দৃশ্য-১. ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ ছবিতে একপশলা বর্ষণ হয়ে এসেছিলেন ফেরদৌস। নতুন শতাব্দীর সেই প্রিয় মুখ রাতের আঁধারে পালিয়ে গেলেন।
দৃশ্য-২. নুসরাত ফারিয়ার মাথায় হেলমেট। শরীরে রক্ষাকবচ। শুধু ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখা যায় তার। প্রায় একশ পুলিশ তাকে ঘিরে আছে আদালতের উঠানে।
দৃশ্য-৩. মামুনুর রশীদ বক্তৃতা করছেন শিল্পকলার সামনে। হঠাৎ তার দিকে ছুড়ে দিলো ডিম। ঢাল হয়ে তাকে রক্ষা করলেন সহযোদ্ধারা।
দৃশ্য-৪. চট্টগ্রামে দোকান উদ্বোধন করতে গেছেন মেহজাবীন চৌধুরী। অনুষ্ঠানের আগে ৫০-৬০ জন লোক জড়ো হয়ে গেল। দোকানে না গিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন অভিনেত্রী।
দৃশ্য-৫. টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলা। একটি কমিউনিটি সেন্টারে ভাড়ায় চলছিল শাকিব খানের ‘তাণ্ডব’ ছবিটি। আলেম-ওলামারা এসে মিছিল করলেন—ছবি চলবে না। বন্ধ হয়ে গেল প্রদর্শনী।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা একটি অপরটি থেকে আলাদা। কিন্তু এই খণ্ড চিত্রগুলো একসঙ্গে জুড়লে একটা বড় ক্যানভাস পাওয়া যায়। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কেমন আছেন দেশের বিনোদন মাধ্যমের মানুষেরা, তার একটা ছবি ফুটে ওঠে ওপরের ঘটনাগুলো এক জায়গায় জড়ো করলে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকার অনেক স্বপ্নের কথা বলেছে, পরিবর্তনের কথা বলেছে। কিন্তু নাটক-সিনেমা-থিয়েটার চলছে আগের লাঙলের পিছু ধরেই। হাল ধরার কাউকে দেখা যাচ্ছে না দৃশ্যপটে। গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। পুঁজির প্রবাহ কমে গেছে। শীর্ণ হয়ে গেছে সংস্কৃতির ধারাগুলো। নাটকে কাজ কমে গেছে, জমজমাট ভাব নেই। সিনেমার উৎপাদন কম। দুই ঈদ ছাড়া সারাবছর উৎসবের আমেজ নেই। থিয়েটারে প্রাণচাঞ্চল্য নেই। মঞ্চে উঠে নাট্যকর্মীর বুক কাঁপছে মবের ভয়ে। বিদেশি শিল্পীদের তোয়াজের জায়গায় ভারতের বদলে এখন পাকিস্তান। ভিনদেশি টেকনিশিয়ানদেরই এখনও কদর বেশি। বেতার-বিটিভির স্বায়ত্তশাসন অধরা। যথারীতি সেখানে সরকারের গুণকীর্তন চলে। হঠাৎ করে কিছু শিল্পী সেখানে ছেয়ে গেছেন বঞ্চিত পরিচয়ে। মান নয়, দক্ষতা নয়, বঞ্চিতই সেখানে শেষ পরিচয়। সরকারি দফতরের বাইরেও সিন্ডিকেট। ওটিটিতে সিন্ডিকেট ঘুণপোকার মতো খেয়ে সাবাড় করছে সব। শোনা যাচ্ছে, বড় প্ল্যাটফর্মগুলো তল্পিতল্পা নিয়ে পালাবে শিগগিরই। মেধাহীনতার মহোৎসবে প্রাণ পাচ্ছে না গান। নাটকে উঠে আসছে না জীবন। সিনেমা হয়ে যাচ্ছে বিদেশি ছবির কপি-পেস্ট। এই হচ্ছে বর্তমান সরকার কিংবা বিপ্লব বিজয়ের বারো মাস।
মামলার মহোৎসব
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় মামলা হতে দেখা গেছে। এরকম অন্তত তিনটি মামলায় ২৯ জন শিল্পীকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, কামরুন নাহার শাহনূর, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, তানভীন সুইটি, কৌশিক হোসেন তাপস, মেহের আফরোজ শাওন, জাকিয়া মুন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুবর্ণা মুস্তাফা, আশনা হাবিব ভাবনা, রোকেয়া প্রাচী, তারিন জাহান, অরুণা বিশ্বাস, মমতাজ, শামীমা তুষ্টি, শমী কায়সার, সাজু খাদেম, সোহানা সাবা, জায়েদ খান, ফেরদৌস, রিয়াজ, চঞ্চল চৌধুরী, আজিজুল হাকিম, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান ও ইরেশ যাকের।
২ মামলার আসামি হিসেবে নাম রয়েছে রোকেয়া প্রাচী, মেহের আফরোজ শাওন, জায়েদ খান, আশনা হাবিব ভাবনা ও জ্যোতিকা জ্যোতির।
ইরেশ যাকেরকে মাহফুজ আলম শ্রাবণ হত্যা মামলায় ১৫৭ নাম্বার এজাহারনামীয় আসামি করা হয়। ১৪ জন শিল্পীর বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা এমদাদ হত্যাচেষ্টা মামলাকে আদালত আমলে নিয়ে শাহবাগ থানাকে এজাহার গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এই রকম ঢালাওভাবে তারকাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সাংস্কৃতিক মহলে। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরাও এই সমস্ত মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারকাদেরকে বেকায়দায় ফেলে হয়রানি করার চেষ্টা নিন্দিত হয়।
তারকাদের এই ভাবমূর্তির অবক্ষয় দীর্ঘমেয়াদে শোবিজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বিদায় বাংলাদেশ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে শিল্পীরা নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। কেউ নির্বাচনে দলীয় প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। কেউ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন। কেউ সরাসরি নির্বাচনের খায়েশে দলীয় কার্যক্রমে সরব হয়েছেন। আবার অনেকে বিনোদন জগতে সরকারের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছেন, সমিতি-সংগঠনের মাধ্যমে খবরদারি করেছেন শিল্পীদের ওপর। এই শিল্পীদের অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশে থাকতে নিরাপদ বোধ করেননি। কাজের চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তারা পেশাদারত্বও খুইয়েছেন। তাদের পক্ষে দেশে জীবিকা নির্বাহও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তাদের শিল্পী পরিচয় প্রায় মুছে যেতে বসেছিল। ফলে তারা বিদেশে পাড়ি দেয়াকেই জীবন-জীবিকার জন্য নিরাপদ ভেবেছেন। এদের মধ্যে একজন জায়েদ খান। শিল্পী সমিতিতে নেতৃত্বের নামে রং-তামাশা, আদালতে দৌড়াদৌড়ি, তালা ভাঙাভাঙি, যত্রতত্র ডিগবাজি দিয়ে বেড়ানো এই অভিনেতা সরকার পতনের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই হাওয়া হয়ে যান। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে, যথারীতি ডিগবাজি বিক্রি করে চলেছেন। তারই সহযোগী অভিনেতা সাইমন সাদিকও ৫ আগস্টের পরে কিছুদিন দেশে অবস্থান করেন, মওকা বুঝে তিনিও পাড়ি দেন সাত সমুদ্র। রাকিবের সঙ্গে তালাক হয়ে গেলেও সাবেক স্বামীর সূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর রাজশাহী থেকে বিগত নির্বাচনে এমপি হতে চেয়েছিলেন মাহিয়া মাহি। সরকার পড়ে যাওয়ার পর তিনিও হতাশ হয়ে পড়েন। কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের মৃদু বিরোধিতা শেষে উঠে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রগামী বিমানে। একইভাবে সাজু খাদেম, চঞ্চল চৌধুরীর মতো অভিনেতারাও পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এমন আরও কয়েকজন শিল্পী নীরবে প্রস্থান করেছেন। আরও বেশ কয়েকজন লাগেজ গোছাচ্ছেন, অপেক্ষা করছেন সবুজ সংকেতের। প্রশাসন সদয় হলে তারাও দ্রুত কেটে পড়বেন। শেষ পর্যন্ত বিদেশে পাড়ি দেয়া শিল্পীর সংখ্যাটা যে চোখে পড়ার মতো হবে, তা আগাম বলে দেয়া যায়। 
এফডিসি এখনও...
এফডিসি এখনও আড্ডাখানা। পরিচালকরা আসেন তাদের সমিতিতে, খোশগল্প করেন। শিল্পীরা এসে সমিতিতে বসে গল্পগুজব করে ফিরে যান। পরিচালক ও শিল্পীরা যথারীতি বেকারত্বে ভুগছেন। অমুক শিল্পীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়ার মাহফিল। তমুক পরিচালকের জন্মদিন উপলক্ষে কেক কর্তন। এর বাইরে শিল্পী সমিতি ও পরিচালক সমিতির কোনও কাজ নেই। তবে অকাজ অনেকখানি কমেছে। আগে এফডিসি যেমন সর্বক্ষণ তাওয়ার মতো ফুটত, সেই ব্যাপারটা এখন নেই। তারপরও নিজেদের রেষারেষির ‘ঐতিহ্য’-কে কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে এফডিসির সমিতিসমূহ। পরিচালক সমিতির নির্বাচন কয়েক দফায় পেছানো হয়েছে। কে কার দোসর ছিল, কে কাকে হাত করেছে, কে কার স্বার্থ উদ্ধারে নেমেছে, এই সমস্ত বিষয় সামনে আনায় নির্বাচন বানচাল হতে-হতে রক্ষা পেয়েছে। পরিচালক সমিতির নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব বুঝে নিলেও যথারীতি অকার্যকর প্রযোজক পরিবেশক সমিতি। বহু বছর ধরে সিনেমার ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ মামলার জালে পেঁচিয়ে অকার্যকর। সেই সমিতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও কার্যকর করা যায়নি। একে জাগিয়ে তোলারও কোনও চেষ্টা ছিল না। পুরনো নেতারা নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিলেন। নতুন কিছু মুখকে দেখা গেছে সমিতিকেন্দ্রিক রাজনীতির আঙিনায়। বিএনপিপন্থী শিল্পী-নির্মাতারা এখন কলার উঁচিয়ে হাঁটেন এফডিসিতে। কিছুদিন আগেও তারা একপ্রকার অপেক্ষায় ছিলেন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উঠানে। এখন তাদেরই দাপুটে উপস্থিতি। কিন্তু এই সমিতিকেন্দ্রিক তৎপরতা এফডিসিকে কোমা থেকে ওঠাতে পারেনি। আগে নেতৃত্ব যেভাবে ভোট-ভোট খেলায় ব্যস্ত ছিল, নতুন নেতৃত্বও আপন স্বার্থে ব্যস্ত। এফডিসিতে এখনও কাজকর্ম নেই। সিনেমার শুটিং-ডাবিং হয় না বললেই চলে। এফডিসির সার্ভিসের উচ্চমূল্যের কারণে নির্মাতারা এখানে কাজ করতে চরম অনাগ্রহী। কখনও যদি এফডিসি সমিতিগুলোর কাছ থেকে ভাড়া চায়, তখন হয়তো ঝর্ণা স্পটের ব্যাঙগুলোকে ছাড়া আর কারও ছায়া দেখা যাবে না সরকারের এই সিনেমা কারখানায়।
সিনেমাকে সামলাবে কে
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতা নেয় তখন দেশে সিনেমা হল ছিল আটশ’র বেশি। ক্ষমতা থেকে যাওয়ার সময় একশ’র মতো সিনেমা হল রেখে যেতে পেরেছে। কিন্তু সেগুলোও ছবি চালানোর উপযুক্ত নয়, বেশিরভাগই সারাবছর বন্ধ থাকে, শুধু দুই ঈদে খোলে। বছরভর খোলা থাকে এমন সিনেমা হলের সংখ্যা পঞ্চাশের ওপরে নয়। এগুলোর মধ্যে ঠিকঠাক পরিবেশ ও আধুনিক প্রযুক্তি আছে ২০-২৫টি সিনেমা হলে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন সিনেমা হল নির্মাণের খবর পাওয়া যায়নি। উল্টো কিছু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই প্রেক্ষাগৃহগুলোতে বড় ধাক্কা লাগে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ছবি ঘরগুলো প্রায় শূন্য হয়ে যায়। তখন সিনেমা হলের খোরাক যোগাতে কয়েকজন প্রযোজক অত্যন্ত নিম্নমানের ছবি মুক্তি দিতে থাকেন। ওটিটির জন্য তৈরি কন্টেন্টকে ছবি বলে চালিয়ে দেয় হয়। এই সমস্ত ছবি দর্শককে প্রেক্ষাগৃহ টেনে আনার বদলে উল্টো হলবিমুখ করে। এই অবস্থাটা চলেছে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত। সেই ঈদে যথারীতি শাকিব খানের ছবি দেখতে সিনেমা হলে দর্শক ভিড় করে। ঈদুল আজহাতেও একই চিত্র। কিন্তু এই দুই ঈদ ছাড়া সিনেমা হলের ছাদে কাকপক্ষীও বসেনি। ঈদের বাইরে প্রদর্শকরা ভুগেছেন ছবি সংকটে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে হিন্দি ছবির আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রদর্শকরা সিনেমা হল বন্ধ করারও হুমকি দেন। সারাবছর তাদের মাছি মারা ছাড়া কিছু করার থাকে না। দর্শকশূন্যতায় ছবি ঘরগুলো খাঁ খাঁ করতে থাকে। এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনও চেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। তারা উত্তরাধিকারসূত্রে যে সমস্যাগুলো পেয়েছেন, সেগুলোতে আরও জল-সার ঢেলে তাজা করেছেন মাত্র। বন্ধ সিনেমা হল চালু কিংবা নতুন সিনেমা হল তৈরির জন্য কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি সরকারের। চলতি বছর স্টার সিনেপ্লেক্সের একটি নতুন শাখা চালু হয়েছে উত্তরায়। আরও দুয়েকটি শাখা চালু হবে এক বছরের মধ্যে। এগুলোর কাজ শুরু হয়েছে বিগত সরকারের সময়েই। আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ বা মাল্টিপ্লেক্স তৈরির জন্য কোনও রকম পরিকল্পনা এই এক বছরে দেখা যায়নি। ভারতীয় ছবি আমদানির বিকল্প কী হতে পারে সেটারও দিকনির্দেশনা আসেনি সরকারের তরফ থেকে। প্রযোজকরা আগের মতোই সিনেমায় পুঁজি বিনিয়োগে অনাগ্রহী। বিদেশ থেকে ‘আলি’র মতো ছবি সুসংবাদ নিয়ে নিয়ে আসছে বটে, কিন্তু সরকার কি নির্মাতাদের পিঠে হাত বোলাতে পারছে? ভিন্ন ধারার ছবি বা জীবনঘনিষ্ঠ ছবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য চার দশকেরও বেশি সময় আগে চলচ্চিত্রে অনুদান দেয়া শুরু করেছিল সরকার। সেই অনুদানপ্রথা দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির জালে আটকে ব্যর্থ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে অনুদানপ্রথাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে পুরনো বন্দোবস্তের পথেই হেঁটেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই বছর প্রায় ২০ কোটি টাকার অনুদান দেয়া হয়েছে। অনুদান পেয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠরা। শুধু তাই নয়, নজীরবিহীনভাবে যারা অনুদানসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কমিটিতে ছিল তারাই ঘুরেফিরে অনুদান পেয়েছে। এই কমিটিগুলো নিয়েও আছে প্রশ্ন। অনভিজ্ঞ লোকজন দিয়ে চলচ্চিত্রের কমিটিগুলো করা হয়েছে। তারা চলচ্চিত্রকে খাদ থেকে তোলার বদলে খাদের আরও গভীরে ফেলার চেষ্টা করছেন। কেবল একটা দিকেই সরকারের হর্তাকর্তাদের নজর দেখা গেছে, আর তা হচ্ছে প্রচারণামূলক ছবি। জুলাই আন্দোলনের ওপরে অগণিত প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে। সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে সরকার। সরকারি এসব কাজ পাচ্ছে মুখচেনা ব্যক্তিরাই। ফলে বিনোদনপাড়ার একটা অংশের গোয়ালে সরকারবদলের ফসল উঠলেও বাকিদের হাতে লবডঙ্কা। 
নাজেহাল নাটক
গত এক বছরে নাটকের নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি, বরং অধঃপতন হয়েছে। নাটক বেশ কয়েক বছর ধরেই ইউটিউবনির্ভর। সেই সঙ্গে ফেসবুকে নাটকের ক্লিপ চালিয়ে বাইরে থেকে আসে ডলার। কিন্তু এই দুটি প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় কমে আসায় এর প্রভাব পড়েছে নাটক ইন্ডাস্ট্রিতে। নাটকের প্রযোজকদের দ্বিতীয় আয়ের উৎস ছিল স্পন্সর। এই জায়গায় বিরাট আঘাত পড়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে স্পন্সররা হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করে। স্পন্সরের অভাবে নাটকের বাজেট কমতে থাকে, কমতে থাকে নির্মাণের সংখ্যাও। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আগের মতোই নাটকের বাজেট সংকুচিত রেখেছে। ফলে টিভি চ্যানেলগুলো এখনও প্রযোজকদের ভরসার জায়গায় আসতে পারেনি। উল্টো চ্যানেলগুলোই ফেসবুক-ইউটিউবের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্পন্সর সংকটে তাদের মুনাফায়ও টান পড়েছে। তাদের নিউজ থেকে আয় থাকলেও নাটক করিয়েদের কোনও বিকল্প নেই। তীর্থের কাকের মতো তারা পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছেন। নাটকে নতুন পুঁজি ঢুকবে, এই আশায় তারা দাওয়ায় বসে আকাশ দেখছেন। কিন্তু আকাশে মেঘের দেখা নেই। খটখটে রোদ্দুরে চারদিক ফকফকা। শুটিংস্পটে প্রতিদিনই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনে হয়ে উঠছে না মুখর। তারকারা ঘরে অলস বসে থাকছেন অনেকদিন। টেকনিশিয়ানরা রোজ ডাক পাচ্ছেন না কাজের। নির্মাতারা ইউনিট নিয়ে প্রায়ই বসে থাকছেন। এই অবস্থা অনেক মাসের। গেল দুটি ঈদেও আগের মতো উত্তাপ ছিল না। এজন্য প্রায় সকলেই দায়ী করছেন পয়সার টানাটানিকে। পুঁজির প্রবাহ সরু হয়ে এসেছে। আর তাই নাটক ইন্ডাস্ট্রি রুগ্ণ থেকে রুগ্ণ হতে চলেছে।
সংগীতে সংঘাত
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে দু দিক থেকে আঘাত এসেছে। আর দুটো আঘাতই অর্থনৈতিক। একদিকে ইউটিউবে স্পন্সর সংকট তৈরি হয়েছে, ফলে নতুন গান তৈরি ব্যাহত হয়েছে; আরেকদিকে দেশে কনসার্ট কিংবা গানের শোয়ের সংখ্যা কমে গেছে। গত শীত মৌসুমে যে পরিমাণ কনসার্ট হওয়ার কথা তার ধারে-কাছেও হয়নি। নতুন দিনের নতুন সময়কে যেভাবে গানে-গানে বরণ করে নেয়ার কথা ছিল, তেমনটা কিন্তু হয়নি। গেল বসন্তে অন্তত সুরের ভুবনে কোকিল ডেকে ওঠেনি। তবে বিদেশে আগের মতোই কনসার্ট হয়েছে। এখনও প্রবাসীরা যথেষ্ট ইভেন্ট করছেন। সেখানে পয়সাপাতির টান নেই। দেশের মাটিতে হয়ে গেছে ঝামেলা। সরকারপতনের পর পয়সায় টান পড়েছে পুঁজিপতিদের। গানবাজনার পেছনে তারা আর পয়সা ঢালতে পারছেন না আগের মতো। এমনিতেই গোটা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ইউটিউবের ওপর নির্ভরশীল। সেখানকার আয়ে টান পড়লে মিউজিক কোম্পানির মালিকরা কুচকে যান, হাত গুটিয়ে বসে পড়েন। অন্যদিকে দেশের সংগীত জগতের একজন বড় প্রযোজকের উইকেট পড়ে যাওয়ায় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির খেলাধুলাই এলোমেলো হয়ে গেছে। গত বছরের শেষের দিকে গ্রেফতার হন গানবাংলার মালিক সংগীতশিল্পী কৌশিক হোসেন তাপস। তিনি দেশের সংগীতশিল্পীদের একটা বড় অংশের অভিভাবক ছিলেন। তার ছত্রছায়ায় ছিলেন তরুণ শিল্পীদের একাংশ। তার ইভেন্ট আয়োজন থেকে শিল্পীদের রোজগারপাতি হতো ভালোই। তাপস কারাগারে চলে যাওয়ায় হঠাৎ করে ভাটার টান লেগেছে মিউজিকপাড়ায়। তার শিবিরের শিল্পীরা আবার গুছিয়ে উঠছেন, কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতির চাপ সামলে না ওঠা পর্যন্ত শিল্পীরা চাপে থাকবেন বৈকি।

শিল্পকলায় ছলাকলা
মামুনুর রশীদের ওপর ডিম ছুড়ে মারা থেকে সৈয়দ জামিল আহমেদের পত্রপাঠ বিদায়—গত এক বছরে শিল্পকলা ছিল দেশের আলোচিত ‘চরিত্র’। ৫ আগস্টের পরপরই শিল্পকলায় চলে হুড়োহুড়ি। লিয়াকত আলী লাকী যুগের অবসান ঘটে। তার কোলে লালিত-পালিতরাও নতুন স্তন্যদায়ীর খোঁজে কেটে পড়েন। অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি পড়েন রোষানলে, খোয়ান চাকরি। নতুন পরিচালকরা আসেন। পরে তাদের দুয়েকজনকেও পদত্যাগ করতে দেখা যায়। কয়েক মাস ধরে শিল্পকলা একাডেমি মহাপরিচালকশূন্য। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। দায়িত্বে থাকাকালে তিনি মামুনুর রশীদকে মঞ্চে উঠতে বারণ করেন তৌহিদী জনতার দাবি মেনে। এই অদৃশ্য জনতা বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মীকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাটক বন্ধের বায়না ধরে। তখন থেকেই নাট্যজগতে টানাপড়েন। নাট্যকর্মীদের মধ্যে যে অস্বস্তির শুরু হয়, তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। আগের মতো আর জমজমাট নেই সেগুনবাগিচার শিল্পকলা। হাতে যখন মারা যায় না তখন ভাতে মারতে হয়। নাট্যকর্মীদের আত্মার খোরাক হচ্ছে নাটক। সেই নাটক তারা করতে পারছেন কি? শিল্পকলা একাডেমি নিজেই মিলনায়তন বরাদ্দ নিয়ে রাখছে। নাটকের দলগুলো মিলনায়তন পাচ্ছে না। নাটক করবে কোথায়? শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পর্ষদের সভা হয় না। একক জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত আসে। নাট্যকর্মীদের বেদনার কথা শুনবে কে? দেশজুড়েই থমথমে ভাব। নাটকে কি প্রাণ খুলে কথা বলা যাবে? ডিম ধেয়ে আসবে না তো?
পর্দায় পরিবর্তন
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে দৃশ্যমাধ্যমেও। ছোটপর্দা ও বড়পর্দা দুই কূলই দুলে উঠেছে ঢেউয়ের দোলায়। বিগত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-খুনের। জনপ্রিয় পরিচালক রায়হান রাফী এই দুটো অভিযোগকেই পর্দাবন্দী করেছেন দুটো আলাদা মাধ্যমে—একটি সিনেমা, আরেকটি ওটিটি। গেল ঈদে মুক্তি পাওয়া শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’ ছবির গল্পে দেখা গেছে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে বন্দীদেরকে নির্যাতন করা হয়, মেরে ফেলা হয়। রাষ্ট্রের মদদে, মাফিয়াগোষ্ঠীর বলি হচ্ছে তরুণরা, এমনটাই উঠে এসেছে ‘তাণ্ডব’ ছবিতে। তবে নিতান্তই বিনোদনের মোড়কে গুমের ঘটনার চিত্রায়ন হয়েছে বলে তেমন ধাক্কা লাগেনি রাজনৈতিক শিবিরে। একইভাবে রাফীর ওটিটি কন্টেন্ট ‘আমলনামা’ও হৈচৈ বাঁধিয়ে দিতে পারেনি। চরকিতে প্রকাশিত এই ওয়েব ফিল্মে উঠে আসে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কক্সবাজারের আলোচিত একরাম ক্রসফায়ারের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে এটি। বলা হচ্ছে, রাফী বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘অমীমাংসিত’ নামে একটি ছবিও নির্মাণ করেছেন, কিন্তু সেটা বিগত সরকারের আমলেই। ছবিটিকে আটকে দিয়েছিল তৎকালীন সেন্সর বোর্ড। সেন্সর বোর্ড থেকে সার্টিফিকেশন বোর্ডে রূপান্তরিত হওয়ার পর নতুন কমিটি রাফীর ছবিটিকে সনদপত্র দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সেন্সর বোর্ড আটকে রেখেছিল কামার আহমেদ সাইমনের ‘অন্যদিন’ ছবিটিকেও। নির্মাতা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। তার ছবিটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে। এই ছবিটি ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজেনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। ছবিটিকে আটকে রেখেছিল আগের সরকার। অনেক দেন-দরবার, সভা-সমাবেশ করেও ছবিটিকে ছাড়ানো যায়নি। একপর্যায়ে ছবিটি ভারতের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ দিয়ে দেয়া হয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হওয়ার পরও ছবিটি সনদপত্র পায়নি, মুক্তি পায়নি বাংলাদেশের সিনেমা হল কিংবা ওটিটিতে। এ নিয়ে উপদেষ্টাকে প্রায়ই কথা শুনতে হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যদিও সেসব তিনি কানে তোলেন বলেও মনে হয় না! অদ্ভুত!

লেখক: সাংবাদিক ও সমালোচক