দেশে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান জব্দের ঘটনায় জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রটির আর্থিক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। নাইজেরিয়া থেকে চক্রের হোতা ডন ফ্রানকি ওরফে জ্যাকব ফ্রানকের পাঠানো অর্থ কয়েক হাত ঘুরে পৌঁছায় বাংলাদেশের সদস্যদের কাছে। এ ক্ষেত্রে বাইন্যান্স অ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা থেকে তা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তর করা হয়। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত চক্রের অন্যতম সদস্য ইজাহা ইমানুয়েল চিদারারের হিসাবে আসত। তবে তার হিসাবটি স্থগিত হওয়ার পর ‘ত’ আদ্যাক্ষরের এক বাংলাদেশি সদস্যের মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর হয়। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
সংস্থাটির ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান সমকালকে বলেন, শতকোটি টাকার কোকেন চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। জড়িত চক্রের ছয়জনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ মালাউইর নাগরিক নোমথান্দাজো টাওয়েরা সোকোকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় করা মামলায় কারাগারে আছেন সোকো। পরে চক্রের আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তারা হলেন– ডন ফ্রানকির বাংলাদেশের অফিসের ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান আপেল, তার সহযোগী সাইফুল ইসলাম রনি, নাইজেরিয়ার ননসো ইজেমা পিটার ওরফে অস্কার, নুলু এবুকে স্ট্যানলি ওরফে পোডস্কি ও চিদারা।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, ডন ফ্রানকি বাংলাদেশে অবস্থানরত নাইজেরিয়ান নাগরিকদের সংগঠনের সভাপতি। এই সূত্রে সবাই তাকে চেনে এবং তিনি স্বদেশি যে কাউকে মাদক কারবারে ব্যবহার করতে পারতেন। ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র চিদারাও তার সহযোগী। বর্তমানে নাইজেরিয়াতে থাকা ফ্রানকি সেখানকার মুদ্রা ‘নাইরা’য় লেনদেন করেন। তিনি নগদ অর্থ তুলে দিতেন চিদারার মা ক্যারোলিনা ওকোরি এবং মেয়ে বন্ধু মনিকা গ্রেস এবোয়ির কাছে। মনিকা সেখানে বাইন্যান্স ডিলার। তিনি মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বদলে চিদারার বাইন্যান্স ওয়ালেটে পাঠাতেন। তাঁর বাইন্যান্স হিসাব নাইজেরিয়ায় থাকা অবস্থায় খোলা হয়। ফলে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করায় তাঁর হিসাবটি স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে চক্রের সদস্য ‘ত’–এর বাইন্যান্স ওয়ালেটে টাকা পাঠানো হতো।
টাকা বিতরণ করেন ‘ত’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএনসি উত্তরা সার্কেলের পরিদর্শক ওবায়দুল কবির বলেন, কাকে কত টাকা দিতে হবে সেই তালিকা নাইজেরিয়া থেকে অস্কারের কাছে পাঠাতেন ফ্রানকি। অস্কার আবার সেই তালিকা দিতেন চিদারাকে। তিনি তালিকাটি ‘ত’–কে পাঠাতেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী টাকা বিলি করতেন ‘ত’। টাকার প্রাপকদের মধ্যে রনি সিনোভ্যাক্স বিডি নামে একটি বায়িং হাউসের পরিচালক। গত সেপ্টেম্বরে সোকো এ দেশে এলে তাঁর হোটেল বুকিংসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেন তিনি। আপেল ও ফ্রাংকি যৌথভাবে এমজে কালেকশন নামে একটি ফ্যাশন হাউস চালুর প্রারম্ভিক পর্যায়ে ছিলেন। একেকটি কাজ করে দেওয়ার জন্য চক্রের সদস্যরা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পেতেন।
‘কাটআউট’ কৌশল
তদন্ত সূত্র জানায়, কোকেনের কারবার চালান মূলত ডন ফ্রানকি ও তার ভাই ডন উইজলি। বর্তমানে উইজলি ভারতে অবস্থান করছেন বলে তথ্য মিলেছে। এ কারণে বাংলাদেশ হয়ে কোকেনের প্রাথমিক গন্তব্য ছিল ভারত। ধারণা করা হচ্ছে, পরের ধাপে উইজলি চালানটি ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশে পাঠাতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে চক্রের সদস্যরা ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে কাজ করেন। অর্থাৎ এক ধাপে কাজ করা সদস্যরা এর আগের বা পরের ধাপের বিষয়ে বিশেষ কিছু জানেন না। ফলে চক্রের একজন ধরা পড়লেও তারা অন্যদের ব্যাপারে তথ্য দিতে পারেন না। একই কারণে কোকেনের মূল গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা হলেও ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশ। কারণ আফ্রিকা থেকে যাওয়া সব পার্সেলে কড়া নজরদারি থাকে। এবারের চালানটি আফ্রিকার দেশ মালাউই থেকে যায় ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায়। সেখান থেকে কাতারের রাজধানী দোহা হয়ে পৌঁছে ঢাকায়। চক্রটি কৌশল হিসেবে মুদ্রার বদলে স্বর্ণ, মাদক বা অন্য বস্তুর বিনিময়েও কোকেন হস্তান্তর করে।
ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই দিল্লি
গ্রেপ্তারদের মধ্যে অস্কার ভালো ফুটবল খেলেন। পাসপোর্ট-ভিসা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে তিনি ভাড়ায় খেলেন বলে দাবি করেন। পোডস্কিরও পাসপোর্ট-ভিসা নেই। বৃহত্তম চালানটি ধরা পড়ার সপ্তাহখানেক আগে তিনি দিল্লিতে কোকেনের আরেকটি চালান পৌঁছে দিয়ে আসেন। সেই বাবদ পান ২ হাজার ডলার। তার কাছে ভারতীয় রেলের একটি টিকিট পাওয়া যায়। জানা যায়, কোকেন নিয়ে তিনি প্রথমে কুমিল্লা সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে চক্রের এক সদস্যের সহযোগিতায় সীমান্ত পার হয়ে গৌহাটি চলে যান। পরে ট্রেনে যান দিল্লি। ওই দেশের এক নাগরিক তাকে ট্রেনের টিকিট কেটে দেন।