয় অঞ্জন দত্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো মেধাবী নির্মাতাদের। নিউ এজ বাংলা সিনেমার প্রবর্তকও বলা হয় তাদের। যৌনতাকে শৈল্পিকভাবে কিভাবে উপস্থাপন করা যায়, এবং তা মেইনস্ট্রিম আর আর্টফর্মের সমন্বয়ের ভিতর দিয়ে চর্চা করা যায় তা ভীষণরকমভাবে পর্দায় তুলে ধরে দেখিয়েছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রায় ছবিতেই তিনি বিচিত্র সম্পর্কের গল্প বলে গেছেন।

চোখের বালি, নৌকাডুবি, অন্তরমহলের মতোন সিনেমায় ঋতুপর্ণের ছবিতে পরকিয়া সম্পর্কগুলোর রগরগে দৃশ্যায়ন আমরা দেখেছি, তার ছবিতে দুই পুরুষের সমকামিতা এবং লিঙ্গান্তর বা রূপান্তরিত নারী পুরুষের গল্প দেখিছি। অঞ্জন দত্ত তার সিনেমার ভিতর দিয়ে দেখিয়েছেন সমাজে সম্পর্কের রকমফের। তাদের পরবর্তী সময়ে প্রায় সব ছবি নির্মাতাদের মধ্যে এই বিষয়টি ছড়িয়ে যায়, সৃজিত মূখার্জী থেকে শুরু করে তরুণ নির্মাতা ‘কিউ কৌশিক’ পর্যন্ত সকলের ছবিতে রগরগে যৌনতার উপস্থাপন ভীষণরকম উপস্থিত।

‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ ছবিতে সমকামি পাওলি ও স্বত্বিকা

ব্যবসায়িকভাবেও শতভাগ সফল এই মিডলরোড সিনেমাগুলো। ফলে আর্টফর্মের সিনেমার উপর এতোদিন যে অপবাদ ছিলো যে, এগুলো মানুষ দেখে না, থিয়েটারে মুখ থুবরে পড়ে সিনেমাগুলো; সেই অপবাদ ঘুচিয়েছে মিডলরোড বা মধ্যপন্থার সিনেমাগুলোর উদ্ভাবনের ফলে। তবে পশ্চিম বাংলার সিনেমা বিজ্ঞজনরা সিনেমার এই নব ধারাকে ‘মিডলরোড’ বা ‘মধ্যপন্থা’ যে নামেই অবিহিত করুক না কেনো, সেসব ছবিগুলোর বিরাট অংশজুড়ে থাকে যৌনতার ছড়াছড়ি। এটা ইনটেনশনালি করা হয়। দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখেই একটা ভালো গল্পের মধ্যেও আচমকা ঢুকে পড়ে যৌন সুড়সুড়ি। এটাকে বলা যায় কলকাতা বাংলা সিনেমায় এক ধরণের কৌশল; আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পেতেই এমনটি করা হয়। নাগরিক জীবনের গল্প বলার প্রেক্ষিতে ছবিগুলোতে সমকামিতা, পরকিয়া আর অবৈধ সম্পর্কগুলোর খুব রগরগে দৃশ্যায়ন থাকে মধ্যপন্থি প্রায় ছবিগুলোতেই।

কলকাতার নির্মাতা থেকে অভিনয় শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গিও এখন যথার্থ পরিবর্তিত। হর হামেশায় কোনো সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করতে তারা রাজি হয়ে যাচ্ছেন। কলকাতার মেইনস্ট্রিম সিনেমাতেও এতো সাহসী ভূমিকায় কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের দেখা যায় না। কলকাতা বাংলার শৈল্পিক সিনেমার পরতে পরতে যৌনতা দিয়ে মোড়ানো, তা বলা কোনোভাবেই যে দুঃসাহসী কিছু নয়, তা কয়েকটি ছবির আলোচনাতেই স্পষ্ট হবে।

‘কসমিক সেক্স’ সিনেমার দৃশ্য

কলকাতা বাংলার তরুণ প্রতিভাশালী নির্মাতা কৌশিক, যিনি কিউ নামেই পরিচিত। ‘গান্ডু’ নির্মাণ করেই কলকাতা বাংলা সিনেমায় বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন।গান্ডু আগাগোড়া একটা ‘এক্স’ রেটেড একটি সিনেমা। কলকাতার মতো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন দুর্দান্ত সাহসী কাজ তার আগে কেউ করার সাহস করেনি। যদিও ‘গান্ডু’ শেষ পর্যন্ত অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

২০১৫ সালে অনলাইনে মুক্তি পেলো ২০১২ সালে বানানো অমিতাভ চক্রবর্তীর ছবি ‘কসমিক সেক্স’। যা কলকাতা ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের নানা প্রতিবন্ধকতার পর অভিনব পদ্ধতিতে গত ১ ফেব্রুয়ারি ইন্টারনেটে পৃথিবী ব্যাপী মুক্তি দেয়া হয়। সিনেমা হলে মুক্তির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অমিত চক্রবর্তী অবশেষে এই অভিনব পদ্ধতিতে সিনেমা মুক্তি দিলেন।

‘কসমিক সেক্স’ কলকাতা বাংলার সিনেমা ইতিহাসে অন্যতম একটি বিতর্কিত ছবি হয়েই থাকবে।কারণ এটি প্রথম কোনো বাংলা ছবি, যা সেন্সরবোর্ডের অনুমতি না পেয়ে ইন্টারনেটে মুক্তি দেয়া হয়। ছবিটি বাউল ফকিরদের জীবন দর্শন নিয়ে নির্মিত। বাউলদের ‘কাম’-ই সিনেমার উপজীব্য বস্তু, পরমাত্মাকে স্পর্শ করতে জাগতিক কাম-কে বশে আনার কাহিনীই বলা যায় ‘কসমিক সেক্স’।কিন্তু সিনেমায় এতো সরাসরি বিষয়গুলো নির্মাতা ডিল করেছেন যে, তা হয়তো সিমো হলে প্রচারের যোগ্য মনে করেননি কলকাতার সেন্সর বোর্ড। গান্ডুর পর সিনেমাটিতে ঋ সেন ফের তার সাহসের ভয়ঙ্কর রূপ দেখিয়েছেন। আপাদমস্তক নগ্ন হতে এর আগে কলকাতা কেনো, পুরো ভারত বর্ষের সিনেমায় অনুপস্থিত ছিলো।

কলকাতা বাংলা সিনেমায় ‘থ্রি অন আ বেড’ যুগান্তকারি এক প্রয়াস; কি গল্পে, আর কি চিত্রায়নে। ছবিটি প্রযোজনা করেছে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট। রাজদীপ পাল এবং শর্মিষ্ঠা মাইতির দুর্দান্ত সাহসী ছবি ‘থ্রি অন আ বেড’।এক নারী ও দুই পুরুষের একত্রে বাস করার কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই ছবি। তিন জনের সহবাস আর যাপনকে সমাজ কি চোখে দেখে তার মোটামুটি একটা সফল চিত্রায়ন। গল্পের প্রয়োজনেই প্রচুর খোলামেলা আর ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের ফুলঝুড়ি ঘটে ছবিতে।

স্বত্বিকা মূখার্জীর ‘টেক ওয়ান’

কলকাতা বাংলা সিনেমায় আরেক সাহসী নির্মাতা মৈনাক ভৌমিক। গত বছর তিনি তিনি নির্মাণ করেছেন কলকাতা বাংলার টপ রেডেট অভিনেত্রী স্বস্তিকা মূখার্জীকে নিয়ে 'টেক ওয়ান'। ছবিতে একেবারে খোলামেলা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন স্বস্তিকা। গত বছর কলকাতায় স্বস্তিকার ‘টেকওয়ান’-এ বিবসনা দৃশ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদেরও ক্ষোভের মুখে পড়েছিল পুরো ‘টেকওয়ান’ টিম।

মৈনাক ভৌমিক পরিচালিত এ সিনেমাতে স্বস্তিকা প্রায় বিবসনা হয়ে ক্যামেরাবন্দি হয়েছিলেন স্বস্তিকা। এতে জনৈ মডেলের সঙ্গে স্বস্তিকার একাধিক আবেগঘন দৃশ্য রয়েছে। তবে সেন্সরে কর্তনের ভয়ে সিনেমাতে স্বস্তিকার বিবসনা দৃশ্যগুলো কিছুটা অস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু বাইরের চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে সিনেমাটির দৃশ্যগুলো স্বাভাবিক রেখেই পাঠানো হয়েছে।

যৌনতায় রিষ্টপুষ্ট মৈনাকের আরেক চলচ্চিত্র ‘আমি আর আমার গার্ল ফ্রেন্ড’। ২০১৩ মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। এটি রচনা, চিত্রনাট্যরচনা এবং পরিচালনা করেছেন মৈনাক ভৌমিক নিজেই। অভিনয়ে ছিলেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পার্ণো মিত্র, রাইমা সেন, বিক্রম চ্যাটার্জি, বিশ্বনাথ বসু, নীল মুখার্জি, অনুবর্ত বসু প্রমুখ। তিনজন বাঙালি মেয়ের বন্ধুত্ব এবং তাদের নিজস্ব জগতের মধ্যে এই চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। মুক্তির পর যথারীতি ব্যাপক আলোচিত হয় সিনেমাটি।

বহুল বিতর্কিত ‘গাণ্ডু’ সিনেমা দৃশ্য

ঋতুপর্ণ ঘোষ সমকামী পুরুষের গল্প, রূপান্তরকামীর গল্প বলে গিয়েছেন। কিন্তু সমকামী নারীর গল্প ককাতা বাংলা ছবিতে সে রকম উঠে আসতে দেখা বাকি ছিল। মৈনাক ভৌমিকের ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে চাইছে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে স্বস্তিকা আর পাওলি অভিনীত দুই নারীর সমকামিতার গল্প নিয়ে ছবি ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’। মুক্তির পর থেকেই কলকাতায় এই ছবি নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। ছবিটিতে সমকামি নারীর চরিত্রে জনপ্রিয় আলোচিত অভিনেত্রী স্বস্তিকা মূখার্জী ও পাওলি দাম অভিনয় করে যেনো সেই আলোচনা আরো উস্কে দিচ্ছে। সমালোচকদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত এখন পরিচালক। যদিও নির্মাতা মৈনাক তীব্র সমালোচনার মুখে ‘ফ্যামিলি অ্যালবাম’ ছবিটিকে মিষ্টি প্রেমের ছবি বলে উল্লেখ করেছেন।

‘আমি আর আমার গার্ল ফ্রেন্ড’ এর দৃশ্য

এছাড়াও কলকাতা বাংলা সিনেমায় এ সময়ে যারা মূল ধারার বাইরে গিয়ে ছবি নির্মাণ করছেন, তাদের প্রায় সব ছবিতেই থাকে যৌনতার প্রবল সুড়সুড়ি। গৌতম ঘোষ কিংবা এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নির্মাতা সৃজিত মূখার্জীও এর বাইরে নয়।তার সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘নির্বাক’ও তো একজন নিঃসঙ্গ অবদমিত পুরুষের গল্প দেখাতে গিয়ে যৌনতার আশ্রয় নিয়েছেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews