প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শুক্রবারের লন্ডনের বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছর রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে-যৌথ ঘোষণায় এমন প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানিয়েছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। তারা বলেছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনই উপযুক্ত সময়। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে গুমোট পরিবেশ অনেকটা কেটে গেছে।
শুক্রবার লন্ডনে বৈঠকের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, এই বিষয়টিকে পজিটিভ মনে করি। প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময় এগিয়ে আনতে সম্মত হয়েছেন। তবে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এ-ও বলেছেন-সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি? অর্জন করা প্রয়োজন হবে। এই একটি কথার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন আগেও করা যেতে পারে, পিছিয়েও যেতে পারে। সরকার এবং বিএনপির বৈঠক হয়েছে। কিন্তু পার্টি তো আরও আছে। তারা তো পরে আরও কথা তুলতে পারে। কাজেই আমি এটাকে ইতিবাচক ইঙ্গিত বলব। চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে-এটা তো বলা যাবে না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল, সেই প্রত্যাশার অনেকখানি হয়তো এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে অর্জন করার পথ তৈরি হলো।
বিচার ও সংস্কারটা দৃশ্যমান করা গেলে আগামী ফেব্রুয়ারি, রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচন করার ব্যাপারে আমার মনে হয়, প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কার করে বক্তব্য দিয়েছেন। আর নির্দিষ্টভাবে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করবে। কিন্তু যেটা মোটামুটি বোঝা গেছে যে, ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগেই জাতীয় নির্বাচনটা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর সংস্কার ও বিচারের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই এই বৈঠকের মধ্যে আরও আস্থার সঙ্গে, দৃঢ়তার সঙ্গে কাজগুলো এগোনো যাবে। আমি মনে করি, বোঝাপড়ার জায়গাটা তৈরি হলো।
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, রমজানের আগে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুমোট পরিবেশ ছিল তা অনেকটা কেটে গেছে। আশা করছি, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার জনগণ দেখতে পাবে। মানুষ তার ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স যুগান্তরকে বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সরকার যদি সংস্কার অর্থ করিডর দেওয়া, বন্দর লিজ দেওয়া, এগুলোকে বোঝান-যা তাদের প্রেস সচিব বলেছিলেন এসব বিষয় নাকি সংস্কার করার ম্যান্ডেট তাদের আছে। এ বিষয়ে তো আমরা দৃঢ়ভাবে দ্বিমত করি। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন নেই। আমরা মনে করি গণ-অভ্যুত্থানের সময় যেসব হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কাজ দৃশ্যমান করা এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। আমরা এ বিষয় অর্থাৎ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখতে চাই। এটা দেখে এবং আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে কথা বলে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের সময় এগিয়ে নিয়ে আসা এবং এই প্রেক্ষিতে বিচার ও সংস্কারের কাজে দ্রুতই পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করার যে আলোচনা হয়েছে, সেটাকে আমরা ইতিবাচক বলে মনে করি। এই বৈঠকের ফলে নির্বাচনের পাশাপাশি সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির কাজটি এখন যথাযথ মনোযোগ পাবে বলে আমরা আশা করি।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক আপাতদৃষ্টিতে ফলপ্রসূ হয়েছে বলে মনে করি। শুরু থেকেই আমরা বিভেদ ও কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সংলাপ এবং সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আমরা অনুভব করছিলাম প্রফেসর ইউনূস অযথা তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান না। আবার বিএনপিও সংস্কারবিরোধী নয়। কিন্তু যে কোনো কারণে উভয় পক্ষে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কয়েকজন উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতার অপরিণামদর্শী বক্তব্য ও নানা মন্তব্য এই দূরত্ব আরও বাড়িয়েছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের একান্ত বৈঠক এ সংকট দূর করবে বলে আশাবাদী। বিএনপি ডিসেম্বর থেকে সরে এসে রমজানের আগে অর্থাৎ ফেরুয়ারিতে, আর সরকারও প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে কোনো আপত্তি নেই বলে যে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে তা বেশ ভালো অগ্রগতি বলে আমরা মনে করি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, এই বৈঠকের দিকে গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল। বৈঠক-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে আমরা জানতে পারলাম নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে একটা সমঝোতা হয়েছে। তারেক রহমান প্রস্তাব করেছেন আগামী রমজানের আগে যাতে জাতীয় নির্বাচন করা হয়। সে ব্যাপারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে প্রস্তাবকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে বলেছেন, হ্যাঁ, যদি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায়, তাহলে আগামী রমজানের এক সপ্তাহ আগে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এই বৈঠক থেকে পরিষ্কার হলো-আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে যে সংকট-সংশয় ছিল এটা অনেকটাই কেটে গেছে। আশা করা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন আর কোনো সংকট নেই।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার সম্মতিকে স্বাগত জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। দলটির আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ বলেন, রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ফেরুয়ারির মধ্যে মৌলিক সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হওয়া প্রয়োজন বলেও যে অভিমত তিনি ব্যক্ত করেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দূর হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব যুগান্তরকে বলেন, আমরা আনন্দিত। আমরা মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। এখন আমাদের দেশের রাজনীতিতে অনেক ফায়দা হবে।
এদিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি জানায়, উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আমরা নিঃসন্দেহে এই আলোচনা ও ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানাই। তবে সেই সঙ্গে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জনগণ শুধু কথায় নয়, বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতির পদক্ষেপ দেখতে চায়।
বৈঠককে জাতির জন্য একটি স্বস্তির বার্তা হিসাবে উল্লেখ করেছে ১২ দলীয় জোট। জোটের শীর্ষ নেতারা বিবৃতিতে বলেন, এই বৈঠকে সব আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। নেতারা বলেন, আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে যে ফলপ্রসূ ঐকমত্য হয়েছে, তা অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশের মানুষের জন্য এনেছে স্বস্তির বার্তা, আশার আলো। সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সংযোগ ঘটিয়ে এপ্রিল থেকে সরে এসে নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচন আয়োজনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানান তারা। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন-জোটপ্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান ও জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম, জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপার) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রাকিব, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল (পিএনপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ মো. লিটন ও নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি এমএ মান্নান।