মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুর্দশা শেষ পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যেখানে নোবেল বিজয়ীদের মতো গুণীজনরা ও আরো অনেকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পেরেছে রোহিঙ্গারা। এমনকি বিশিষ্টজনদেরও দৃষ্টিক্ষেপণে এসেছে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষরা। দৃঢ় মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ তত্পরতার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে এই চলমান দুর্দশা শেষ হতে পারে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির‌্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্প্রদায় যে গণহত্যার শিকার বলে আখ্যায়িত হয়েছে তা কোনো অত্যুক্তি নয়। রোহিঙ্গাদের ঘিরে নির‌্যাতনের যে ক্রূরচিত্র আমরা দেখি তা মিয়ানমার সরকারের হৃদয়হীনতার বাস্তব প্রতিফলন। এরই ভেতর রোহিঙ্গারা যুগ যুগ ধরে কোনোমতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

যেহেতু সরকার ইতিহাস বিকৃত করে তাদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে এবং তাদের ভাসমান চোরাকারবারি ও তাদের বংশধর হিসেবে বিবেচনা এই সম্প্রদায়ের অসহায়ত্ব হাজার গুণে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য তো হলো এই যে রোহিঙ্গারা পরিচয়হীন কোনো জনগোষ্ঠী নয়। তাদের শিকড় খুঁজে পাওয়া যায় হাজার বছর আগে আরব বণিকদের এই অঞ্চলে পদার্পণের ভেতর দিয়ে। অনেকের মতে, রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ এই আরব বণিকরা, যাদের অনেকেই আরাকান ও মিয়ানমারের অন্যান্য প্রদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। তখন থেকেই পশ্চাত্পদ দেশ মিয়ানমারের সরকার ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। শুরু হয় নির‌্যাতন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব মহল রোহিঙ্গা সমস্যা একই ভাবে দেখে না। এবং এই সমস্যার সমাধানে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলাদা। রোহিঙ্গা সমস্যার একটি চূড়ান্ত সমাধান যে অতি জরুরি বিষয়—সবাই তা মনে করে না। ২০১১ সাল থেকে এই সমস্যার নতুন মাত্রা সংযোজিত হলেও সংশ্লিষ্ট সবাই নির্বিকার। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট ও তাঁর মতো অনেকে বরং এ সমস্যাকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখেন। তাঁর জনবিরল দেশ সমুদ্রে আটকে পড়া আট হাজার রোহিঙ্গাকে (সম্ভবত আশ্রয়ের খোঁজে অভিবাসনপ্রয়াসী রোহিঙ্গা, যাদের কোনো দেশই তাদের উপকূলে ভিড়তে দিচ্ছে না) গ্রহণ করবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘না-না-না’ ছিল অ্যাবটের হৃদয়হীন উত্তর।

কেন এই বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে তাঁর এ অনীহা—এমন প্রশ্নে অ্যাবট যে যুক্তি তুলে ধরেন তা আরো হৃদয়হীন। অ্যাবট ওদের নিতে চাননি, তার কারণ, তাঁর দৃষ্টিতে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ তাঁর দেশ ও জনগণের জন্য কোনো সৌভাগ্য বয়ে আনতে অক্ষম। তাই বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গারা সমুদ্রপথে ভাঙাচোরা নৌযানে সব কিছু উপেক্ষা করে মুক্তির পথ খোঁজে। মিয়ানমারেও তো তাদের ভূমিস্বত্ব নেই। তাদের জন্য কারাগার। ওই দেশে থেকে গেলে ওদের ভাগ্যে আছে জোর করে কোনো বিনিময় ছাড়াই ওদের শ্রমে লিপ্ত করা। চলাফেরায়ও সেখানে তাদের স্বাধীনতা নেই।

সীমান্ত নজরদারি সত্ত্বেও ফাঁকফোকর দিয়ে এসে অনেকেই বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত নাগরিকদের  ওপর বোঝা হয়েছে। কিছু আসে রাজনীতিতে থাকা বাংলাদেশিদের ভোটব্যাংক রূপে। এতকাল তো মিয়ানমার সামরিক জান্তার ক্রূর শাসনের অধীনে ছিল। ১৯৭৯ সালে এই নিবন্ধকারের জান্তাশাসিত মিয়ানমারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল এই রোহিঙ্গা সমস্যারই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে। আমাদের ডেলিগেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তত্কালীন পররাষ্ট্রসচিব তাবারক হোসেন। তখনই দেখেছি যে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের অবস্থানের সুরক্ষায় তারা কতটা অটল। যেহেতু পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের এক মোহ জাল বিস্তার করেছে, দেশটিতে গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ আন্দোলন গত কয়েক বছর যাবৎই দানা বেঁধে উঠেছে, যার নেতৃত্বে আছেন একজন বিভাবতী অং সান সু চি। মিয়ানমারের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর পেছনে থাকলেও তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বসতে অনীহা।

একসময় মিয়ানমারের জনগণ ও রোহিঙ্গা সমাধানকামী বিশ্বের দেশগুলো অনুমান করেছিল যে নিষ্কলুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর মিয়ানমারের ক্ষত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানও গতি পাবে। তাদের নিরাশ করে সু চি এখন অস্বচ্ছ এক ভূমিকায় নেমেছেন। ফলে তিনি কিছু গণতন্ত্র চাইলেও জান্তা ও তার প্রবর্তিত নীতিতেই সন্তুষ্ট থাকতে চান।

সু চি, যাঁকে সবাই গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা বাহক ভেবেছিল, তাঁর হতাশাব্যঞ্জক রাজনীতিতে গণতন্ত্র প্রবর্তনের আর কোনো আশা থাকল না। যে জান্তার বিরুদ্ধে সু চি মরণপণ সংগ্রামে নেমেছিলেন এবং বছরের পর বছর গৃহবন্দিত্ব বরণ করেছিলেন তার সঙ্গে এই নেত্রীর অঘোষিত সমঝোতা শুধু রোহিঙ্গাদের নয়, সব গণতন্ত্রকামী মহলের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ঘিরে সু চির কিছু বিতর্কিত বক্তব্য তাঁকে তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবার আর কোনো অবকাশ রাখেনি।

মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির‌্যাতন গণতন্ত্রের মূর্তপ্রতীক নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি, যিনি রোহিঙ্গাদের অমানবিক অবস্থায় রহস্যজনক কারণে নীরব। অনুমিত যে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাঁকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের মতো দুর্লভ সম্মান প্রদর্শিত হয়েছিল—তিনি তা নন। মিয়ানমারের চলমান অমানবিকতার সঙ্গে গোপনে সম্পৃক্ত অথবা রোহিঙ্গা নির‌্যাতনের সরকারি নীতির প্রতি তাঁর নৈতিক সমর্থন আছে বলে মনে হয়।

হালনাগাদ মিয়ানমারে সু চি ও জান্তার আঁতাতের ফলে দেশটিতে গণতন্ত্রের ভেলকিবাজি সফল হয়েছে। বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থা ইয়াঙ্গুনে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে এবং তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের সব উপকরণ পাঠাচ্ছে মিয়ানমারের মতো ভুতুড়ে দেশটিতে কাঁড়ি কাঁড়ি লাভের আশায়। এ সবকিছুই নিজ গতিতে অগ্রসর হচ্ছে—যখন হাজারো নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী-পুরুষসহ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে খাঁচাবন্দি, সমুদ্রে ভাসমান অথবা নিকটস্থ কোনো জঙ্গলে মুক্তিপণের জন্য আটক। পলায়নপর রোহিঙ্গাদের মুক্তির কোনো প্রচেষ্টাই নয় এবং সত্যিকারের আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিই হয়তো মিয়ানমারে গণতন্ত্রের লেবাস পরিহিত ভণ্ডদের ঔদ্ধত্য দমন করতে পারে।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews