মহাখালি কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি ফারুকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সবচেয়ে বিক্রি কোনও পণ্যের। তার এক কথায় জবাব হ্যান্ড ওয়াশ, তারপর সাবান। তিনি হিসাব দিলেন- আগে স্বাভাবিক সময়ে চার থেকে পাঁচ কার্টন বিক্রি হতো। দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরাপরার পর থেকে আট থেকে দশ কার্টন বিক্রি হচ্ছে।তবে মাঝ খানে হ্যান্ড ওয়াশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাল চেয়েও পাইনি। এখন আসছে।কিন্তু এখনকার চাহিদার তুলনায় কম। ফারুকের কথাই প্রমান করে বাজারে হাত পরিষ্কারের সামগ্রীর বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। তালিকায় সাধারণ সাবান তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে তিন-চার গুণ চাহিদা তৈরি হয়েছে লিক্যুইড হ্যান্ডওয়াশের। বাজারে এখন সাবার সবকম্পানির পওয়া গেলেও হ্যান্ডওয়াশ পাওয়া যা্চ্ছে দু-একটি কম্পানির। তার মধ্যে ইউনিলিভারের লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশের রিফিল প্যাক পাওয়া যাচেছ সবখানেই।
হারুন আর রশিদ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আগে তিনি খাওয়ার আগে ও পড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতেন। দেশে করোনা রোগী ধরা পড়ার পর তিনি লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ কিনেছেন। সেই সঙ্গে অফিস থেকেও মাঝে মাঝে মিনিপ্যাক দিচ্ছে হাত পরিস্কারের জন্য। এছাড়া জীবাণুনাশকও (হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড রাব) কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন দিনে অন্তত ১০ বার হাত পরিষ্কার করি। সবার মধ্যেই হাত পরিষ্কার করার একটা বাড়তি প্রবণতা দেখছি। এটার প্রয়োজনও রয়েছে।সবারই উচিৎ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা’। উল্লেখ্য, করোনা প্রতিরোধে বারবার সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা–আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। শুরুতেই বাজারে যে পণ্যটির ঘাটতি তৈরি হয় সেটি হলো জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড রাব এবং তরল সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ। এখনো বাজারের এসব পণ্যের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম।তবে আগের তুলনায় সরবরাহ বেড়েছে, ফলে এসব পণ্যের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বাড়তি চাহিদা দেখে নতুন করে কেউ কেউ উৎপাদন শুরু করেছেন।
জীবাণুনাশক ও সাবানজাতীয় পণ্য বিপণনকারী এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, চাহিদা এত বিপুল যে উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করেও সবাইকে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
একটি বহুজাতিক কম্পানির গত জুন মাসের বাজার জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাবান ও সমজাতীয় পণ্যের বাজারের আকার ৭৭ হাজার ৩৮২ টন, যা টাকার অঙ্কে ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। বার্ষিক বিক্রির প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ শতাংশের মতো। মার্চের হিসাবে, বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশ বলেছে, মার্চে তাদের সাবান ও এ–জাতীয় পণ্যের চাহিদা বেশ বাড়তি ছিল। এর একটা কারণ অবশ্য মানুষ বাড়তি কিনে মজুত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন সংশ্লিষ্টরা (প্রসাধন) বলছেন, ‘আমরা পুরো দেশে সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছি, যাতে সবাই কিনতে পারে।’
জীবাণুনাশক ও সাবানের বাজারে আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণন বিভাগের প্রধান জেসমিন জামান বলেন, তাঁদের হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজার বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ। সাধারণ সুগন্ধি সাবান বিক্রি বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
কম্পানিগুলো বলছে, এখন যাঁরা নতুন ক্রেতা হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে স্থায়ী ক্রেতায় পরিণত হবেন। এসিআইয়ের সৈয়দ আলমগীর বলেন, সাধারণত কোনো পণ্য কোনো কারণে মানুষের হাতে গেলে সেখান থেকে একটা অংশ স্থায়ী ক্রেতায় পরিণত হন।
বাংলাদেশের মানুষের হাত ধোয়ার প্রবণতা কেমন, তা নিয়ে একটি জরিপও করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তা অবশ্য মার্চের আগে, গত ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ৬৪ হাজার ৪০০ নমুনা নিয়ে করা এ জরিপে দেখা যায়, ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন তাঁদের সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস রয়েছে। ২০১২-১৩–তে এই হার ছিল ৫৯ শতাংশ।
অবশ্য এ ধরনের জরিপ নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। উত্তরদাতারা অনেক সময় সঠিক তথ্য দেন না বলে মনে করেন অনেকে। বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ওয়াটার এইডের আঞ্চলিক পরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) খায়রুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, সঠিকভাবে হাত ধুচ্ছে আসলে খুব কম। তিনি বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। মানুষ বারবার হাত ধুচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’খায়রুল ইসলাম বলেন, ভবিষ্যতে হাত ধোয়ার প্রবণতা বাড়াতে প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিশুদের বারবার হাত ধোয়ার বিষয়টি শেখানো উচিত।