‘মত্স্য মারিব খাইব সুখে, কী আনন্দ লাগছে বুকে’—ইহা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গীতিকবিতার পঙক্তি। আমরা মত্স্য চাষে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হইয়াছি বটে; কিন্তু বেশির ভাগ সময় যেই সকল মাছ এখন আমাদের পাতে উঠে, তাহা স্বাদে-গন্ধে-পুষ্টিতে আগের তুলনায় নগণ্য বলিলেও কম বলা হয়। সুতরাং মত্স্য মারিয়া তাহা সুখে খাওয়া যাইবে কি না—ইহা এখন অনেক বড় প্রশ্ন। কারণ, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ বাজার হইতে ‘প্রায় নাই’ হইয়া গিয়াছে।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশের একমাত্র মত্স্য জাদুঘরের পরিচালকের মতে, এই মুহূর্তে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রহিয়াছে। ‘আইইউসিএন’ বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করিবার জন্য দুইটি জরিপ চালাইয়াছিল। ২০০০ সালে প্রথম জরিপে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসাবে চিহ্নিত করা হইয়াছিল, ইহার পর ২০১৫ সালের জরিপে ঐ তালিকায় আরও ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হইয়াছে। এই তালিকায় সেই সকল মাছকেই চিহ্নিত করা হয় যেইগুলি গত ১০ বা ২০ বত্সরে দেখা যায় নাই। একটি সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, জেলে ও চাষিদের ছোটো ছোটো উদ্যোগে দেশে বত্সরে ১৬ লক্ষ টন মাছ উত্পাদিত হইয়া থাকে। উন্মুক্ত জলাশয় হইতে আহরণ করা এইসকল মাছের বেশির ভাগই দেশি প্রজাতির। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, ইহাদের পুষ্টিমানও অনেক বেশি; কিন্তু ধারাবাহিক দূষণ ও অতিরিক্ত আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। অন্যদিকে মত্স্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মত্স্য অধিদপ্তরের পৃথক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশি প্রজাতির ৯১টি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। এইসকল গবেষণায় প্রাকৃতিক উেসর মাছের বেশ কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে, দেশে এখন অবধি ৩০টি আগ্রাসি প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকিয়া পড়িয়াছে—যাহা দেশি ছোটো মাছের জন্য যম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশককেও বিশেষ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হইয়াছে। দেশের কৃষিকাজে প্রতিবত্সর প্রায় এক লক্ষ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহূত হয়—যাহা মাটি চুয়াইয়া জলাভূমিতে গিয়ে পড়ে। ইহার ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হইতেছে। ইহার সহিত বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো আছে কলকারখানার বর্জ্য, যাহা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়। এই সকল কারণে মাছের উত্পাদন কমিতেছে বলিয়া মনে করেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। তাহা ছাড়া, শহর ও গ্রাম—দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরনের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমিয়া যাইতেছে। এই কারণেও দিনে দিনে কমিতেছে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত মাছের পরিমাণ।
মাছ কেবল প্রোটিনের উত্স নহে, উহার স্বাদ এবং পুষ্টিমানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে দেশীয় মাছের তুলনা চলে না। হাইব্রিড কিংবা বিদেশি মাছের স্বাদ ও পুষ্টিমান কোনোটাই দেশি মাছের সমতুল্য নহে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এইসকল বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সুতরাং দেশীয় মাছ রক্ষার্থে যেই সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে, সেই ব্যাপারে বিলম্ব করিবে না—ইহাই প্রত্যাশিত।