তথ্য দিতে পারলে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার- হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণার পর বাংলাদেশের পলাতক জঙ্গি সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে 'মেজর জিয়া' ও আকরাম হোসেন ফের আলোচনায়। তারা দু'জনই লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। জিয়া ও আকরাম নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি) শীর্ষ নেতা। সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত জিয়া সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, জিয়া-আকরাম কোথায়? কেন ধরা পড়ছেন না?

অন্তত ৯ জন লেখক-ব্লগার হত্যায় জড়িত জিয়ার ব্যাপারে সর্বশেষ কী তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে- এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনটি কারণে তার অবস্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তা হলো- দীর্ঘদিন ধরেই সব ধরনের প্রযুক্তিগত যোগাযোগমাধ্যমের বাইরে থাকছেন জিয়া। এ ছাড়া চেহারায় এনেছেন পুরোপুরি নতুন এক বেশ। নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে ধারণা পাওয়া গেছে, পরিচিত ছবির চেহারায় জিয়া আর তেমনটি নেই। সর্বশেষ আড়াই বছর আগে সংগঠনের দু-এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর সঙ্গে জিয়ার সরাসরি যোগাযোগের কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও এর পর থেকে তার অবস্থান কোথায়- এমন স্পষ্ট ধারণা গোয়েন্দাদের হাতে নেই। এমন আভাসও আছে, এরই মধ্যে বিদেশে পালিয়েছেন জিয়া। গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

টানা ১০ বছরের বেশি উগ্রপন্থিদের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছেন এমন দু'জন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালের মার্চের পর থেকে জিয়াকে আনসার আল ইসলামের কোনো সদস্য দেখেছেন এমন সন্দেহাতীত তথ্য তাদের হাতে নেই। সর্বশেষ সাব্বির আহম্মেদসহ দুই জঙ্গির কাছ থেকে জিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য বের করা সম্ভব হয়। উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার সাব্বির ছিলেন সংগঠনটির দাওয়া বিভাগের সমন্বয়ক। তিনি পুলিশকে জানান, বাড্ডায় ২০১৯ সালে জিয়ার সঙ্গে সরাসরি তার সাক্ষাৎ হয়। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের সাংগঠনিক ব্যাপারে টুকটাক কথা হয়েছিল। এর আগে আরেক জঙ্গির সঙ্গে ওই বছরই উত্তরা এলাকায়  দেখা করেন জিয়া।

আরেক কর্মকর্তা জানান, একাধিক সহযোগী বিভিন্ন সময় জিয়ার ছদ্মবেশ সম্পর্কে নতুন একটি ধারণা দেন। তারা বলছেন, বর্তমানে তার টাক মাথা। আর চেহারায় ঔজ্জ্বল্য কমেছে। ২০১৬ সালে পুলিশ সদর দপ্তর জিয়ার তথ্য দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ওই সময় তার সম্ভাব্য সাত ধরনের ছবি প্রকাশ করা হয়। তবে ওই ছবির সঙ্গে পলাতক জিয়ার চেহারার এখন আর মিল নেই বলে জানিয়েছেন তার সহযোগীরা। পলাতক জীবনে কিছুদিন চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। এর পর থেকে জিয়া অন্তরালেই।
আরেকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ে নিজেদের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে সহযোগীদের উদ্দেশে জিয়া একটি বার্তা দেন। সেখানে তিনি বলেন, 'আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে দ্বীনি ভাইয়েরা রক্ত দিচ্ছে। আফগানিস্তানে বিজয়ের পতাকা ওঠা শুরু হয়েছে। জান্নাতের রাস্তার জন্য যারা লড়ছেন, তাদের রক্ত বৃথা যাবে না।' তবে এই বার্তা তিনি দেশে, নাকি বাইরে থেকে দিয়েছেন- এ সম্পর্কে কোনো পরিস্কার তথ্যও গোয়েন্দাদের কাছে নেই।

অপর এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সাংগঠনিক কাঠামোতে আনসার আর ইসলামের শীর্ষ নেতা আমির হিসেবে পরিচিত। এর রয়েছে শূরা কমিটি ও মুফতি বোর্ড। তাদের বড় অপারেশনের জন্য মুফতি বোর্ডের অনুমতি নিতে হয়। সংগঠনটি কিছুদিন ধরে তাদের দাওয়াতি বা দাওয়া শাখাকে দুটি ফ্রন্টে ভাগ করে। একটি ভাগ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক, অপরটি জেনারেল। সংগঠনে সদস্য বাড়াতে যারা মাদ্রাসায় পড়ূয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করবে, তারা কখনও জেনারেল ফ্রন্টে গিয়ে দাওয়াত দেবে না। যাদের টার্গেট করে অনলাইনে দাওয়াত দেওয়া হয়, তাদের বলা হয় 'মাদু'। সদস্য হওয়ার পর বিভিন্ন ট্রেনিং শেষে তাদের তৈইফ্যায় বিভক্ত করা হয়। তৈইফ্যা সেল স্লিপার সেল নামে পরিচিত। বর্তমানে সব মিলিয়ে আনসার আল ইসলামের দুইশ সক্রিয় সদস্য রয়েছে। সদস্যদের অনেকে একসময় জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহ্‌রীর ও শিবিরের নেতাকর্মী ছিলেন।

গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের টুইটে বলা হয়, '২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আল কায়দাভিত্তিক সন্ত্রাসীরা মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে হত্যা এবং তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদকে আহত করে।' পুরস্কার ঘোষণা দেওয়া প্রকাশিত পোস্টারের শিরোনামে বলা হয় 'রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস'।
বাংলাদেশি 'হোমগ্রোন' কোনো জঙ্গিকে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণার বিষয়টি নানাভাবে বিশ্নেষণ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। তাদের কারও ভাষ্য, এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জিয়া ও আকরামের ফাঁসির দণ্ড হয়। এই দণ্ড ছাড়াও জঙ্গি দমনে সরকার যেসব পদক্ষেপ নানা সময় নিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে। সন্ত্রাস-জঙ্গি দমনে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতি। বাংলাদেশি কোনো জঙ্গির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অঙ্কের পুরস্কার নজিরবিহীন। এ ঘোষণায় বাংলাদেশ সম্পর্কে 'ভুল বার্তা' যেতে পারে। আবার এমন অভিমতও আছে, পুরস্কার ঘোষণা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও স্পষ্ট হলো।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে এর আগেও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। যদি জিয়া দেশের বাইরেও পালিয়ে থাকে, পুরস্কার ঘোষণায় এখন একটা বার্তা যাবে- কোথাও সে নিরাপদ নয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আরও দুটি বিয়ে করেছেন জঙ্গি জিয়া। প্রথম ঘরে তার দুই সন্তান রয়েছে। সর্বশেষ সাভারের এক তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। বহু বছর ধরে পরিবারের কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। এমনকি মেইলেও কোনো যোগাযোগ করছেন না তিনি। অন্তত চারবার জিয়াকে ধরার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু সফল হতে পারেননি। আর তার অন্যতম সহযোগী পুরস্কার ঘোষিত আরেক মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি আকরাম ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহর বাড়ি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেখানে তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। আকরামের বাবা দুটি বিয়ে করেন। আকরাম প্রথম পক্ষের সন্তান। তিনি জিয়ার মতো দীর্ঘদিন 'হাওয়া' হয়ে আছেন।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জিয়াকে ধরতে অনেক দিন ধরেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণা আমাদের চেষ্টার গতি বাড়ানো-কমানোর ওপর কোনো প্রভাব রাখবে না।





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews