বোরো মৌসুমে হাওড়াঞ্চল দেশের ৩০ শতাংশের মতো চালের জোগান দেয়। সাত জেলার হাওড়ে এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। হাওড় ও হাওড়ের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় হাওড়ের সব ধান কৃষকের ঘরে উঠবে এটা আশা করা যায় এবং কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও ইটনা উপজেলায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।

কয়েকটি হাওড়ে সরজমিনে দেখা গেল, বোরো ধান কাটার এ উৎসবে শুধু কৃষান-কৃষানিই নয়, বাড়ির সব বয়সি মানুষই এসে হাত লাগিয়েছে ধানকাটা, মাড়াই এবং গোলায় তোলার উৎসবে। এদের কেউ খেত থেকে ধান কাটছে, কেউ কেউ খেতেরই ফাঁকা স্থানের ‘খলা’  তৈরিতে ব্যস্ত, ধান কাটা শেষে ইঞ্জিনচালিত ট্রাক্টর দিয়ে তা জমি থেকে খলায় নিয়ে আসা হচ্ছে, খলায় মেশিন (মাড়াই কল) দিয়ে চলে মাড়াই, পরে সেখানেই শুকানো হচ্ছে মাড়াইকৃত ধান। তীব্র রোদে শুকানো ধান বস্তাভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোলায়, বিভিন্ন উপজেলার হাওড়ে লেগেছে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের ধুম। মাত্র একটি জেলার চিত্র।
ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর, যা চিন্তায় ফেলেছে ওই অঞ্চলের কৃষকদের। তারা জানিয়েছেন, মাঠের সব ধান পাকতে আরও সপ্তাহ দুয়েক লাগতে পারে। তার আগে অতিবৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপাশি উজানের ঢলে হাওড় রক্ষা বাঁধ ভেঙে ডুবে যেতে পারে ফসল। তাই আকাশে মেঘ করলেই বাড়ে আতঙ্ক। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে নদীর পানি। আগাম বন্যার শঙ্কায় কাটছে দিন।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার সুনামগঞ্জের বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫০২ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত পর্যন্ত হাওরসহ উঁচু এলাকার ৮০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সবচেয়ে বেশি হাওড় অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগ আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় পাকা ধান দ্রুত কাটতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে। উজানে ভারি বৃষ্টির এমন পূর্বাভাসে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের কৃষক চিন্তিত। কারণ ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি।

এক ফসলি এসব জমির দিকে সারা বছর তাকিয়ে থাকেন হাওড় অধ্যুষিত সাত জেলার কৃষক। তবে সবচেয়ে বেশি ধান হয় নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ জেলায়। দ্রুত ধান কাটার তাগিদও দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এদিকে নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হলেও গত তিনদিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। বজ্রপাতের কারণেও কৃষকদের সতর্কতায় প্রশাসন মাইকিং করেছে। এপ্রিলের মধ্যে শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
নেত্রকোনার ১০ উপজেলার মধ্যে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলা হাওড়প্রধান হলেও কলমাকান্দা, আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলায় বেশকিছু হাওড় রয়েছে। এসব হাওড়ে বর্তমানে দ্রুতগতিতে চলছে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। এ বছর হাওড়ে স্বল্প জীবনকালীন ও উচ্চফলনশীল জাতের ব্রি-ধান-৮৮, ব্রি-ধান-৯২-এর মতো হাইব্রিড জাতের ধান রেকর্ড পরিমাণে চাষ করেছেন কৃষক।

খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের কৃষক বলেন, ‘এলাকার কৃষকরা আনন্দের সঙ্গে ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুই দিনের বৃষ্টিতে ধান কাটায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে তেমন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভয়ের কারণ বজ্রপাত।’ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় এ বছর মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওড়ে আবাদ হয়েছে ৪১ হাজার ৭৫ হেক্টর জমিতে।

এরই মধ্যে ১২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমির ধান কর্তন হয়েছে, যার পরিমাণ ৩১ ভাগ ধান কাটা সমাপ্ত হয়েছে। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, বোরো মৌসুমে হাওড়ের কৃষকরা যাতে আগাম বন্যা থেকে ফসল রক্ষা করতে পারেন সেজন্য কৃষি শ্রমিকের পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ১২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে, যা রোপণ করা ধানের ৩১ ভাগ।’

বৃষ্টির পাশাপাশি নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের কৃষকের মাঝে বজ্রপাতের আতঙ্কও রয়েছে। খালিয়াজুরীর পৃথক স্থানে সম্প্রতি বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হন একজন। তাই প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য মাইকিংও করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে থেকে হাওড়াঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় বিশেষ করে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেবে না বলে আশা করা যায়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পাশাপাশি বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও সম্প্রতি ভারতের উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হাওড় অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগ আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় পাকা ধান দ্রুত কাটতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে। উজানে ভারি বৃষ্টির এমন পূর্বাভাসে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওড়ের কৃষক চিন্তিত। কারণ ধান এখনো পুরোপুরি পাকেনি।

শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাখিমারা হাওড়ের কৃষক বলেন, ‘আমি এবার চার একর জমিতে ধান আবাদ করেছি। আগাম জাতের এক একরের ধান পেকে যাওয়ায় কেটে ঘরে তুলেছি। বাকি ধান পাকতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এখন বৃষ্টিপাতের যে খবর শুনছি তাতে ভয়ে আছি।’ দেখার হাওড়ের কৃষক বলেন, ‘আমার জমির ধান এখনো পাকেনি। ডিসি সাহেব (জেলা প্রশাসক) ধান কাটতে বলেছেন। এখন আমি কি কাঁচা ধান কাটব? ভারী বৃষ্টিপাত হলে তো আমরা মাঠে মারা যাব।

একদিকে বাঁধ ভাঙা, অন্যদিকে জলাবদ্ধতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, ‘যেহেতু আবহাওয়া খারাপ হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে, তাই কালক্ষেপণ না করে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু কৃষি নয়, হাওড়সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।’
কৃষি ক্যালেন্ডার অনুসারে এপ্রিল-মে মাসেই বোরো ধান কাটার সময় এবং বন্যা শিলাবৃষ্টির ঝুঁকিতে কৃষকরা দিন কাটায়। কিন্তু এ বছরটি ব্যতিক্রম বিশেষত: অনাবৃষ্টির কারণে বোর ধানসহ সব কৃষি উৎপাদনের ওপর এর প্রভাব লক্ষণীয়। অন্যান্য বছরের মতো এবার কৃষিশ্রমিকের ঘাটতির সম্ভাবনা রয়েছে ।এখন করণীয় হলোÑ ১. বোরো ফসল কাটার সময় কৃষিশ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে যান্ত্রিক হারভেষ্টরের সংখ্যা বাড়াতে হবে ;২. ধান কাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র গত বারের মতো এবারও সরকার প্রস্তুত রেখেছে এবং আগ্রহী উদ্যোক্তাদের ক্রেডিটসহ প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করছে।

২০২০ সাল থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় দেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকা- বিঘিœত হচ্ছে। এর ফলে অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি খাতে স্বল্পসুদে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষকদের স্বাভাবিক উৎপাদনশীল কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনাসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ খাতে ঋণ/বিনিয়োগের সুদ/মুনাফা হার হ্রাস করা প্রয়োজন।

সরবরাহ পরিস্থিতি বাড়াতে এরই মধ্যে সরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি সব বাধা দূরীভূত হবে এবং আমরা আমাদের পূর্বের রেকর্ড ধরে রাখতে সক্ষম হব ধান-চাল উৎপাদনে। সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি),

সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews